বিল্লাল বিন কাশেম
ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক মুসলমান ২৬ রজব দিবাগত রাতটি পবিত্র শবে মিরাজ হিসেবে পালন করে থাকেন। রাতটি তারা কোরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ, জিকির-আজকার, দোয়া-দরুদসহ বিভিন্ন নফল ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে কাটান। যদিও আলেমদের মাঝে শবে মিরাজ পালন নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম শবে মিরাজ পালনের বিরোধী। তাদের অভিমত শবে মিরাজ উপলক্ষে কোনো বিশেষ নামাজ, রোজা হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। সুতরাং শবে মিরাজকে উপলক্ষ করে এ রাতে বিশেষ নামাজ পড়া, পরের দিন রোজা রাখা বিদআত। এসব অবশ্য আজকের আলোচ্য বিষয় নয়, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে আতঙ্ক বিরাজ করছে সর্বত্র। এরই মধ্যে বাংলাদেশের মুসলমানরা সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করবেন নফল ইবাদত-বন্দেগি। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শবে মিরাজের ইবাদত বাসায় করার আহ্বান জানিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক আনিসুর রহমান সরকার বলেছেন, ‘আমরা সবাইকে বলেছি, যারা প্রতি ওয়াক্তে মসজিদে যান জামাতে নামাজ পড়তে, তারা যেন বাসায় অজু করে সুন্নত নামাজ বাসায় পড়ে তারপর মসজিদে যান ফরজ নামাজ পড়তে। এটা স্বল্প সময়ের জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘শবে মিরাজে বাদ মাগরিব ইমাম শুধু মোনাজাত করবেন। সারারাতের ইবাদত আমরা সবাইকে বাসায় করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
প্রতিবছর শবে মিরাজ উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমে ‘লাইলাতুল মিরাজের গুরুত্ব ও তারৎপর্য’ শীর্ষক ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিল হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার ওয়াজ মাহফিল বা আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচি থাকছে না।
ইসলাম ধর্মমতে লাইলাতুল মিরাজ বা মিরাজের রাত, যা সচরাচর শবে মিরাজ হিসাবে আখ্যায়িত হয়। এটি হচ্ছে সেই রাত, যে রাতে ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐশ্বরিক উপায়ে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেছিলেন এবং স্রষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
ইসলামে মিরাজের বিশেষ গুরুত্ব আছে। কেননা এই মিরাজের রাতেই ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ নামাজ মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যক (ফরজ) করা হয় এবং এই রাতেই দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মুসলমানদের জন্য নিয়ে আসেন নবী মুহাম্মদ (সা.)।
ইতিহাস মতে রজব মাসের ২৬ তারিখের (তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে) দিবাগত রাতে কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস গমন করেন। সেখানে তিনি নবীদের নামাজের জামাতের ইমামতি করেন। অতঃপর তিনি বোরাক নামক বিশেষ বাহনে আসীন হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন। ঊর্ধ্বাকাশে সিদরাতুল মুনতাহায় তিনি আল্লাহতায়ালার সাক্ষাৎ লাভ করেন। এই সফরে ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.) তার সফরসঙ্গী ছিলেন।
কোরআনে কারিমের সূরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তার বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’
কোরআনে মিরাজকে ইসরা বলে অভিহিত করা হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী আলেমদের মতে মিরাজ সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায় হয়েছিল। সকল সাহাবা, তাবেয়িন ও তাবে তাবেয়িনের মতও তাই।
মেরাজের রাতে ফলে মুসলমানদের জন্য দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঁচটি নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ করা হয়। এ জন্য নামাজকে মুমিনের মিরাজ বলা হয়।
মিরাজের ঘটনা ইসলামে যথেষ্ট অর্থবহ, তবুও মিরাজ উপলক্ষে বিশেষ রাত উৎযাপনকে ইসলামি চিন্তাবিদরা সমর্থন করেন না। এটা ঠিক, মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বিশেষ নৈকট্য দান করেন। মুসলমানদের নামাজ উপহার দেন। নিঃসন্দেহে ওই রাতই ছিল ফজিলতপূর্ণ। এই রাতের ফজিলত নিয়ে কোনো মুসলমানের সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে এই ফজিলত প্রতি বছরের ২৭ রজবের রাত নয়।
দ্বিতীয় কথা হলো, নির্ভরযোগ্য মতানুসারে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়তের পঞ্চম বছর। এ ঘটনার পর নবী করিম (সা.) আরও ১৮ বছর সাহাবাদের মাঝে দুনিয়ায় ছিলেন। কিন্তু শবে মিরাজের ব্যাপারে এ দীর্ঘ সময়ে কোথাও কোনো বিশেষ হুকুম দিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। থাকলে তিনি তা পালনের নির্দেশ দিতেন, গুরুত্বারোপ করতেন। এ রাতে রাসূল (সা.) নিজেও জেগে থাকেননি। সাহাবিদের জাগতে বলেননি। রাসূল (সা.) পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর ১০০ বছর সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। শতাব্দীজুড়ে এমন একটি ঘটনাও পাওয়া যায় না, যেখানে সাহাবায়ে কেরাম ২৭ রজবকে বিশেষভাবে পালন করেছেন। সুতরাং যে কাজ রাসূল (সা.) করেননি, যে কাজ সাহাবায়ে কেরাম পরিহার করেছেন। সেসব কাজকে দ্বীনের অংশ মনে করা, সুন্নত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা অথবা এসব প্রচলনের সঙ্গে সুন্নতের আচরণ করা বিদআত। আল্লাহতায়ালা আমাদের হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক:
বিল্লাল বিন কাশেম, উপ-পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন
bellalbinquashem@gmail.com