মানুষ মানুষের জন্য,জীবন জীবনের জন্য……মানুষ মানুষকে পণ্য করে,মানুষ মানুষকে জীবিকা করে। ‘ভূপেন হাজারিকা তাঁর সুরের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক দিক। সৃষ্টিকুলের সেরা জীব হিসেবে পরিচিত মানুষ। কিন্তু ব্যক্তি বিশেষে কিছু মানুষের আচরণ পশুর আচরণকেও হার মানায়।
একটা বাস্তব ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করছি,রহিমুদ্দিন সোনাপুর গ্রামের স্হায়ী বাসিন্দা। অভাবের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলতে হয়। পরিবারে এক মেয়ে ,এক ছেলে। রহিমুদ্দিনের স্ত্রীর বয়স ষাটের কাছাকাছি। প্রায়ই অসুস্হ থাকে তাঁর স্ত্রী। তিনি নিজেও তেমন কাজ করতে পারে না কারণ কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী। ছেলে-মেয়ে দুজনও প্রতিবন্ধী। চারজনের সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব ছিল ।স্থানীয় বাজারে থাকেন সারাবেলা,কারো বাজার বাড়িতে দিয়ে আসলে তার বিনিময়ে পাচঁ টাকা অথবা দশ টাকায় ছিল তাঁর উপার্জনের মূল উৎস। এভাবে সারাদিনে ষাট-সত্তর টাকা রুজি হত। আবার কোনো কোনো দিন ভিক্ষে করতো বিভিন্ন এলাকায়। এভাবেই চলতে থাকে তাদের সংসার। বাড়ির জায়গা বলতে ভিটের জায়গাটুকু আছে,ভালো ঘরও নাই। ঝড়,বৃষ্টির দিনে ঘরে থাকাটাও কষ্টকর,তাই তিনি স্হানীয় ইউনিয় পরিষদ সদস্যের মাধ্যমে আবেদন করেন স্থানীয় প্রশাসনের কাছে ,যেন একটা মাথা গুজার ঠাঁই হয়।
এভাবে চলতে থাকে অনেকদিন। এদিকে ওনার স্ত্রীর শরীরে রোগ বাসা বাধা শুরু করে দিয়েছে,টাকার অভাবে ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না। বাজার থেকে দোকানীরদের কাছ থেকে কিছু টাকা উত্তোলন করে কয়েকদিন ওষুধ খেয়ে ভালোই ছিল কিন্তু একটা সময় দেখা গেলো ওনার শরীরের ডায়াবেটিকসহ আরো অনেক রোগ। একটা পায়ে পচন ধরে,কয়েকদিনের ব্যবধানে ডাক্তার বলেছিলো পা কেটে ফেলতে হবে। এমন পরিস্হিতিতে রহিমুদ্দিন নিরুপায় হয়ে ভিটের জায়গা থেকে একটা অংশ বিক্রি করে টাকাও জোগাড় করেছিল স্ত্রীর চিকিৎসার খরচের জন্য।
রহিমুদ্দিনের স্ত্রী স্বপ্ন দেখা শুরু করছিল নতুন ঘরে আরাম করে থাকবে কিন্তু ইউপি সদস্য আজকে দিবে ,কালকে দিবে করে দুই বছর পার করেছেন।
একটা মজার তথ্য দিচ্ছি,এই দুইবছরের ব্যবধানে ইউপি সদস্যের বাড়িতেও একটি সরকারি দানকৃত ঘর দেখা গেছে। শুধু ইউপি সদস্য না সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের বাড়িতে একটি সরকারি ঘরের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে। রহিমুদ্দিনের মতো আরো অনেককে পণ্য করে এই স্হানীয় কর্তাব্যক্তিরা আজ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।
রহিমুদ্দিনের স্ত্রীর মতো এমন অনেক গৃহহীন মানুষই আশায় বসে আছে একটি স্বপ্নের কুটিরের জন্য। কিন্তু তাঁদের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়। কোনোদিন বাস্তবে রুপান্তরিত হয় না। রাঘববোয়ালদের রক্তচক্ষু এড়াতে পারে না এই নিরীহ মানুষগুলোর স্বপ্নকে।
দিনশেষে রহিমুদ্দিনের স্ত্রী রোগের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারেনি,মৃত্যুর কাছে পরাজিত হতে হয়। মৃত্যুর পর একটা নতুন কুটির পেয়েছে বটে কিন্তু সেটা সরকার কতৃক গৃহ না,মাটির তৈরি সুন্দর একটা গৃহ। যেখানে কোনো আলো,বাতাসের ব্যবস্হা নাই। আবার গৃহহীনের তকমা নিয়েই স্বার্থপর পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছেন। হয়ত কোনো একদিন রহিমুদ্দিন একটা ঘর পাবে কিন্তু আদরের স্ত্রীকে পাশে নিয়ে আরামের ঘুমটা আর ঘুমাতে পারবে না।
স্থানীয় এইরকম প্রহসনের স্বীকার এমন হাজারো রহিমুদ্দিন। তাঁদের দেখার কেউ নাই,তাঁদের জবানে পেরেক দেয়া। হাজারো কষ্টের মাঝে নীরবে সহ্য করে নিষ্ঠুর পৃথিবীকে বিদায় জানায়। মুখ ফুটে কিছু বললেও মৃত্যুভয় তাদেরঁ রাতের ঘুম নষ্ট করে দেয়।
উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের নিকট বিনীত নিবেদন,খেটে-খাওয়া ,গরিব,গৃহহীন মানুষের জন্য যদি সরকার কোনো কিছু নির্ধারণ করে দেন যেন সরাসরি তাদের কাছে পৌছানোর ব্যবস্হা করেন। এমনটা হলে হয়ত রহিমুদ্দিনের স্ত্রীর মতো নতুন গৃহে শান্তিতে ঘুমানোর স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হবে না।
লেখক,কামাল হোসেন
আইন বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ,বাংলাদেশ।
মেইল: hossenk919@gmail.com