মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ গত ০৯ মে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ তারিখে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। মামলার বিচার, বিচারিক অনুসন্ধান, দরখাস্ত বা আপিল শুনানি, সাক্ষ্য গ্রহণ, যুক্তিতর্ক গ্রহণ, আদেশ বা রায় প্রদানকালে পক্ষগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদান করে অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি। কানাডা, ভারতসহ উন্নত দেশগুলোয় ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স গ্রহণের বিষয় বিশদ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং আদালতের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি ই-জুডিসিয়ারি ও ডিজিটাল এজলাস ও কোর্ট স্থাপন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে আমরাও বিচার বিভাগে ডিজিটাল এভিডেন্স গ্রহণে গৃহীত পদক্ষেপকে গুনগত পরিবর্তন বলে আশাবাদী হতে পারি।
করোনা মহামারিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও আদালতে ভার্চুয়াল মাধ্যমে “অতীব জরুরী বিষয়ে” বিচার কাজ চালু হয়েছে। যেটি শুধু বিচার বিভাগের জন্য নয়, বরং সারা দেশের বিচার প্রার্থী জনগণের আশা আকাঙ্খার জায়গায় নতুন দিগন্তের শুভসূচনা করেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে তাহলে কি আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ অনুযায়ী অডিও-ভিডিও ফুটেজ সাক্ষ্য হিসাবে আইনে অন্তর্ভূক্ত হলো কিনা। এক কথায় উত্তর হল সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ধারা-৩ সংশোধনের মাধ্যমে অডিও-ভিডিও ফুটেজ কে সাক্ষ্য আইনে অন্তর্ভূক্ত করার পথে আমরা এগিয়ে থাকলাম। যতদূর জানা যায় অডিও-ভিডিও সাক্ষ্যকে তথা ডিজিটাল এভিডেন্সকে আইনে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে একটি খসড়া আইন ইতোমধ্যে প্রণীত হয়েছে যা শীঘ্রই আইনে রুপলাভ করবে বলে আশাবাদী।
বাংলাদেশে ডিজিটাল বা অডিও-ভিডিও সাক্ষ্যের সাক্ষ্যগত মূল্য নির্ধারণে এখনও সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন হয়নি। তারপরেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮, নিরাপদ সড়ক আইন ২০১৮, যৌতুক নিরোধ অঅইন ২০১৮ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন-২০১৮ এর মতো কিছু স্পেশাল আইন ইতোমধ্যে প্রণীত হয়েছে, যেখানে ডিজিটাল সাক্ষ্যের প্রভিশন রাখা হয়েছে, যা কিছুটা হলেও স্বস্তির। বহুল প্রচারিত ও প্রকাশিত খাদিজা হত্যা, বিশ্বজিত হত্যা এবং রিফাত হত্যাকাণ্ডের বিচারকালে বিচারক অডিও-ভিডিওকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে কি না তা গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্ন (Question of Law) হিসেবে দেখা দেয়। এই ধরনের নতুন সমস্যায় জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রিটেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অপরাধ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটনের সময় প্রত্যক্ষদর্শীর দ্বারা ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশ ও ভাইরাল হয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটনের অভিপ্রায় বা প্রচেষ্টার অডিও-রেকর্ড একইভাবে প্রকাশ ও ভাইরাল হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত কোন না কোন ঘটনা ভাইরাল হচ্ছে। এসব ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করলে অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করতে বেগ পেতে হয় না বলে জনমনে ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে। এসব ইলেকট্রনিক রেকর্ড আদালতে অন্যতম নির্ভরযোগ্য দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহারের আইনের প্রায়োগিক ও প্রক্রিয়াগত সুযোগ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে।
বর্তমানে আলোচিত এই ডিজিটাল অডিও এবং ভিডিও ফুটেজ সম্ভাব্য সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে তাই কলম ধরতে হল। ডিজিটাল সাক্ষ্য হচ্ছে, সে সব সাক্ষ্য যা ডাটা, ফটোগ্রাফ, অডিও, ভিডিও, ডিভিডি, মেমরি কার্ড, হার্ডডিস্ক, ই-মেইল, টেলিগ্রাম, টেলেস্ক, চিপস ইত্যাদি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে সংরক্ষিত থাকে। বাংলাদেশে বিদ্যমান ফৌজদারি পদ্ধতিগত আইন যেমন- ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC) ১৮৯৮, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ সমূহ ডিজিটাল সাক্ষ্য ব্যবহার নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি বাতলে দেয়নি। তবে সেখানে বিচারিক ব্যাখ্যার (জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রিটেশন) অবাধ সুযোগ রেখেছে।
দেশের বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা পরিচালিত ট্রাইব্যুনাল ও আদালতে সাক্ষ্য ব্যবহারের রুলস এবং পদ্ধতি বিষয়ে আমাদের দেশে রয়েছে ১৮৭২ সালের Evidence Act. এখানে মূলত দুই ধরনের অ্যাভিডেন্সের বিধান আছে। প্রথমত, Oral Evidence (মৌখিক সাক্ষ্য) অর্থাৎ সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হয়ে যা কিছু বর্ণনা করেন, দ্বিতীয়ত, ডকুমেন্টারি অ্যাভিডেন্স অর্থাৎ আদালতের পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের জন্য যেসব ডকুমেন্ট উপস্থাপন করা হয়।
এই আইনের ধারা-৩ এ ডকুমেন্ট হিসেবে পাঁচটি উদাহরণ উল্লেখ আছে। তাতে এখনকার এসব ডিজিটাল ক্যামেরা, মোবাইলে ধারণকৃত অডিও বা ভিডিও বা অডিও ভিজুয়াল রেকর্ড নেই। থাকার কথাও নয়। ১৮৭০ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত স্যার জেমস ফিটজ, জেমস স্টিফেনসহ আইনবিদরা যখন সাক্ষ্য আইনটির খসড়া করেছিলেন, তখন এ জাতীয় অডিও-ভিডিও রেকর্ড যে ১০০ বা ২০০ বছর পরে কখনও আসতে পারে সে রকম দূরদর্শী হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বা ছিল না। তাই বলে তারা একেবারে অদূরদর্শী ছিলেন সে কথা বললে অত্যুক্তি হবে।
কেননা ডকুমেন্টের সংজ্ঞাটি খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যায়, তাদের ড্রাফটিং অনুযায়ী ডকুমেন্ট হলো স্মারক হিসেবে ধরে রাখার জন্য কোনো অক্ষর, সংখ্যা, চিত্র, চিহ্ন, সংকেত। এক কথায় যে কোনো রকম আঁকিবুকির মাধ্যমে কোনো বস্তু বা পদার্থে ফুটিয়ে তোলা কোন জিনিসপত্র। ‘Document” means any matter expressed or described upon any substance by means of letters, figures or marks, or by more than one of those means, intended to be used, or which may be used, for the purpose of recording that matter’ এসব অক্ষর, সংখ্যা, চিত্র, চিহ্ন, সংকেতের আঁকিবুকি (letters, figures or marks, or by more than one of those means) কলম দিয়ে, না রঙতুলি দিয়ে, না হাতুড়ি বাটল দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে তা নির্দিষ্ট নয়। (ধারা-৩) এক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হলে এই আইনের তো কোন আপত্তি দেখি না। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের হার্ডডিস্ক, মেমোরি বা চিপে ধরে রাখা ভিডিও বা অডিও ভিজুয়াল রেকর্ডে ১৮৭২ সালের অ্যাভিডেন্স অ্যাক্টের সংজ্ঞায়িত ডকুমেন্টের সব উপাদানই দেখা যায়। ধারা-৩ এর ৫ টি উদাহরণই শেষ কথা হতে পারে না। জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট-এর ধারা-৩(১৬) এবং পেনাল কোডের ধারা-২৯ এ ডিজিটাল সাক্ষ্য আমলে নিতে বৃহৎ অর্থে বিচারককে সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
ফেনীতে নুসরাত হত্যা, বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাসহ সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষ কোন সাক্ষী খুঁজে পাওয়া না গেলেও সিসি ক্যামেরা ফুটেজ এবং মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও, ভাইরাল হওয়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন মামলায় প্রমাণের বিষয়বস্তু হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ কারণে বর্তমানে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনে সাক্ষ্য হিসেবে ইলেকট্রিক ডিভাইসের সাক্ষ্যগত মূল্য অ্যাভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা-০৩ এ আলোচিত ৫টি ডকুমেন্টের উদাহরণের মধ্যে উল্লেখ না থাকায় বিচারপ্রার্থী পক্ষ তথা ভিক্টিম ও তার পরিবার ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া সাধারণ আইনে ভিডিও ফুটেজ সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার নিয়ে মতানৈক্য লক্ষণীয়। এ কারণে ডিজিটাল সাক্ষ্যকে প্রমাণাদির বিষয়বস্তু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করণার্থে আইন সংশোধন করে অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট যুগোপযোগী করতে হবে। স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল সমূহের জন্য (যেমন- সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল), দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন, আইসিটি আইন ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ভিডিও ফুটেজ ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও সাধারণ আইনে নেই।
তবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যত মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, তার মধ্যে বিশ্বজিত হত্যাসহ চারটি মামলায় ভিডিও ফুটেজকে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহারের নজির পাওয়া যায়। “Judicial Interpretation” may play a vital role in regard to admissibility of digital evidence. প্রচলিত পদ্ধতি হল মামলার তদন্তের সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা (IO) ভিডিও ফুটেজ জব্দ করে ফুটেজ প্রস্তুতকারককে সাক্ষী হিসেবে মান্য করে অভিযোগপত্র বা চার্জশিটের (CS) সাথে ভিডিও ফুটেজ জমা দেবেন এবং বিজ্ঞ বিচারিক আদালত বিচার ফাইলে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে ফুটেজ প্রস্তুতকারককে সাক্ষী হিসেবে পরীক্ষা করে ফুটেজ প্রদর্শনী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন। তবে প্রস্তুতকারককে সাক্ষী হিসেবে পাওয়া না গেলে কিংবা ফুটেজের অথেনটিকেশন নিয়ে প্রশ্ন আসলে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত Criminal Investigation Department (CID) এর ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ মতামত (Expert Opinion) তলব করতে পারেন। কোন বিপরীতধর্মী (contradictory evidence) পাওয়া না গেলে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত সংশ্লিষ্ট ফুটেজকে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় নিতে পারেন। তাই প্রচলিত সাধারণ আইনে ভিডিও ফুটেজকে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করতে আইনে কোনো বাঁধা নেই।
বিশ্বজিত হত্যা মামলায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয়, যে ভিডিও ফুটেজ অফিসিয়ালি জব্দকৃত আলামত হিসেবে তদন্তকারী অফিসারের নিকটে হস্তান্তর করা হয়, সেটিকে আদালত স্বপ্রণোদিতভাবে নির্ভরযোগ্য হিসেবে ধরে নিতে (legal presumption) পারে, যদি বিচারের সময় সেই সব সাক্ষ্য অন্যান্য মৌখিক সাক্ষ্যের সাথে বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে মিলে যায়। সে ক্ষেত্রে বিচারকের জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রিটেশনে ডিজিটাল সাক্ষ্য আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে “ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কৌশলগত দিক” বিবেচনায় নিতে হয়। উচ্চ আদালত বিভিন্ন রায়ের সিদ্ধান্তে ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়ে আলোকপাত করেছেন, যেমন- ৩৭ ডিএলআর ২৭৫ পৃষ্ঠা, ৬৮ ডিএল আর (এডি) ৩৭৩ পৃষ্ঠা এবং ৭০ ডিএলআর (এডি) ২৬। উক্ত কেসসমূহে আদালত বলেছেন আইন হতে হবে মানুষের কল্যাণে এবং আইন কখনও কঠিন হতে পারে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের এসব সিদ্ধান্ত সকল তদন্ত কর্মকর্তা, আইনজীবী, বিচারকের তাৎক্ষণিক অবগতিতে থাকে না। এটি হল বিচারিক নজিরের (Judicial Precedent) প্রধান অসুবিধা। আমাদের দেশে ১৯৮৫ সালে (৩৭ ডিএলআর ২৭৫ পৃষ্ঠায়) হাইকোর্ট বিভাগ সে সময়ের ভিডিও ক্যাসেট ডক্যুমেন্টারি অ্যাভিডেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। তারও আগে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট AIR 1964 SC 72 পৃষ্ঠায়, AIR 1968 SC 147 পৃষ্ঠায় এবং পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট PLD 1976 SC 57 পৃষ্ঠায় টেপ রেকর্ডকে ডক্যুমেন্টারি অ্যাভিডেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলেছেন।
কিন্তু পরবর্তীকালে এসব সিদ্ধান্ত কাজে লাগাবার নজির খুব একটা পাওয়া যায়নি। তাই সংশ্লিষ্ট আইনে ডিজিটাল এভিডেন্সের সুস্পষ্ট বিধান থাকা কাম্য। সাক্ষ্য আইনের ধারা-৪৫ এ বিশেষজ্ঞ মতামতের ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে। তাছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (CrPC) এর ধারা ১৬৫ এবং ১৬১-এ তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মামলার প্রয়োজনে নথিতে যে কোনো সাক্ষ্য সংযুক্ত করার ক্ষমতা দিয়েছে। তবে সেটি উপযুক্ত ব্যক্তি বা মাধ্যম দ্বারা প্রমাণ করার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দালিলিক আর মৌখিক সাক্ষ্যের বাইরে আরেক ধরনের সাক্ষ্যও বিচারকাজে হরহামেশাই ব্যবহার হয়, যেটাকে বলা হয় বস্তুগত বা বাস্তব সাক্ষ্য (Material or Real Evidence), আমাদের আদালত ও ট্রাইব্যুনাল অঙ্গনে যা আলামত নামে অত্যধিক পরিচিত। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৫ ধারার বিধান অনুযায়ী তদন্ত কর্মকর্মতা অপরাধ সংশ্লিষ্ট যে কোনো আলামত জব্দ করতে পারেন। আর ১৮৭২ সালের অ্যাভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ৬০ এর ২ নং শর্তাংশের বিধান ও ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারের (CRO) ১৬১ বিধি অনুযায়ী আদালতে বিচারের সময় আলামত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কাজেই অপরাধকাণ্ড সংশ্লিষ্ট ইলেক্ট্রনিক অডিও বা ভিডিও বা অডিও ভিজ্যুয়াল রেকর্ড আলামত হিসেবে গ্রহণ না করারও কোনো যুক্তি দেখি না।
আমাদের দেশে সম্প্রতি আদালতে “তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০”, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ প্রণীত হয়েছে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর ২ (ঘ) এ ‘‘পর্নোগ্রাফি সরঞ্জাম’’ অর্থ পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, ধারণ বা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ক্যামেরা, কম্পিউটার বা কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি, অপটিক্যাল ডিভাইস, ম্যাগনেটিক ডিভাইস, মোবাইল ফোন বা উহার যন্ত্রাংশ এবং যে কোনো ইলেক্ট্রনিক, ডিজিটাল বা অন্য কোন প্রযুক্তিভিত্তিক ডিভাইস বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ৩০ ধারায় অডিও ভিস্যুয়াল যন্ত্র বা কোন ইলেকট্রনিক যোগাযোগের মাধ্যমে ধারণকৃত সাক্ষ্য প্রমাণ ট্রাইব্যুনালের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য বা স্বীকৃত হইবে বলে উল্লেখ আছে। একই সাথে অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট, পেনাল কোড, ব্যাংকার্স বুকস অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট ইত্যাদি আইনে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্সের বিধান সংযোজিত পূর্বক যুগোপযোগী করে নেয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা হয়নি। তারপরেও দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক সাক্ষ্য প্রমাণাদি গ্রহণযোগ্যতা ও গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করা জন্য আমাদের আইনগুলোর সংশোধন এখনই প্রয়োজন।
এগুলোর পাশাপাশি নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আইনে সংযোজন করা সময়ের দাবি- ১) যেসব সাক্ষী বিদেশে আছেন, বা আদালত থেকে অনেক দূরত্বে অবস্থান করছেন, ভিডিওর মাধ্যমে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণের বিধান করা যেতে পারে। ২) আইনজীবী কর্তৃক মামলার শুনানী বা হিয়ারিংগুলোও অনলাইনে হতে পারে। আইনজীবী আদালত রুমে উপস্থিত না হয়েই যেন শুনানিতে অংশ নিতে পারেন। ৩) আবার, প্রত্যেক আদালতের একটা করে ওয়েবসাইট (Website) বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেজ (Social Media/Facebook Page) থাকতে পারে। সেখানে মামলার সিরিয়াল, কোন মামলা কোন পর্যায়ে আছে, শুনানির তারিখ ইত্যাদি আপডেট ঘরে বসে সবাই দেখতে পাবে।
আমরা আশাবাদী আদালতে ‘’তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০’’ এর সাথে সমন্বয় করে অন্যান্য আইন সংশোধন করে ইলেক্ট্রনিক সাক্ষ্য গ্রহণে যে প্রতিবন্ধকতা ছিল বা আছে তা শীঘ্রই দূর হবে। অচিরেই ডিজিটাল বাংলাদেশের বিচার বিভাগ গতিশীল ও আধুনিক হবে।
লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, কলামিস্ট ও আইন বিশ্লেষক এবং বিচারক, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস।