করোনা ভাইরাসের এই সংকটকালিন মুহূর্তে একটা শব্দ ব্যাপক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পরেছে,আর সেই শব্দটার নাম ‘ভালবাসা! করোনা মহামারির আগে ভালবাসা শব্দটা যেন অতি সাধারণ একটা কথা ছিল। পথে, ঘাটে, হাটে, মাঠে,ক্যাম্পাসে,কপোত কপোতির চোখে- মুখে, স্বামী- স্ত্রীর গল্পের আসরে, বন্ধুদের আড্ডায়, বেলা শেষে কাজ থেকে ফিরে আসা বাবার আদরে,মায়ের আদর- যত্নে সব জায়গায় যেন ভালবাসা, মায়া, মমতার ছড়াছড়ি ছিল বলে আমরা দেখতে পেতাম। আমরা সবাই বিশ্বাস করতাম আমাদের প্রিয়জন, কাছের মানুষগুলো আমাদেরকে অনেক অনেক ভালবাসে।কিন্তু মজার বিষয় হলো ভালবাসার এই ব্যাপারটি কখনো এতো পরিক্ষিত ছিল না৷ আমাদের কাছে। কিন্তু এখন করোনা মহামারির এই চরম বাস্তবতার মুহূর্তে এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে ভালবাসা শব্দটা এই পৃথিবীতে আছে কিন্তু ভালবাসা শব্দের ভিতরের যে জিনিস থাকা প্রয়োজন সেটা নেই। এবার হয়তো আপনি ভাবনায় পড়ে গেলেন, এটা আবার কেমন কথা যে ভালবাসা শব্দটাতে ভালবাসা নেই??
বিষয়টা আপনি এভাবে বুঝে নিতে পারেন, ধরুন আপনার একটা গাছে অনেকগুলো ডাব/নারকেল আছে। আপনি দূর থেকে দেখছেন আর ভাবছেন নিশ্চয়ই ওর মাঝে পানি আছে। আর আপনি এটা ভেবে আনান্দ ও পাচ্ছেন যে পানি আছে ডাবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন গাছ থেকে পেড়ে, ডাবগুলো কেটে দেখলেন একটাতেও পানি নেই। সবগুলোই নষ্ট হয়ে আছে। ঠিক এই জিনিসটায় এতোক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আশা করি এখন ক্লিয়ার হয়েছেন।
এখন আসা যাক ভালবাসা শব্দটি কি কি পরীক্ষা দিয়েছে এবং কিভাবে আমরা ভালবাসার বিপর্যয় লক্ষ্য করেছি?
ঢাকা থেকে মা- বাবা, দুই ছেলে বাসায় যাওয়ার পথে যখন দেখতে পেল, মায়ের মাঝে করোনা উপসর্গ, মহিলাটির স্বামী ও তার ছেলেরা তাকে ফেলে গেল একটি জঙ্গলে । অথচ একটা সময় সংসারে মহিলাটির কতো অবদান ছিল!
কুমিল্লাতে একজন লোক যে তেলপাম্পে কাজ করেতেন, সেদিন হঠাৎ জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরলেন। বউ ও ছেলে- মেয়ে রা বুঝে গেলেন তিনি করোনায় আক্রান্ত। সাথে সাথে ঘরে ঢুকিয়ে বাহিরে থেকে তালা মেরে দিলেন।
ভেতর থেকে লোকটি চিৎকার, কান্নাকাটি করে পানি ও খাবার চেয়েছিল কয়েকবার। কোন সাড়া দেয়নি এপারের লোকজন। কিছুক্ষণ পর সব ঠান্ডা হয়ে গেল।।।
লোকটি মারা গেলেন। অথচ পরিবারের লোকদের জন্য লকডাউন উপেক্ষা করেও তিনি কাজে গিয়েছিলেন।
দেশের একজন নামকরা চিকিৎসক, একছেলে কানাডায় থাকেন অন্যজন সরকারি কর্মকর্তা। করোনায় যখন মারা গেলেন তিনি, ছেলে কানাডা থেকে ফোন করে বলে দিলেন বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করে দিতে, আর ছোটছেলে নিজে না এসে তার পিএস কে পাঠিয়েছিলেন সাক্ষী হিসেবে। যাদের কে বড় করতে দিন রাত পরিশ্রম, তারা আজ শেষ দেখাটুকু ও দেখতে এলো না!
এক দম্পতি করোনায় আক্রান্ত, তারা ২ জনই ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতো, গ্রামে গিয়ে জানতে পারলেন তারা করোনায় আক্রান্ত, গ্রামের লোকজন তাদের কে গ্রামের শেষ সীমানায় একটি পরিত্যক্ত গোয়াল ঘরে থাকতে দিয়েছে। কেউ দূর থেকেও দেখতে আসেনি এমন কি পরিবারের লোকজন ও না! অথচ গ্রামের সবাই তাকে একসময় অনেক ভালোবাসতো, ঈদে বেড়াতে আসলে বুকে টেনে নিত।
এগুলো উদাহরণ, এমন হাজার টা হৃদয় ভাঙ্গা গল্প আমাদের আশেপাশে জমে আছে।অনেকেই আমরা বিষয়গুলো নিজে অবলোকন করেছি কাছ থেকে।
এখন অনেকেই বলবে করোনার সময় এমন একটু তো হবেই। না হলে যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাবে তারাও!
তাদের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলতে চাই, একটু কাছে আসলে করোনা হয় কিন্তু একটু মানবিক হলেই করোনা হতো না তাদের। মরার সময় একটু পানি দিবেন না, ১০ হাত দুর থেকে মৃত বাবার মুখটা শেষবারের জন্য দেখতে আসবেন না,মাকে হসপিটালে না নিয়ে জঙ্গলে ফেলে দিবেন, এগুলোকে কিভাবে দেখবেন তাহলে?
আর একটি কথা সেই মৃত্যুকে ভালবাসা শ্রেয় যে মৃত্যুতে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও খুশি থাকেন। মৃত্যু আপনার নসিবে লেখা থাকলে আপনি লোহার সিন্দুকের ভিতরে থাকলেও আপনার মৃত্যু হবেই। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং পবিত্র কোরআনে কথাটির উল্লেখ করেছেন!
মূল বিষয় এই যে, আমাদের ভালবাসা, মায়া মমতা করোনার কাছে আজ পরাজিত হয়েছে অনেকাংশে । গবেষণায় এসেছে, একজন করোনা আক্রান্ত রোগী মানুসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লে তার জন্য সুস্থ হয়ে উঠা অনেক কঠিন। আমরা যদি একটু মানবিক হয়, যদি প্রিয় মানুষদের পাশে থেকে একটু সাহস জোগায় তাহলে কিন্তু করোনার মতো মহামারী আমরা রুখে দিতে সক্ষম হোব।আপনাদের কাছে অনুরোধ, প্রিয় মানুষটির অবদানের কথা ভুলে যাবেন না, শেষ নিঃশ্বাস অবধি তার পাশে থেকে তার সাথে মানবিক আচরণ করুন, তাতে তার মৃত্যু হলেও একটু শান্তি নিয়ে সে মরতে পারবে। পরিশেষে, হুমায়ুন আহম্মেদ স্যারের লেখা একটি কথা বলে শেষ করছি, ” রোগ কে ঘৃণা করুন, রুগীকে কেন?”
নাঈমুর রহমান নাঈম
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যাল, কুষ্টিয়া