মা ও এসএসসি পরীক্ষার্থী একমাত্র ছোট ভাইকে নিয়ে সাজানো সংসার ছিল ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার। শুক্রবার রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের এই শিক্ষার্থী কুমিল্লা নগরীর বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করার পর সেই পরিবারে এখন শোকের ছায়া। কান্না থামছে না মা তাহমিনা শবনমের। সকালে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তিনজন শিক্ষকের নেতৃত্বে ৩৫ জন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের বাসে কুমিল্লায় আসেন। মা শবনম আহাজারি করে বলেন, কোথাও বিচার পায়নি আমার মেয়ে। কারণে-অকারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২০২২ সাল থেকে আমার মেয়ের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। মেয়ে আমার বিচারক হতে চেয়েছিল, ওরা বাঁচতে দিলো না।
তিনি বলেন, জবি প্রশাসনের ডাকে আমি অসুস্থ স্বামী নিয়ে একাধিকবার প্রশাসনের কাছে গিয়েছিলাম, বিচার তো পাইনি উল্টো তারা (জবি প্রশাসন) আমাদের আরও মানসিকভাবে হয়রানি করেছে। কখনও থানায় জিডি ও মামলার হুমকি দেওয়া হতো মেয়েকে। তিনি বলেন, তার মেয়েকে সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছিল, এতে সে সাড়া দেয়নি। বিষয়টি সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে জানিয়ে উল্টো ফল হয়। দ্বীন ইসলাম মেয়েকে নানাভাবে হয়রানি ও কটূক্তি করতো।
তাহমিনা শবনম বলেন, ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল রোজার সময় অধ্যাপক স্বামীকে হারালাম। কাল মেয়েকে হারালাম। কিন্তু ওরা আমার মেয়েকে বাঁচতে দিলো না। আমার মেয়ে সাহসী ছিল। তার বিমান বাহিনীতে চাকরি হয়েছিল, পায়ে ব্যথার কারণে নিয়ে আসি। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় সে ভালো ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিচার না পেয়ে মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
মেয়ের মৃত্যুর জন্য তিনি সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ছাড়াও পুরো জবি প্রশাসন দায়ী করেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তারা কেন এক বছর ধরে বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখে আমার মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলো।
মেয়ের আত্মহত্যার শেষ সময়ের কথা জানিয়ে মা শবনম বলেন, শুক্রবার ইফতারের আগে ও পরে মেয়েকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল, একসঙ্গে ইফতারও খাই। রাত সাড়ে ৯টার দিকে পাশের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। সে প্রায়ই দরজা বন্ধ করে রাখতো। কিছুক্ষণ পর ওর রুমে ফ্যানের শব্দ না পেয়ে ডাকাডাকি করি। কোনো সাড়া মেলেনি। পরে ছেলেকে বাসার নিচে পাঠাই, দারোয়ানকে নিয়ে মই দিয়ে পূর্ব পাশের জানালা খুলে দেখতে পাই, ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে মেয়ে। এরপর পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা পুলিশের একজন সদস্যসহ আমরা ওর নিথর দেহ নামাই। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
অবন্তিকার একমাত্র ভাই জাবিদ জাওয়াদ অপুর্ব বলেন, ‘আপুু ঢাকা থেকে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব বিষয় সবার সঙ্গে শেয়ার করতেন। আপুর মরদেহ বিকাল ৩টার দিকে শাহসগাছা এলাকায় দাফন করা হবে। বাবা-মা শিক্ষক ছিলেন, তাই তারা চাইতেন বিষয়টি সহজেই সমাধান হোক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো সহায়তা না করায় আমার বোনকে মরণের দিকে যেতে হয়েছে।’
অবন্তিকার বাবা জামাল উদ্দিন মৃত্যুর আগে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ ও কুমিল্লা সরকারি কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল রোজার সময় তিনি মারা যান। জামাল উদ্দিনকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সরকারি কলেজ ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের সময় কুপিয়ে জখম করা হয়। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা শহরের শাসনগাছা মহাজন বাড়ি এলাকায়। অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম কুমিল্লা পুলিশ লাইনস উচ্চবিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি উপস্থাপনা করতেন।
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি ফিরোজ দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত অবন্তিকার বাসায় ছিলেন। এ সময় তিনি পরিবার, সহপাঠী ও শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন, বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত হয়েছে। মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলার বিষয়ে কথা হচ্ছে। রাতের মধ্যেই পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতে বলা হয়েছে।
অবন্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ছিলেন। শুক্রবার রাতে কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাও এলাকার নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে অবন্তিকা তার ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে আম্মান সিদ্দিকী নামের তার এক সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি যদি কখনও সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। আম্মান যে আমাকে অফলাইন অনলাইনে থ্রেটের ওপর রাখতো সে বিষয়ে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেও আমার লাভ হয় নাই। দ্বীন ইসলাম আমাকে নানানভাবে ভয় দেখায় আম্মানের হয়ে যে, আমাকে বহিষ্কার করা ওনার জন্য হাতের ময়লার মতো ব্যাপার। আমি জানি এখানে কোনো জাস্টিস পাব না।’
কুমিল্লার এই বাসায় আত্মহত্যা করেন অবন্তিকা
কুমিল্লার এই বাসায় আত্মহত্যা করেন অবন্তিকা
অবন্তিকা আরও লিখেছেন ‘আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইছিলাম! আর পোস্টমর্টেম করে আমার পরিবারকে ঝামেলায় ফেলবেন না। এমনিতেই বাবা এক বছর হয় নাই মারা গেছেন, আমার মা একা। ওনাকে বিব্রত করবেন না। এটা সুইসাইড না এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার। আর আম্মান নামক আমার ক্লাসমেট ইভটিজার আমাকে এটাই বলছিল যে, আমার জীবনের এমন অবস্থা করবে যাতে আমি মরা ছাড়া কোনো গতি না পাই। তাও আমি ফাইট করার চেষ্টা করছি। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সহ্য ক্ষমতার।’