মোঃ আবু সুফিয়ান, বিসিএস কর্মকর্তা
বলছি সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের আমাদের জুনিয়র মো: আয়ুব আলী’র কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ সেশন সূর্যসেন হলের এর ছাত্র সে। আমার গ্রামের অত্যন্ত দরিদ্র দীনমুজুর (ভ্যান চালাত) বাবার চতুর্থ সন্তান। আমরা যখন ছাত্র ওর বাবা আমাদের খুব আদর করে সম্মান দিয়ে ভ্যানে চড়াত। প্রথমে বুঝতাম না, পরে বুঝতে পেরেছিলাম বক্কার চাচার স্বপ্ন তার আয়ুব যেহেতু লেখাপড়ায় ভাল সেও একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে! ভয়ে ভয়ে থাকতেন আর খোঁজ খবর নিতেন।
এই ধর, কেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পড়লে কি হয়, খুব কঠিন কিনা, সম্মান কেমন ইত্যাদি প্রশ্ন করতেন ভ্যানে বসিয়ে। নামার সময় সেকি আকুতি! না ,ভ্যান ভাড়া নিবে না। বলতেন আমার আয়ুবের জন্য দোয়া কইর সে য্যান তোমাদের মত! বক্কর চাচার সেই আকুতি, সহজসরল জীবনযাপন আর দরিদ্র ঘরের তাড়না অনুভব করে খোজখবর নিতাম আয়ুবের। একদিন শুনলাম সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে! আরে! সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে!! আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। এরই মধ্যে শুনলাম শরীর নিয়মিত খারাপ থাকায় লেখাপড়া ভাল করতে পারছে না।
অনেক কষ্টে চিকিৎসা আর লেখাপড়ার খরচ যোগাতে বক্কর চাচা প্রায় হিমসিম খাচ্ছেন শুনে পাশে থাকার তাড়না থেকেই আয়ুবের সাহায্য করতে থাকলাম। অনেক বড় সংসার ওদের। বোনের বিয়ে হয়েছে, তারাও ভাল নেই। এসন সাংসারিক চাপে বক্কর চাচাও দুরারোগ্য রোগে অসুস্থ হলেন আর চলে গেলেন ইহকালের মায়া বিসর্জন দিয়ে। আয়ুবের বড় ভাই যশোর বিবেল কলেজ থেকে মাস্টার্স করে চাকুরির জন্য আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। চলে গেল মালয়েশিয়ায় শ্রম দিতে! একমাস পরে বেতন, সেটাও ত কম সময় নয়! অনেক কষ্টে আয়ুব লেখাপড়া শেষ করলেন, বাবা নেই। মায়ের কষ্টের সংসারে বেকার আয়ুব বাড়তি যোগ করেছে টিবি রোগ। ভাল হয়, খারাপ হয়।
আয়ুব টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যায় গ্রামে থেকেই। ঢাকায় থাকার চেষ্টা করেও যে লাভ নেই। এত খরচ! শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আয়ুব একটা চাকুরী পেল!!সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক! মা খুশি, ভাই খুশি। খুশি পুরো পরিবার,পুরো গ্রাম! আশেপাশের গ্রামের সচেতন অনেক মানুষও আয়ুবের খোঁজ খবর নিতেন। এভাবে মাত্র কিছুদিন চল্ল হটাৎ খুব অসুস্থ!
বিগত কয়েকদিন আয়ুবের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়লে চেষ্টা করি সবাইকে ধরে বক্কর চাচার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে। গ্রামের সমবয়সী যারা আছে তাদেরকে বার বার তাগিদ দিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের বার বার তাগিদ, আই সি ইউ ইত্যাদি করেও। বক্কর চাচার ভ্যানের সেই ক্রিং ক্রিং আওয়াজ আজও শুনতে পাই। আজও শুনতে পাই আমার আয়ুবের জন্য দোয়া কইর! আয়ুব আমাদের মাফ করে দিও। বক্কর চাচা আমাদের মাফ করে দিও। দু:খের ঘরের সুখপাখি আয়ুব তুমি বাবাকে রাখতে পারনি, চেয়েছিলে তোমার মা সুখে থাকবে। তুমিও চলে গেলে? তোমার মা কি নিয়ে থাকবে?
রমজানের এই শুক্রবার ভোরে তোমার কথা মনে করে ভিতটা হু হু করে উঠছে বার বার।
বি দ্র: সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ ভোর সাড়ে চারটায় মৃত্যু হয় আয়ুবের। তার দু:খিনী মায়ের জন্য কিছু করতে চাই। পরামর্শ চাই শ্রদ্ধেয় স্যার /সহকর্মী।
নাম: মো: আয়ুব আলী
সহকারী শিক্ষক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
পিতা: মো: আবু বক্কর
ইলিশপুর, ৮ নং কেরালকাতা ইউনিয়ন
কলারোয়া সাতক্ষীরা।।