মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
প্রথমেই বলে রাখি এটা কোন মজার বিষয় বা সুখপাঠ্য না যে আপনার পড়তে খুবই ভালো লাগবে। তবে জেনে রাখতে পড়ে দেখতে পারেন। মহান জাতীয় সংসদে ১১ জুন ২০২০-২০২১ সালের সাধারণ বাজেট পাশ হয়েছে। একটা দেশের বাজেট হয় জানি কিন্তু কোন কোন আইন অনুযায়ী এই বাজেট পাশ হয় তা অনেকেই জানিনা। সাধারণত পাঠ্য বইয়ে প্রাথমিকভাবে বাজেট আইন নিয়ে তেমন পড়াশোনা আইনের ছাত্ররা করে না। করলেও প্রয়োজন পড়ে না বলে মনে রাখে না। যদিও নিতান্তই ঠেকে না গেলে কেউ আইন বিষয়ে পড়তে চাই না।বাজেট সম্পর্কিত আইন গুলো ভালোভাবে জেনে রাখা ভালো। আসুন জেনে নিই।
বাজেট ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত আইন হলো সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯ বাজেট এর সাংবিধানিক নামঃ বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি (Annual financial statement) অনুচ্ছেদ ৮৭। বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ীঃ “বার্ষিক বাজেট” ধারা ২(১৬)] – সংবিধানের ৮৭ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি; এবং সংবিধানের ৮৯ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত মঞ্জুরী দাবীসহ অন্যান্য বাজেট দলিলও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে। জাতীয় বাজেট হলো সাধারণ নাম এবং উহা কার্যকরী হয় অর্থ বৎসর থেকে। “অর্থ বৎসর” অর্থ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের উল্লিখিত অর্থ বৎসর; অর্থাৎ, ১ জুলাই ২০২০ থেকে ৩০ জুন, ২০২১ পর্যন্ত।
সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯ এর প্রাসঙ্গিক/প্রয়োজনীয় ধারাসমুহ বাজেট- (ধারা ১০) ধারায় বলা হয়েছে যে, (১) অর্থ মন্ত্রী, প্রত্যেক অর্থ বৎসর আরম্ভ হইবার পূর্বে বার্ষিক বাজেট সংসদে পেশ করিবেন। (২) বার্ষিক বাজেটে দায়যুক্ত ব্যয় হইতে অন্যান্য ব্যয় পৃথকভাবে প্রদর্শন করিতে হইবে। (৩) বার্ষিক বাজেটে অন্যান্য ব্যয় হইতে রাজস্ব খাতের ব্যয় পৃথকভাবে প্রদর্শন করিতে হইবে। (৪) অর্থ মন্ত্রী বার্ষিক বাজেটের সঙ্গে একটি মধ্যমেয়াদি বাজেট সংসদে পেশ করিবেন এবং মধ্যমেয়াদি বাজেটে সরকারের আয় ও ব্যয়ের বাজেট-বৎসরের প্রাক্কলন ছাড়াও তদপরবর্তী দুই বৎসরের প্রক্ষেপন অন্তর্ভুক্ত থাকিবে। নিচের লিংকে আইনটি পাওয়া যাবে এক ক্লিকে http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-1021.html
সংশোধিত বাজেট (ধারা ১২) (১) অর্থ মন্ত্রী, প্রয়োজনে, প্রত্যেক অর্থ বৎসরে একটি সংশোধিত বাজেট সংসদে পেশ করিবেন। (২) সংশোধিত বাজেট, যথাসম্ভব, প্রত্যেক বৎসরের মার্চ মাসের মধ্যে পেশ করিতে হইবে। (৩) সংশোধিত বাজেট পেশ করিবার ক্ষেত্রে সংবিধানের ৮৭, ৮৮, ৮৯ ও ৯০ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী অনুসরণ করিতে হইবে এবং, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, সংবিধানের ৯১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একটি সম্পূরক আর্থিক বিবৃতি বা অতিরিক্ত আর্থিক বিবৃতিও সংসদে পেশ করিতে হইবে।
“বাজেট ঘাটতি” ধারা ২(১৫) সংযুক্ত তহবিলে ঋণ বাবদ প্রাপ্তি ব্যতীত মোট প্রাপ্তি অপেক্ষা উক্ত তহবিল হইতে ঋণের আসল বাবদ পরিশোধ ব্যতীত মোট পরিশোধ বেশী হইবার কারণে উদ্ভূত ঘাটতি;
“মধ্যমেয়াদি বাজেট” ধারা ২(১৮)সরকারের নীতি ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে বাজেট বরাদ্দের এবং বাজেট বরাদ্দের সঙ্গে কর্মকৃতির (Performance) যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা সম্বলিত তিন অর্থ বৎসর মেয়াদি বাজেট যাহাতে সরকারের আয় ও ব্যয়ের বাজেট বৎসরের প্রাক্কলন এবং তৎপরবর্তী দুই বৎসরের প্রক্ষেপণ অন্তর্ভুক্ত থাকিবে;
“রাজস্ব আয়” [ধারা ২(২০)— কর, লেভী বা শুল্ক অথবা এতদ্সম্পর্কিত অন্য কোন চার্জ এবং কর বহির্ভূত অন্যান্য খাত হইতে সংগৃহীত অর্থ যাহা সংযুক্ত তহবিলে জমা করিতে হইবে;
“সরকারি ঋণ” ধারা ২(২৫)— সরকার কর্তৃক অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃখাত হইতে গৃহীত ঋণ ও ঋণের স্থিতি “গ্যারান্টি” [ধারা ২(৭)
কোন স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অথবা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অভ্যন্তরীণ অথবা বহিঃউৎস হইতে গৃহীত ঋণের আসল ও সুদ এবং এতদ্সংক্রান্ত অন্য কোন চার্জ আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে পরিশোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অসমর্থ হইলে সরকার কতৃর্ক তাহা পরিশোধের নিশ্চয়তা প্রদান, এবং সরকার কর্তৃক প্রদত্ত কাউন্টার গ্যারান্টিও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে;
নীতি বিবৃতি (Policy Statement) (ধারা ১১) সরকার, প্রতি বৎসর বার্ষিক বাজেটের সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর একটি নীতি বিবৃতি সংসদে পেশ করিবে, যাহাতে নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকিবে- ক) অন্তর্নিহিত অনুমানসমূহের (underlying assumptions) বিশ্লেষণসহ অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি-সম্ভাবনার পর্যালোচনা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকসমূহের মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা; খ) সরকারের কৌশলগত অগ্রাধিকারসমূহ, আর্থিক নীতি (Fiscal Policy) অনুদানসহ (যদি প্রযোজ্য হয়) রাজস্ব আয়, ব্যয়, বাজেট ঘাটতি ও বাজেট ঘাটতির অর্থায়ন; গ) অভ্যন্তরীণ ও বহিঃউৎস হইতে ঋণ সংগ্রহ কৌশলের মূল্যায়ন, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃউৎস হইতে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা, পদ্ধতি ও মাধ্যম, বহিঃঋণের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় ঝুঁকি, সংস্থাসমূহের জন্য প্রদত্ত ঋণ বা গ্যারান্টির পরিমাণ এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য গ্যারান্টির পরিমাণ ইত্যাদি।
অর্থ বরাদ্দে সমতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ (ধারা ৪) সরকার, জনস্বার্থে, অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অধিকতর সমতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করিবে এবং উক্ত উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্টভাবে নিম্নবর্ণিত কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করিবেঃ-
ক) আঞ্চলিক সমতা নিশ্চিতকরণ; খ) নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিতকরণ; গ) দারিদ্র্য নিরসন সংক্রান্ত কার্যক্রমে ক্রমান্বয়ে অধিক অর্থ বরাদ্দ প্রদান; ঘ) সংস্থাসমূহকে অনুদান, ভর্তুকি, ঋণ ইক্যুইটি ইত্যাদি বাবদ প্রদত্ত অর্থ বাজেটে যথাসম্ভব সুস্পষ্টভাবে প্রদর্শন ; এবং ঙ) অর্থ বরাদ্দ ও ব্যবহার সংক্রান্ত তথ্যাদি সকল মন্ত্রণালয় বা বিভাগ কতৃর্ক তাহাদের ওয়েবসাইটে নিয়মিত প্রকাশ করা। সরকার যে সকল উদ্দেশ্য ঋণ সংগ্রহ ঋণ সংগ্রহ করিতে পারিবে [ধারা ২১(৩)] সরকার নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ঋণ সংগ্রহ করিতে পারিবে, যথা :-ক) বাজেট ঘাটতির অর্থায়ন; খ) কোন প্রকল্প বা কর্মসূচী বাস্তবায়ন; গ) কোন সংস্থায় পুনঃলগ্নী; ঘ) পূর্বে গৃহীত ঋণের পরিশোধ অথবা মেয়াদ উত্তীর্ণের কারণে কোন ঋণের অর্থায়ন; এবং ঙ) সংসদ কতৃর্ক অনুমোদিত অন্য যে কোন উদ্দেশ্যে।
আর্থিক অসদাচরণ বিষয়টিও এই আইনে আছে এবং কিভাবে তা জানতে নিচের ধারাটি পড়ে নিন। আর্থিক অসদাচরণ ২৩। (১) কোন সরকারি কর্মকর্তা অথবা কর্মচারী এই আইনের অধীন তাহার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে- (ক) ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা অবহেলাজনিত কারণে ব্যর্থ হইলে, অথবা (খ) কোন অননুমোদিত বা অপচয়মূলক ব্যয় নির্বাহ বা ব্যয় নির্বাহের আদেশ প্রদান করিলে, অথবা কোন আর্থিক ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে ইহার যথার্থতা (bonafide) এবং সংশ্লিষ্ট আইন বিধি-বিধান যথাযথ অনুসরণ করা হইয়াছে কিনা তাহা নিশ্চিত করিতে ব্যর্থ হইলে তিনি আর্থিক অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে। (২) উপ-ধারা (১) এর অধীন আর্থিক অসদাচরণের জন্য অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য আইন বা প্রযোজ্য বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে।
বাজেট বিষয়ে যারা কাজ করেন তারা এসব আইন বিষয়ে জানেন। তাছাড়া আইনের ছাত্র-ছাত্রী, আইনজীবী এবং আইন সংশ্লিস্ট সকলের এই বিষয়গুলো জেনে রাখা ভালো।কেউ যদি এই সাবজেক্ট নিয়ে আগ্রহ না দেখায় তাহলে তার জানা হবে না। বাজেট বিষয়ে বিস্তারিত না হলেও সংক্ষেপে কেউ চাইলে লেখাটি পড়ে নিতে পারেন। মনে রাখলে ভালো যে এই ধরনের লেখা কোনদিন সুখপাঠ্য হয়ও না এবং হতে পারেও না। তবে জানার কোন শেষ নেই সেজন্য নিজে শিখতে ও জানতে এই লেখাটি। যদি কেউ লেখাটি পড়েন তাহলে আপনিও জানতে পারবেন।
লেখকঃ কলামিস্ট ও আইন বিশ্লেষক।