মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে দেশে একটি উপযুক্ত আইন রয়েছে। সংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ যেন নিজে বাঁচার পাশাপাশি অন্যকে সংক্রমিত না করতে পারে সে লক্ষ্যে আইনটি করা হয়। এই আইন অমান্য করলে শাস্তির বিধানও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সমস্যা হলো আইনটি সম্পর্কে জানে না অনেকেই। অধিকাংশ মানুষই এই আইন সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল না হওয়ায় মানার বিষয়েও তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এই আইনের ওপর সচেতনতা থাকলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই জন্য মানুষ যেন আইনটি সম্পর্কে জানতে পারে সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি বলেই তাদের অভিমত।
‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’ নামে বাংলাদেশেও দারুণ কার্যকরী আইন আছে। জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন লঙ্ঘন করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। এই আইন পড়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে আইনগতভাবে সক্ষম হবেন আইইডিসিআর এর মহাপরিচালক। বিদ্যমান আইনে সংক্রামক রোগের সিডিউলে COVID-19 এর নাম নেই, তবে সরকার চাইলে গেজেট করে যেকোনো রোগকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
করোনাভাইরাস আতঙ্ক চারিদিকে ছড়িয়ে। চীনের উহানে প্রথমে শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে। এতে প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। করোনাভাইরাস চলে এসেছে বাংলাদেশেও। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। বাংলাদেশের কি ধরণের আইনী সক্ষমতা আছে তা জানা ও মানা জরুরী।
এই আইনের আওতায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জরিমানা করেছে। এর মধ্যে গত ১৭ মার্চ হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ অমান্য করায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় এক অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসিকে ১৫০০০ টাকা জরিমানা, ঝিনাইদহে এক সিঙ্গাপুর প্রবাসীকে ৫০০০ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ১৮ মার্চ শরীয়তপুরে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার ১৪ দিন না যেতেই বাজারে ঘোরাঘুরি করায় ২ জন ইতালি ফেরত ব্যাক্তিকে ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে অধিক জনসংখ্যা হওয়ায় এবং আইন না মানার প্রবণতা থাকায় সঙ্গনিরোধ কতটুকু সফল হয় সেটি নিয়ে ও প্রশ্ন রয়েছে। তারপরেও সচেতন হতে হবে ব্যাক্তিকে। আইন মান্যকারী হতে হবে আগে।
করোনা সংক্রামক ব্যাধিতে আইন ভঙ্গ করলে যে সাজা ও দন্ড হতে পারে তা তুলে ধরবো:
সংক্রামক রোগ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য গোপনের অপরাধ ও দণ্ড
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ২৪ ধারা বলা হয়েছে :
২৪। (১) যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করেন বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অপর কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত ব্যক্তি বা স্থাপনার সংস্পর্শে আসিবার সময় সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি তাহার নিকট গোপন করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান ও নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপনের অপরাধ ও দণ্ড
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে :
২৫। (১) যদি কোনো ব্যক্তি-
(ক) মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তাহার উপর অর্পিত কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, এবং
(খ) সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন,
তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
ইচ্ছেকৃত মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদানের ধরণ ও সাজা
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ২৬ ধারায় বলা হয়েছে :
২৬। (১) যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদান করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ২ (দুই) মাস কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব ২৫ (পঁচিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
ফৌজদারি কার্যবিধির প্রয়োগে বিধিবিধান
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ২৭ ধারায় বলা হয়েছে :
২৭। এই আইনের অধীন সংঘটিত কোনো অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও আপিল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানাবলি প্রযোজ্য হইবে।
অপরাধের অ-আমলযোগ্যতা, জামিনযোগ্যতা ও আপসযোগ্যতা
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে :
২৮। এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য (Non-cognizable), জামিনযোগ্য (Bailable)এবং আপসযোগ্য (Compoundable) হইবে।
অসুবিধা দূরীকরণাথে করণীয়
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে :
৩১। এই আইনের কোনো বিধানের অস্পষ্টতার কারণে উহা কার্যকর করিবার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা দেখা দিলে, সরকার, এই আইনের অন্যান্য বিধানের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে, সরকারি গেজেটে প্রকাশিত আদেশ দ্বারা, উক্ত বিধানের স্পষ্টীকরণ বা ব্যাখ্যা প্রদানপূর্বক উক্ত বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করিতে পারিবে।
বিধি প্রণয়নের এখতিয়ার
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবেলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে :
৩২। এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বিধি প্রণয়ন করিতে পারিবে।
তফসিল সংশোধনের এখতিয়ার
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনে ৩৩ ধারায় বলা হয়েছে,
৩৩। এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, তফসিল সংশোধন করিতে পারিবে।
সামগ্রিকভাবে বলা যায় কেউ যদি সংক্রমণ ঘটায় বা গোপন করে তাহলে ৬ মাস কারাদণ্ড বা ১০০০০০/- (এক লক্ষ টাকা) পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড হতে পারে। কেউ যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আদেশ পালনে বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বা অসম্মতি জানায় তবে তার ৩ মাস কারাদণ্ড বা ৫০০০০/- (পঞ্চাশ হাজার টাকা) পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড হতে পারে। ইচ্ছেকৃত মিথ্যা বা ভুল তথ্য দিলে সেও ২ মাস কারাদণ্ড বা ২৫০০০/- (পঁচিশ হাজার টাকা) পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
লেখকঃ আইন বিশ্লেষক, গবেষক ও কলামিষ্ট, bdjdj1984du@gmail.com