মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
সড়কে চলাচল করতে শুধু নয় যে কোন পদক্ষেপে আপনাকে আমাকে আইন মেনে চলতে হয়। সভ্যতা নির্ণয়ে বা মাপকাঠি নির্ধারণে আইন মান্য করতে জনগণ কোন দেশে কতটুকু সজাগ তা জরিপে কঠোরভাবে দেখা হয়। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ ও এর ব্যতিক্রম নই। যত আইন বাংলাদেশে বলবৎ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে আইনটি লঙ্ঘন হয় তা হলো সড়কে চলাচলে ট্রাফিক আইন। একারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু মিছিল লেগেই আছে যা কোনভাবেই কমছে না। তাই জনসচেতনতা বাড়াতে এই ট্রাফিক আইনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও তা লঙ্ঘনে কি শাস্তি আছে তা তুলে ধরবো। সারাদেশে লকডাউন উঠে আবার রাস্তায় চলাচল ও যানবহন বেড়ে যাওয়ায় ট্রাফিক আইন মানাতে ও জানাতে এই লেখা। আশা করি সচেতনতা বাড়লে আইন মানার হার বেড়ে যাবে। আর সচেতনতা বাড়লে সড়কে দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু মিছিল কিছুটা হলে ও কমবে।
আমরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনা বলতে এখনও শুধু ঢাকা শহরকে কল্পনা করি। সেই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে এবং একটা রোডম্যাপ সারাদেশ নিয়ে করতে হবে। ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক–ব্যবস্থার উন্নয়ন, ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনসচেতনতা এবং ট্রাফিক শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে শুরু হয়েছে ট্রাফিক শৃঙ্খলা কার্যক্রম ট্রাফিক পক্ষ। শুধু ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করলে হবে না। সারা দেশ নিয়ে ভাবতে হবে। তাতেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভবপর হচ্ছে না। সারাদেশের হাইওয়ে গুলো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
সারা দেশে প্রাইভেট কার বা মোটরগাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনাও। মোটরগাড়ি চালানোর আইনকানুন না জানা কিংবা আইনকানুনকে তোয়াক্কা না করার প্রবণতাসহ কয়েকটি কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে মোটরগাড়ির জন্য প্রযোজ্য বিশেষ আইন আছে। আইন অমান্য করলে জরিমানা কিংবা মামলা হতে পারে। রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামার আগে জানতে হবে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিগুলো। Dhaka Metropolitan Police (ডিএমপি) এ বিষয়ে তাদের নিজস্ব অনলাইন নিউজ পোর্টাল ডিএমপি নিউজে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছে।সূত্রঃhttps://dmpnews.org/
ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলা একান্ত আবশ্যক। নিজের, পরিবারের এবং দেশের সবার জন্যই অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের সব ধরনের ট্রাফিক সমস্যার সমাধান দেয়া হয়েছে ১৯৮৩ সালে জারিকৃত মোটরযান আইনে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এই আইন বাস্তবায়ন ও তত্ত্বাবধান এর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত আইন লঙ্ঘনে কিকি শাস্তি আছে জেনে রাখা জরুরী। নিচে বহুল ব্যবহৃত ও গুরুত্বপূর্ণ ধারার লঙ্ঘনে কি সাজা বা জরিমানা তা ছকে তুলে ধরলাম।
ধারা | অপরাধ | জরিমানা |
ধারা ১৩৭ | কোন সাধারণ বিধান বা আইন লঙ্ঘন করলে | ২০০ টাকা। |
ধারা ১৩৮ | ডাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কোন মোটর যান চালালে | ৫০০ টাকা |
ধারা ১৩৯ | নিষিদ্ধ হর্ণ বা অন্যান্য শব্দ উৎপাদনকারী ডিভাইসের ব্যবহার করলে | ১০০ টাকা |
ধারা ১৪০ | আদেশ অমান্য, অবাধ্যতা ও তথ্য অস্বীকার করলে | ৫০০ টাকা |
ধারা ১৪২ | অত্যধিক গতিতে গাড়ি চালালে | ৩০০ টাকা |
ধারা ১৪৩ | বেপরোয়া বা বিপজ্জনকভাবে যান চালালে | ৫০০ টাকা |
ধারা ১৪৪ | বেপরোয়া বা বিপজ্জনকভাবে যান চালালে | ১০০০ টাকা |
ধারা ১৪৫ | নিষিদ্ধ হর্ণ বা অন্যান্য শব্দ উৎপাদনকারী ডিভাইসের ব্যবহারে | ৫০০ টাকা |
ধারা ১৫০ | অস্বাস্থ্যকর ধোঁয়া নির্গমকারী যান চালালে | ২০০ টাকা |
ধারা ১৫২ | রেজিস্ট্রেশন বা ফিটনেস পারমিট সার্টিফিকেট ছাড়া মোটর- যান ব্যবহার | ২০০০ টাকা |
ধারা ১৫৫ | অনুমোদনকৃত নয় এমন যান চালালে | ২০০০ টাকা |
ধারা ১৫৭ | পাবলিক রাস্তা এবং স্থানে মোটর যান দিয়ে কোন বাধা সৃষ্টি | ৫০০ টাকা |
তাছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হবার কারণ গুলো হলো এই যে, বা ড্রাইভারদের জন্য সতর্কতা বাণী- ১৯৮৩ সালে জারিকৃত মোটরযান আইনের ধারা ১৬৪ অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স হারানোর কারনগুলো হলঃ ১)লাল বাতি অমান্য করা ২)অনির্ধারিত স্থানে ওভার টেক করা ৩)নির্দেশিত গতি সীমার উপরে যান চলানো ৪)ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যান্য যান চলাচলের বাধা সৃষ্টি করা। ৫)বিপরীত দিকে যান চলানো
যানবাহন নিবন্ধন স্থগিত হবার কারণ সমূহ অনেক চালক জানেন না। একারণে সেগুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা জরুরী। যেমনঃ মোটরযান আইন এর ধারা ৪৩ অনুযায়ী কিছু পরিস্থিতির অধীন মোটর গাড়ি নিবন্ধন স্থগিত করার কথা বলা হয়েছে।যানের নিবন্ধন স্থগিত হবে যদিঃ কোন যান যদি পাবলিক স্থানে ব্যবহারের ফলে পাবলিক এর বিপদ ঘটায় অথবা টা যদি আইনের প্রয়োজনীয়তা মেনে চলতে ব্যর্থ হয়।
যান যদি বৈধ অনুমতি ছাড়া ভাড়া বা অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা হয়।
ড্রাইভারের বয়স সংক্রান্ত নির্দেশনা যা মানতে হবে। যেমন- ড্রাইভারের বয়স সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ধারা ৪ এ বলা হয়েছে যে- ১৮ বছরের কম বয়সী কোন ব্যক্তি যান চলাতে পারবে না। ২০ বছরের কম বয়সী কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক স্থানে একটি পেশাদার ড্রাইভার হিসাবে মোটর গাড়ির চালনা করতে পারবে না। একজন ড্রাইভারকে ড্রাইভিং এর সময় বা গাড়ি চালানোর সময় তার সাথে যা বহন করতে হবে বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যা অবশ্য্ই সঙ্গে রাখতে হয় তা হলো- ১)একটি বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ২)গাড়ির নিবন্ধন ডকুমেন্টস৩)গাড়ির বীমার ডকুমেন্ট ৪)ট্যাক্স টোকেন ৫)ফিটনেস সার্টিফিকেট
রুট পারমিট (যদি প্রযোজ্য হয়)।
ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণে জরিমানার শিকার হতে হয় অনেককে। প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হয় ‘কেস স্লিপ’। যা দেখিয়ে নির্ধারিত জরিমানার টাকা পরিশোধ করে মামলা থেকে অব্যহতি নিতে হয়। মামলা হলে ট্রাফিক ইনস্পেক্টর একটি স্লিপ দেয় এবং কেস স্লিপ হিসেবে সমধিক পরিচিত ওই কাগজটি হারিয়ে গেলেও বিপদের অন্ত থাকে না তাই উক্ত কেস স্লিপ হারিয়ে গেলে কি করবেন তা সংক্ষেপে জেনে নিন।
আমরা জানি গাড়ি নিয়ে মামলা হলে আপনার গাড়ির একটি বা দুটি কাগজ আটকে রেখে ট্রাফিক পুলিশ আপনাকে একটি কেস স্লিপ দিয়ে দেয়। তারপর ইউক্যাশ এর মাধ্যমে টাকা জমা দিলে আপনার বাইকের আটকে রাখা কাগজ আপনাকে ফেরত দেয়া হয়। অনেক সময় জরিমানার টাকা পরিশোধের পূর্বে আমাদের কাছ থেকে এই কেস স্লিপ হারিয়ে যায়। আমরা অনেকেই জানি না কেস স্লিপ হারিয়ে গেলে কিভাবে কি করতে হয়। ‘কেস স্লিপ’ হারিয়ে গেলে কী করবেন? তা জেনে রাখুন (সূত্রঃ https://dmpnews.org)
কেস স্লিপ হারিয়ে গেলে করনীয়:
১। জিডি (সাধারন ডায়েরী) করা- সবার প্রথমে আপনাকে থানায় যেতে হবে এবং জিডি করতে হবে। নিকটস্থ থানায় গিয়ে গাড়ীর নাম্বার উল্লেখপূর্বক কেস স্লিপ হারানোর বর্ননা দিয়ে জিডি (সাধারন ডায়েরী) করবেন।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে এটা খুব ঝামেলার কাজ, কিন্তু এমনটা আসলে না। আপনি থানায় গেলে পুলিশের কাছ থেকে সহায়তা পাবেন।
২। জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সাথে রাখা- এই কাজগুলো করতে গেলে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিবেন। কারন এটি আপনার ভেরিফিকেশনের জন্য কাজে লাগবে। যদি সম্ভব হয় নিজের অরজিনাল জাতীয় পরিচয়পত্র টি সাথে রাখুন।
৩. সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক অফিসে যাওয়া- প্রথমে আপনাকে জানতে হবে আপনার বাইকের কাগজ কোন জোনের ট্রাফিক অফিসে আছে। ট্রাফিক অফিস সনাক্তেরপর সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক অফিসে জিডি কপি ও পরিচয়পত্রের কপি দিয়ে জানিয়ে দিন আপনার কেস স্লিপ হারিয়ে গেছে।
৪. ট্রাফিক অফিস আপনার গাড়ির মামলার তথ্য যাচাই করবে।
৫। জরিমানার পরিমাণ জানিয়ে দেয়া- তথ্য যাচাই শেষ হয়ে গেলে ট্রাফিক অফিস মামলার আইডি ও জরিমানার পরিমাণ আপনাকে জানিয়ে দেবে। আপনার যদি এটা নিয়ে অন্য কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে সেখান থেকে আপনি জেনে নিতে পারবেন।
৬। জরিমানা পরিশোধ- আপনি ইউক্যাশে জরিমানা পরিশোধ করে আসলে জিডি ও পরিচয়পত্রের কপি জমা দিয়ে আপনার ডকুমেন্টটি পেয়ে যাবেন।
স্লিপ হারিয়ে গেলে আপনি কাগজ ফেরত পাবেন, কিন্তু যদি ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চান সব সময় নিজের বাইকের ডকুমেন্ট নিয়ে সচেতন থাকুন। যত্র দ্রুত সম্ভব মামলার টাকা জমা দিয়ে বাইকের কাগজ পত্র বুঝে নিন। সবচেয়ে ভালো হয় মামলা হওয়া মাত্র ইউক্যাশে টাকা জমা দিয়ে কাগজ নিয়ে নিতে পারলে। নিরাপদ হউক আপনার পথচলা।
একজন সুনাগরিক হিসেবে আমরা সকলেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরাতে ও দুর্ঘটনা রোধে ট্রাফিক আইন মেনে চলার শফথ করি। সাথে সাথে আইন প্রয়োগে ও কঠোরতা দরকার । ১৯৮৩ সালে জারিকৃত মোটরযান আইনের যে জরিমানার বিধান করা হয়েছে তাতে ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন এর জরিমানার মধ্যে বেশ দৃশ্যমান পার্থক্য রয়েছে। সেজন্য ওই দুটি আইনের মধ্যে জরিমানা ও সাজার পরিমানের মধ্যে সামঞ্জস্যতা নিয়ে আসলে এবং আইন ও প্রয়োগে কঠোর হলেও মান্য করাতে সুবিধা হবে। আসুন আমরা সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলি এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে শুধু নয় নিজের জীবন ও মানের উন্নতি সাধনে অবদান রাখি।
লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, আইন বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। ইমেইলঃ bdjdj1984du@gmail.com.