৬ এপ্রিল, ১৮১৪-
“সম্মিলিত মিত্রজোট ঘোষণা করেছে যে সম্রাট নেপোলিয়ন ইউরোপে শান্তিস্থাপনের পক্ষে একমাত্র বাধা। তাই সম্রাট নেপোলিয়ন শপথ নিয়ে ঘোষণা করছেন যে তিনি স্বয়ং এবং তার পুত্রের এবং উত্তরাধিকারীদের পক্ষ থেকে দেশের কল্যাণের জন্য ফ্রান্সের সিংহাসন পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত। দেশের স্বার্থে সব রকমের আত্মত্যাগ এমনকি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে তিনি প্রস্তুত। “
২২ আগস্ট, ১৮১৫ এক ভাষণে-
…”ফরাসি দেশের স্বাধীনতা অটুট থাকুক “
নেপোলিয়ন
ভুবন বিজয়ী বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সাধারণ মানুষের বন্ধু, শান্তি,সাম্য আর স্বাধীনতার অগ্রদূত হয়ে ১৫ আগস্ট ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে, মহাকাব্য ইলিয়াডের একটি যুদ্ধ চিত্র বোনা কার্পেটের উপর, জন্ম গ্রহণ করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র গুলির মধ্যে একটি বিস্ময়কর মহাকাব্যিক চরিত্র নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ইতিহাসে এমন একটি অসাধারণ প্রতিভাময় চরিত্র চরম বিস্ময়ের।তিনি যেমন চরম মমতায় সিক্ত তেমনি আইন প্রয়োগে অসম্ভব কঠোর। একদিকে শিল্প প্রেমী অন্যদিকে মহাপ্রলয় সৃষ্টিকারী বীর যোদ্ধা। বিচিত্র জীবনমুখী নেপোলিয়নের জীবনের প্রতিটি স্তর অনুকরণীয়।
নেপোলিয়ন ছিলেন স্বপ্ন বিলাসী। তার স্বপ্ন ছিলো আকাশ চুম্বী। তিনি প্রায় সমগ্র ইউরোপ বিজয় করে পৃথিবী জয় করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। মহাবীর আলেক্সান্ডার এর মতো ইউরোপ ছাড়িয়ে এশিয়া পারি দিয়ে ভারতবর্ষে স্বাধীনতার দূত হয়ে আসার স্বপ্ন দেখেতেন।
যে লোকের ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর পরাধীনতা জন্ম লগ্ন থেকেই বন্ধু সে লোক স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা রাখে কি না তা আমার জানা নেই।কিন্তু পরাধীন কর্শিকা দ্বীপের নেপোলিয়ন কর্শিকার স্বাধীনতা এবং সাধারণতন্ত্রের স্বপ্ন আঁকতেন।মাত্র ৩ মিনিটের একটা সুযোগ কাজে লাগিয়ে হয়ে উঠলেন অপরাজেয় নেপোলিয়ন। দখলে নিলেন ফ্রান্সের সিংহাসন আর জনগণের ভালোবাসা।
তিনি ক্ষমতা ভালোবাসতেন। ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি বলেন,”আমি ক্ষমতা ভালোবাসি।হ্যাঁ ভালোবাসি, কিন্তু শিল্পীর মতো করে। যেমন এক জন বেহালাবাদক তার বেহালা ভালোবাসে,কারণ এই বেহালার তন্ত্রীতে সে সুরের ঐকতান সৃষ্টি করে।”ক্ষমতা প্রিয় সম্রাট নেপোলিয়ন কখনো সাধারণ জনগণের অধিকার হরণ করেন নি।
তুঁলর যুদ্ধের ৪ মাসের মধ্যে ক্যাপ্টেন থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, আবার ছ-মাসের মধ্যে কারাগারে।জীবনের নানা ঘটনা -বিঘটন,উত্থান-পতন নেপোলিয়নকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি। তিনি জানতেন না হতাশা কি।নেপোলিয়ন বিশ্বাস করতেন,”Impossible is a word to be found in a fool’s dictionary.”
সেনানায়ক বোনাপার্ট ছিলেন একাগ্র এবং দৃঢ় মনোভাবের অধিকারী।যার ফলে,দুর্ভেদ্য মনতোয়া ‘উমেজ’এর ৮০ হাজার সৈন্যের বিপরীতে মাত্র ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে জিতে নিয়েছিলেন। তার ছিল ঝুঁকি নেয়ার অসীম সাহসীকতা,ছিল দ্রুত গতি।ফলস্রুতিতে, জিতে ছিলেন মাত্র ১৫ দিনে ৬ টি যুদ্ধ সহ ২১ টি পতাকা।
রক্তেই যার বিপ্লব মেশানো সেই নেপোলিয়নেরও বই পড়ার প্রতি অসম্ভব আগ্রহ ছিল। বন্ধুরা যখন ঘোরাঘুরি আর আড্ডায় মেতে থাকতো তখনও বোনাপার্ট প্রয়োজনে টাকা ধার করে বই কিনে বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতেন।অঙ্কের প্রতি তার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি ছিলো। বলা হয়ে থাকে তার অঙ্কের মেধা ভালো ছিলো বিধায় তিনি কখনো লক্ষ্য ভ্রষ্ট হন নি।তিনি কখনো কখনো অঙ্কের জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য একনাগাড়ে ৩ দিন স্নান-খাওয়া ভুলে ঘরে বন্দি হয়ে থাকতেন। তিনি ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব,ভূগোল, অঙ্ক, বিজ্ঞান ও দর্শন পড়তে ভালোবাসতেন। শুধুমাত্র বই পড়ার অভ্যাস এবং অধ্যবসায়ের জোরে তিনি ‘ব্রিয়ন’ থেকে ‘ইকল রয়্যাল মিলিটারি ‘ স্কুলে পড়ার সুযোগ পান।
আপনি বিজয়ীর মুকুট পরতে চান??নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে চান??সফলতা অর্জন করতে চান??আপনাকে অবশ্যই বাস্তব বুদ্ধি, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি, কষ্টসহিষ্ণু ও ধৈর্য সম্পন্ন হইতে হবে। এবং থাকতে হবে লোক চেনার ক্ষমতা। উপর্যুক্ত সব ক’টি গুণই নেপোলিয়নের ছিল।
সম্রাট নেপোলিয়ন ছিলেন অভাবনীয় পরিশ্রমী। তিনি দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতেন।কখনো কুড়ি ঘণ্টাও করতেন।
সম্রাট নেপোলিয়ন সব কিছুতে মিতব্যয়ী পথ অবলম্বন করতেন।প্রয়োজনে ছেড়া জামা সেলাই করে ব্যবহার করতেন তবুও রাষ্ট্রের একটি পয়সা অযথা ব্যয় করতেন না।
নেপোলিয়ন আদর্শ পুরুষ।তার মায়ের প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। ছিল ভাই বোনদের প্রতি স্নেহ।যোদ্ধা নেপোলিয়ন একজন সেনাপ্রধানের জন্য যেমন অনুকরণীয় তেমনই একজন ছাত্রর।বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন সমৃদ্ধ নেপোলিয়ন রাজনীতিবিদের জন্যও আদর্শ চরিত্র। তিনি কখনোই মনুষ্যত্ব ও সম্মান বিসর্জন দেয় নি।এবং অন্যকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে ভুল করেন নি।
“আমিই বিপ্লব” খ্যাত নেপোলিয়নই একমাত্র সমরনায়ক যিনি তরবারি আর কলম,পেশিশক্তি আর মস্তিষ্কের শক্তি সবকিছু একত্রিত করে প্রশাসনিক উন্নতি ঘটিয়ে মানুষের রাজ্য ও মন একসঙ্গে জয় করেছিলেন।
বিচিত্র জীবনমুখী নেপো’ কখনো নির্মম, নিষ্ঠুর সেনাপতি হলেও,তার প্রেম বোধ কখনো-কখনো ‘সম্রাট জাহাঙ্গীর’কেও ছাড়িয়ে যায়।রোমিও-জুলিয়েট, ইউসুফ-জুলেখা,সিরি-ফরহাদ এদের পাশাপাশি নেপোলিয়ন-জোসেফাইন নাম দুটিও অমর হয়ে আছে। নেপোলিয়ন এক পবিত্র প্রেমের নাম।নিজের থেকে ছয় বছরের বড় বিধবা জোসেফাইনকে বিয়ে করে প্রথম দিনই বলেছিলেন –
“আমি তোমার কাছে চিরন্তন ভালোবাসা বা বিশ্বস্ততা কোনটাই চাই না।চাই শুধু সুততা এবং অসীম খোলামেলা ব্যবহার। যে দিন তুমি বলবে আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা কমে গেছে,জানবে সেদিন আমার ভালোবাসারও শেষ দিন,জীবনেরও শেষ দিন।”
এতো কিছুর পারেও যদি কেহ প্রশ্ন করিয়া থাকেন, “নেপোলিয়ন কে কেন জানিব?” তাহা হইলে লেখকের বাঁচিবার শেষ ইচ্ছা টুকুনও শেষ হইয়া গিয়াছে বলিয়া জানিবেন।
কায়েস মাহমুদ ।
রাবি,আইন বিভাগ, প্রথম বর্ষ।