মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে আমরা এই প্রজন্মের এবং কভিড-১৯ এর মতো নিষ্ঠুর ও দানব প্রজাতির করোনা ভাইরাস ফেস করতে হচ্ছে। এটা আমাদের দূর্ভাগ্যই বলবো।সারা বিশ্বব্যাপী যে তান্ডব এই ভাইরাস চালাচ্ছে তাতে প্রতিটি মূহুর্ত বেঁচে না থাকার আতঙ্কে কেটে যাচ্ছে। তবে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন, স্বাস্থ্য সচেতন ও সামাজিক দূরত্ব নানাবিধ নিয়ম কানুন প্রতিপালনে এই ভাইরাস থেকে নিজেকে তথা পরিবারের ও সমাজের সকলকে নিরাপদ রাখা যায়। বাংলাদেশে ৩১ মে থেকে সাধারণ ছুটি শেষ হয়ে সীমিত আকারে গণপরিবহণ, দোকানপাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে আশংকার ব্যাপার হলো এই সময় করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকার বলছে করোনার সাথেই যেহেতু চলতে হবে সেখানে এটাকে মেনে কিভাবে স্বাস্থ্য বিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে করোনা মোকাবেলা করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
উল্লেখ্য যে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সংত্রামক প্রতিরোধ (নির্মূল, নিয়ন্ত্রণ)আইন-২০১৮ এর বিধান মতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন, মাস্ক না পরলে ৬ মাসের কারাদন্ড ও ১ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো এই স্বাস্থ্যবিধি বা আইন কি জনগণ আদৌ মানছে? বা আইন মানাতে সরকার যুগোপযোগী ও সময়োপযোগী কি ব্যবস্থা নিয়েছে? বা আইন প্রতিপালনে অধিক জনসংখ্যার দেশে বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সক্ষমতা কতটুকু ইত্যাদি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্বে বাই রোটেশন লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও খেটে খাওয়া মানুষের কথা চিন্তা করে ছুটি বা লকডাউন তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভঙ্গুর অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে এই সিদ্ধান্ত ঠিকই। তবে সরকারের উচিত হবে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য বিধি মানাতে জনগণকে বাধ্য করা। বাসের ভাড়া ৬০% বাড়ানো হয়েছে কিন্তু জনগণ বা বাস মালিকগণ কি স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করছে তা দেখভালের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে মৃত্যুমিছিল ঠেকাতে কঠোরহস্তে দমন করতে হবে। নাহলে আমাদের সোনার বাংলাদেশ ইতালি, যুক্তরাস্ট্র হতে বেশি সময় লাগবে না। গতকাল আক্রান্ত হয়েছিল ২৯১১ জন ১২৫০০ এর মতো সন্দেহযুক্ত রোগীকে করোনা ভাইরাস টেস্ট করে পজিটিভ এসছে। ৩৭ জন মারা গেছে। মোট আক্রান্রে সংখ্যা ৫০ হাজারে অধিক ছাড়িয়েছে। মৃত্যু ৭০০ শত এর উপরে প্রতিদিন বাড়ছে। এসব কিসের লক্ষণ না জানি আমরা সকলেই কি আবার করোনা পজিটিভ হয়ে যায় ইত্যাদি। তবে আশার বাণী হলো যদি আমরা করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে এগিয়ে আসি বা নিজেরা স্বাস্থ্য সচেতন হই তাহলে এটা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
করোনা থেকে বাঁচতে হলে অবশ্য পালনীয় কিছু নিয়মাবলী জেনে রাখতে হবে। জন হপকিন্স সেন্টারের দেওয়া কিছু তথ্য সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
১। বদ্ধ পরিবেশে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। অতএব চেষ্টা করুন দরজা-জানালা খোলা রেখে ঘরে আলো বাতাসের চলাচল বৃদ্ধি করতে। নিজে কিছুক্ষণ পরপর চেয়ার থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে আলো বাতাস নিন।
২। সবার মুখে মাস্ক পরিধান, প্রতি পনের মিনিট অন্তর অন্তর স্থান পরিবর্তন, কোন ধরণের বস্তুতে হাতের স্পর্শ না লাগানো, কিংবা নিজের মুখে হাত লাগানো থেকে বিরত থাকলে করোনা আক্রান্ত হওয়ার হার আরো অনেকাংশে কমে যায়। অর্থাৎ বাইরে গেলে এসব বিষয়ে সবসময়ে সচেতন থাকুন।
৩। গণজমায়েত থেকে নিজেকে সবসময় বিরত রাখুন। যেকোনো ব্যাক্তি থেকে কমপক্ষে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করুন সবসময়।পারতপক্ষে ড্রাইভার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করুন। তবে তার বেতন দিন। নিজেকে সর্বোচ্চভাবে অন্যের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
৪। সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলুন।সবসময় হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। সাবান পানির ব্যবহার করার সুযোগ থাকলে আরো ভালো। বাসায় ফেরার পরপরই হাত মুখ ধুয়ে নিন। ব্যবহৃত কাপড়গুলি ধুয়ে ফেলুন।
৫। রেসপিরেটরী হাইজিন অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অবশ্যই মেনে চলবেন। সর্দি, কাশি, হাঁচি দেবার সময় সতর্ক থাকুন। অন্যদের এসব করতে দেখলে দ্রুত সেখান থেকে সরে যান।
৬। যেসব জিনিস অন্যের সাথে ব্যবহার করতে হয়, তা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। যেমন পার্কের বেঞ্চ, বাস বা ট্রেনের সিট, রিকশা, অফিসের দরজা, লিফটের বোতাম, হোটেল বা রেস্তোরার প্লেট গ্লাস কাপ ইত্যাদি। এই সময়গুলিতে অফিসে নিজের বাসার খাবার গ্রহণ করুন। সম্ভব না হলে শুকনো খাবার খান।
৭। ঘরের বাইরে যত কম যাওয়া যায়, ততই ভালো। এজন্যই একটি বিশ্বস্ত বন্ধুগ্রুপ তৈরি করুন যারা একই ধরণের হাইজিন প্র্যাকটিস করেন। একাকীত্ব আপনার ইমিউনিটি কমিয়ে দেয়। তাই সুস্থ মানসিক পরিবেশ তৈরি করুন।
৮। সকালে কিংবা রাতে অর্থাৎ যখন মানুষের সমাগম কম হয়, সেসময়ে হাটার অভ্যাস চালু রাখুন। এই ভাইরাস দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের মাঝে বেশি পরিমানে ছড়িয়ে পড়ে।
৯। পর্যাপ্ত পরিমানে লেবুর শরবত, আদা-লেবু চা, গ্রিন টি, গরম দুধ কিংবা টক দই খাওয়ার অভ্যাস করুন। মাঝে মাঝে গরম পানি দিয়ে কুলকুচি করতে থাকুন। প্রচুর ফলমূল শাক-সবজি অর্থাৎ পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। ভিটামিন সি, ডি এবং জিংক সমৃদ্ধ খাবার বেশি গ্রহণ করুন। ভিটামিন ডি এর উৎস যেমন দুগ্ধজাত পণ্য বাদাম,সামুদ্রিক মাছ,ছোট মাছ গ্রহণ করুন। এগুলো আপনার ইমিউনিটিকে বুস্ট আপ করবে।
১০। যারা অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনী জটিলতা কিংবা অন্যান্য ক্রনিক রোগে আক্রান্ত বা বয়স্ক ব্যাক্তি, তারা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করুন। পারতপক্ষে বাসার বাইরে না যাওয়াই ভালো।
উপরের বিষয়গুলি সবাইকে অত্যন্ত সচেতনভাবে মেনে চলতে হবে। তবে আমাদের দেশের মানুষের সমস্যা হচ্ছে স্বেচ্ছায় আইন মানতে চাই না। সেকারণে সরকারকে জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে দেশে যে উপযুক্ত আইন রয়েছে তা প্রতিপালনে জনগণ ও স্টেকহোল্ডারদের বাধ্য করা।। সংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ যেন নিজে বাঁচার পাশাপাশি অন্যকে সংক্রমিত না করতে পারে সে লক্ষ্যে আইনটি করা হয়। এই আইন অমান্য করলে শাস্তির বিধানও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সমস্যা হলো আইনটি সম্পর্কে জানে না অনেকেই। অধিকাংশ মানুষই এই আইন সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল না হওয়ায় মানার বিষয়েও তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এই আইনের ওপর সচেতনতা থাকলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই জন্য মানুষ যেন আইনটি সম্পর্কে জানতে পারে সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি বলেই তাদের অভিমত।
‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’ নামে বাংলাদেশেও দারুণ কার্যকরী আইন আছে। জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন লঙ্ঘন করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। এই আইন পড়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে আইনগতভাবে সক্ষম হবেন আইইডিসিআর এর মহাপরিচালক। বিদ্যমান আইনে সংক্রামক রোগের সিডিউলে COVID-19 এর নাম নেই, তবে সরকার ইতোমধ্যে গেজেট করে করোনা ভাইারাস বা কভিড-১৯ রোগকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাই এই আইনটি প্রয়োগে এখন আর আইনগত কোন প্রতিবন্ধকতা নাই। বিধায় এই আইনের যথাযথ ও কঠোর প্রযোগ করে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। যদিও আপনা সচেতনতার বিকল্প নাই।
লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, আইন বিশ্লেষক ও কলামিস্ট । ইমেইলঃ bdjdj1984du@gmail.com