মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
পরীক্ষায় পাশ করার পর বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের আনন্দ উল্লাস চিরাচরিত নিয়মে পরিনত হয়েছিল। সেই উল্লাস পরীক্ষার পরের দিন পত্রিকার লিড নিউজ হতে দেখেছি। সাধারণত ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে এধরনের ছবি পত্রিকায় নিউজ হতে দেখেছি। বাজারে মিস্টির দোকানগুলো মুহূর্তের মধ্যে খালি হয়ে যাওয়া বা চারিদিকে মিস্টি বা ফুল বিতরণ করা অভ্যাসে পরিণত হলেও এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কভিড-১৯ সব তছনছ করে দিয়েছে। লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরা এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে বের হওয়া বর্তমানে বহূল প্রচলিত কিছু শব্দ (শুধু শব্দ নয় কালের সাক্ষী) পরীক্ষা পাশের সেই আনন্দ ও উল্লাস পুরোপুরি বিনস্ট করেছে। শুধু তাই নয় সকল সিস্টেম চেঞ্জ করে পরীক্ষার রেজাল্ট এবার কোন কাগজপত্র ছাড়াই সম্পূর্ণই ভার্চুয়ালি বা অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর জীবনে এসএসসি পাশ ও ভালো জিপিএ সিকিউর করা একটা গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে। কারণ এটি শিক্ষা জীবনের সরকারি সনদ পত্র অর্জনের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এখন অবশ্য পিইসি বা জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা আছে। কথায় আছে যে মূলাটা বাড়ে তা পত্তনেই বোঝা যায়। মানে হলো মর্নিং শোজ দ্যা ডে, ধরে নওেয়া হয় এসএসসি বা মেট্রিকে যে ছেলে বা মেয়ে ভালো রেজাল্ট করে সে নাকি পরের গুলোতে ও ভালো করে। জীবনে শাইন করে ইত্যাদি অনেক কিছু শুনেছি। যদিও জীবনের অনেক হিসেব কারো মিলে আবার কারো মিলে না। এটাই জীবন, এটাই বাস্তবতা।। তারপরেও এই অনিশ্চিত ও ভুলে ভরা জীবন নিয়ে কত মিথ্যা স্বপ্নের জাল অহর্নিশ আমরা বুনছি তা হিসেব করলে সে হিসেব কোনদিনই মিলবে না। তবুও আশা নিয়ে সবাই বাঁচতে চাই। সংসার সাগরে সুখ দুঃখ তরঙ্গের খেলা আশাই তার একমাত্র ভেলা।
পরীক্ষা পাশের পর বাঁধ ভাঙা আনন্দ উল্লাস এর প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা সেটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। তবে বিপরীতে অন্যরকম চিত্র ও দেখা যায় যখন দেখি কোন পরীক্ষার্থী ফেল করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। মন দুঃখে তখন বেশি কাঁদে। বেশি মাতামাতি করা কোনভাবেই কাম্য নয় এবং দরকারও নেই সে কথাটি করোনা ভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিলো। কোভিড-১৯ আরো যে শিক্ষাগুলো দিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে হলো এটি একটি যে পরীক্ষা পাশ করে বেশি মাতামাতি বা অতি উল্লাস করার দরকার নেই শুধু শুকরিয়া আদায় করলেই চলবে। কোন কিছুতেই বাড়াবাড়ি রকমের বাড়াবাড়ি ভালো নয় শুধু বিপদে নয় আনন্দের সময় বা সুখের সময়ও ধৈর্য্য ধারণ করতে হয় সম্ভবত করোনা ভাইরাস তা শিখিয়ে দিচ্ছে। জীবনের প্রথম থেকেই যদি কেউ বাড়াবাড়ি করতে শিখে তবে সেটি পরবর্তী জীবনে তার অন্যান্য সকল কর্মকান্ডে প্রতিফলিত হয়। এজন্য আমরা করোনা ভাইরাসের এই আপদকালিন সময়ে শুধু নয় করোনা পরিবর্তিত সময়ে এখন করোনাকালে যে আচরণ বা ভদ্রতা বা ধৈর্য্য ধারণ করছি, মাস্ক পরছি, সাবান দিয়ে নিয়ম করে হাত ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হওয়া শিখছি ঠিক তেমনি এই আপদকালীন সময় কেটে গেলেও যেন সেভাবে আচরণ করি তা খেয়াল রাখব। দুঃখের সময় যেমন ধৈর্য্য ধরতে হয় ঠিক তেমনি সফলতার সময় আমাদের উল্লসিত না হয়ে সবর বা দায়িত্বশীল আচরণ শিখতে হয়।
শুধু সার্টিফিকেট অর্জনই পড়াশোনা করার মুল উদ্দেশ্য হলে হবে না। ভালো আচরণ ও মানুষ হওয়ার শিক্ষা নিতে হবে। একজন স্বশিক্ষিত মানুষ সুশিক্ষিত হয় তবে সবসময় একই রকম হবে এমনটি নয়। পরিবেশ ও সময় বদলের কারণে আনন্দ উল্লাস এর ধরণ পাল্টেছে। কভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী দৈনন্দিন নানা কর্মকান্ড ভার্চুয়ালি তথা ইন্টারন্টে ও ই-কমার্স, ই-বিজনেস এর মাধ্যমে শুরু হয়েছে। সেই সাখে মানুষ এ্যাকচুয়াল যোগাযোগ কমিয়ে দিয়ে ভার্চুয়াল যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে করে সম্পর্ক মধ্যে করোনার মতো সামাজিক দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের প্রকৃত আবেগ কমে যাচ্ছে। ঈদে শুধু সামাজিক যোগাযোগ তথা ফেসবুকে, মেসেনজারে, হোয়াটস এ্যাপের মাধ্যমে ঈদ মোবারক লিখে ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনমিয় হচ্ছে। প্রকৃত ভালোবাসা, মায়া মমতা, আত্নীয়তা অনেকাংশে কমে গেছে। আমার মনে হয় এবার করোনা মহামারি এসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে সকলেই ভার্চুয়াল যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার এগুলো বেছে নিয়েছে। যাতে করে প্রকৃত ভাব-ভালোবাসা ও সম্প্রীতি এবং আনন্দ অনেক দূরে চলে গিয়েছে।।
ঠিক পরীক্ষা পাশের পর যে আনন্দ করোনার ভয়ে উবে গেছে ঠিক তেমনি আমাদের অন্যান্য যে সুখের আনন্দ উল্লাস ছিলো তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে বাড়াবাড়ি কোন কিছুতেই ভালো না। আমরা মানুষ সবকিছুতে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি বলে মনে হয় । একারণে সৃস্টিকর্তা নাখোশ হয়ে করোনার মতো মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পঙ্গপাল মানুষ দমনের জন্য পাঠাচ্ছে নাকি মানুষকে সোজাপথে ও সঠিকপথে আনতে নিয়ন্ত্রণ করছে তা ভেবে দেখার সময় এসে গেছে। করোনা মহামারি বা পঙ্গপাল যদি এইসব আলামত পৃথিবী ধ্বংশের আলামত হয়ে থাকে তবে সবাইকে সাবধান হতে হবে এখনই এবং বেশি বেশি ভালো কাজ ও সৃস্টিকর্তার দেখানো পথে চলতে হবে। আর পরীক্ষা পাশের উল্লাসেও যেন কোন রকমের বাড়াবাড়ি বা হটকারি কোন কিছু না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। যদিও করোনা ভাইরাস এর প্রকোপ বিদ্যমান থাকায় চোখে পড়ার মতো সেরকম আনন্দ উল্লাস এবার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পরে প্রতিভাত হয়নি। পরিশেষে করোনাকাল মুক্ত একটি পৃথিবীতে সকল পরীক্ষার্থী সুস্থ থাকুক এবং সুন্দর ভবিষ্যত হোক এই কামনা করছি।
লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক। ইমেইলঃ bdjdj1984du@gmail.com