সব
facebook apsnews24.com
পদ্মা পাড়ের প্রেম (ছোটগল্প) - APSNews24.Com

পদ্মা পাড়ের প্রেম (ছোটগল্প)

পদ্মা পাড়ের প্রেম (ছোটগল্প)

শারমিন তনু

প্রকৃতি আর মানুষ যেন একই সূত্রে গাঁথা। মানুষগুলো প্রকৃতির দেওয়া অবারিত উপকরণ থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আবার প্রকৃতির নির্মমতা ও তাণ্ডব মানুষকে করে ফেলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। তবুও মানুষের নিরন্তর পথ চলা, এইতো জীবন।

বহুরূপী পদ্মা। পদ্মায় জেগে ওঠা চরে বাসা বাঁধল রমিজ উদ্দীন ও জমিলা। তাদের দেখাদেখি আরও অনেকেই আসলো। পরম সুখে-শান্তিতে জীবন কাটছে তাদের। জমিলা তার ছনের তৈরি ছোট্ট ঘরটিকে কত সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। সামনে কিছু সবজি চাষও করেছে। একদিন জমিলা জন্ম দিল ফুটফুটে কন্যা। চাঁদনিরাতে জন্ম নিয়েছে বলে নাম রাখলো চাঁদনি। এই চাঁদনি আ আ মা মা করতে করতে বড় হয়ে উঠলো। চাঁদনি যখন কৈশোরে পদার্পণ করলো তখন নদীতে বয়ে যাওয়া নৌকা, লঞ্চ, ট্রলার দেখে বিস্মিত হতো! ভাবতো এরা কোন পানে ছুটে যাচ্ছে? আমাকে কি নিবে? কিন্তু কোনো সাম্পান তাকে নেয় না। কাজকর্মে তার অস্থিরতা প্রকাশ পায়। পদ্মার চরে এমন একটি পরিবেশ যেখানে বিদ্যুৎ নেই, হ্যারিকেন বা কুপি জ্বালিয়ে থাকতে হয়। পড়াশুনার উপায় নাই বললেই চলে। এমনকি যোগাযোগের কোনো অাধুনিক মাধ্যমও নেই। চাঁদনিকে যে এ পাড়ার কেউ কেউ পছন্দ করতো না এমনটি নয়। চাঁদনি শান্ত-শিষ্ট ভদ্র মেয়ে কিন্তু বয়সের কারণে উত্তাল সমুদ্রে পড়েছে। চাঁদনি প্রায়ই নদীর ঘাটে জল আনতে যেতো এবং আনমনে অনেক কিছুই ভাবতো।

একদিন চাঁদনি আবিষ্কার করলো কেউ একজন তাকে লক্ষ করছে। সময় লাগলো না বেশি দিন। একটি মুক্ত অক্ষরে লেখা চিঠি তার হাতে পৌঁছল। লেখা ছিল ‘তোমার জন্য রোজ এসে বসে থাকি। তোমাকে দেখলে অামার ভালো লাগে, না দেখলে ভালো লাগে না।’ চাঁদনি খুব একটা পড়াশুনা জানে না, তবুও ওর অল্প জ্ঞানে বুঝতে পেরেছে এটা তার উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে একবিন্দু বৃষ্টি। নদীর ঘাটে বহু ছলা-কলায় আসার মাত্রা সে বাড়িয়ে দিলো এবং এক সময় দুজন প্রণয়াবদ্ধ হলো। ছেলেটি ছিল নদীর ঐ পারের বাসিন্দা আর মেয়েটি চরাঞ্চলের। চমৎকার জুটি।

শরৎকাল। চরে কী সুন্দর কাশফুল রাশি রাশি ফুটে আছে। শুভ্র সতেজ। মন উচাটন হয়ে যায় দেখলে। চাঁদনি দাঁড়িয়ে আছে কাশবন ঘেঁষে। এমন সময় ছেলেটি নিজে একটি ডিঙ্গি নৌকা বেয়ে একেবারে চাঁদনির কাছে চলে আসলো। ছেলেটির নাম শিপলু। সে ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। নাগরিক ও একঘেয়ামি জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নদীর পাড়ে বসা অতঃপর চাঁদনিকে দেখা ও প্রণয়। শিপলু দেখলো চাঁদনি হালকা-পাতলা গড়নের একটি ছিপছিপে মেয়ে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। চোখ দুটি খুব মায়াবী। এই চোখের কোটরে যেন শিপলুর হৃদয়াবেগ উথলে উঠলো। সব কিছুর পরও তাদের প্রেম যেন স্বর্গ প্রদত্ত পবিত্র। চাঁদনি ভাবছিল এই উচ্ছল তারুণ্যে ভরা শিক্ষিত ছেলের সাথে কীভাবে তার ভাবাবেগ ঘটবে? কিন্তু শিপলু তাকে এই জটিল অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসলো। শিপলু বললো, ‘তোমার মনের সাথে আমার মনটাকে বেঁধে রেখো যেন কোথাও যেতে না পারি।’ চাঁদনি দুষ্টমি করে বললো, ‘আমার বাড়ির পাশে সুপারি গাছ আছে, সেখানে আপনাকে বেঁধে রাখবো।’ শিপলু বললো, ‘সে তো তোমার মনের সাথেই বাঁধা হলো।’ চাঁদনি শুদ্ধ করে কথা বলতে পারে না, তাই সে শিপলুর অাবেগি কথায় বলেই বসলো, ‘এ্যাতো বেশি বললে, আমি কিন্তু কেন্দিয়া দিবো।’

ব্যস্ত জীবনের বাস্তবতার সাথে মানুষের একছন্দে পথ চলা। মানুষ অনেক কিছুই বুঝতে পারে, অনুভব করে কিন্তু ধরতে পারে না, স্পর্শ করতেও পারে না, এটাই বুঝি তার অদৃষ্ট! শিপলু ঢাকা চলে যায়, আর চাঁদনি অস্থির দিন পার করে। সে কাউকেই এই ব্যাকুলতার কথা বলতে পারছে না। সে মনে মনে ভাবে যে পাখিটি তাকে কলিজার সাথে বেঁধে রাখতে বলেছে সেই পাখিটি কোথায়? অন্যদিকে জমিলা ও রমিজউদ্দিন ভাবছে, ‘ম্যাইয়া ডাঙ্গর হইয়া উঠছে, এ্যাহন তার বিয়া দেওন লাগে।’ কিন্তু এই চরাঞ্চলে পাত্রই বা পায় কোথায়? চাঁদনি এসব কথা শুনলো এবং বাবাকে গিয়ে বললো, ‘বাবা, আমি পড়ালেহা কোরতে চাই।’ রমিজ উদ্দিন শুনে বললো, ‘এই চরে নাই একটা বিদ্যালয়, মাইয়া অামার কয় কী! পড়াশুনা করার কাম নাই, পড়াশুনা করতে নদীর ঐ পাড়ে যাইতে হইবো। ঢেঙ্গি মাইয়া, মাইনসে খারাপ কইবো।’

চাঁদনি হতভম্ব, বিস্মিত। কষ্ট লুকানোর জায়গা নেই। একটি চিঠিও আসেনা। কী করেই বা আসবে! এখানে একটি ডাকঘরও নাই। ছোট ভাইটিকে সাথে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।

বর্ষায় পদ্মা নদী ফুলে ফেঁপে ভরে উঠেছে। জীবনের সব কিছু তার অন্ধ মনে হয়। মা-বাবার বিয়ের তোড়জোড় দেখে, চাঁদনি তার মাকে গিয়ে বললো, ‘মা আমি নদীর ঐ পাড়ের শিপলুকে পছন্দ করি। হের লগে আমার কথা হইছে, হে আইবো।’ চাঁদনির মা বলে, ‘এইসব কথা বাদ দে, বাপের কথা হুন।’

অবোধ ছোট্ট বালিকা, ছোট বেলা থেকেই শুধু নদীর নৌকা, অল্প কয়েকঘর মানুষ, মায়ের সবজি বাগান আর অবারিত খোলা আকাশ দেখেছে। অশান্ত মনটাকে কিছুতেই ঠাণ্ডা করতে পারছে না। বার বার তার নদীর ঐ পাড়ের ঘন ঘাসের ওপর সাদা শার্ট পরে বসে থাকা শিপলুর কথা মনে পড়ে। শিপলুকে নিয়ে কাশফুলের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়ানো, নৌকায় নদীবক্ষে ঘুরে বেড়ানো যেন চাঁদনির কাছে মনে হয়,
‘মোরা এক তরীতে এক নদীর স্রোতে যাব অকূলে ধেয়ে।’

প্রকৃতি ও মানুষের কোনো কিছুই নিজের অনুকুলে আনতে পারছে না চাঁদনি, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে যা ঘটার তাই ঘটছে। চাঁদনির লাঠিয়াল পরিবার নদীতে চর জাগার পর চর দখল করতে গিয়ে যে কত খুন-খারাপির সাথে জড়িয়ে পড়েছে সে কথা সে তার দাদির মুখে শুনেছে। আজ সবকিছুই তার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। তার কাছে শুধু মনে হচ্ছে-
‘তোমায় বান্ধিয়া রাখিব কলিজায়,
আমি ফিরে আসবো অপেক্ষায় থেকো।’

চাঁদনি অপেক্ষায় থাকলেও তার মা-বাবার অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। সোপর্দ করা হয়েছে চাঁদনিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যত্র। ঘর সংসার করছে। সবকিছুর পর শিপলুর সেই শেষ কথাটুকু মনে ফুটে ওঠে। শান্তি ফিরে পায় না, কাজকর্মে শান্তি নেই, যেন সে নিথর পাষাণ প্রাণী। নদীতে নৌকা দেখলে চাঁদনির মনে হতো-

মনমাঝিরে তোর খেয়াতে তুই দিলি যে পাল তুলে,
যাবি রে ভেসে কে জানে কোন কূলে!’
এভাবে বেশ কিছু বছর কেটে গেল।

পদ্মাপাড়ের জনজীবনের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং পুরো দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে অবাধ ও সুন্দর যোগাযোগের জন্য তৈরি করা হবে পদ্মা ব্রিজ। বেশ কয়েক বছর ধরেই চাঁদনি এই পদ্মা ব্রিজের কথা শুনে আসছে। এই পদ্মা ব্রিজ হয়তো তার মুক্তিরও কারণ হতে পারে। তাই ব্রিজের প্রসঙ্গ এলেই চাঁদনি ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এই ব্যাকুলতার কারণ যে কেন বা কার জন্য, সে কথা বুঝতে না পারলেও এক ধরনের অস্থির ব্যাকুলতা সে অনুভব করে।

একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে একদল লোক নদীর চর, কাশবন ও নদীর উভয় পারের মাপজোক করতে আসে এবং ব্রীজের ডিজাইন কেমন হবে সেটা দেখার চেষ্টা করে। এই মানুষগুলোর মধ্যে চাঁদনি এমন একজনকে এভাবে ঠিক এমন জায়গায় দেখতে পাবে তা কল্পনায়ও আনতে পারেনি। পরনে তার সাদা শার্ট, মাথায় টুপি, চিনতে আর বাকি থাকে না। শিপলু ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। মনের ব্যাকুলতা আর অস্থিরতায় তার দুপা সামনে এগিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রে মত্ত হয়, পা টিকে কে যেন আটকিয়ে রাখে, বালির মধ্যে পা যেন গেঁথে যায়। কোনো এক বাধা যেন আবার দুজনকে বিচ্ছিন্ন করে দুজনের কাছ থেকে।

লেখকঃ শারমিন নাহার তনু, শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, গল্পকার এবং সাবেক শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মতামত লিখুন :

ভারতের বিখ্যাত গজল শিল্পী পঙ্কজ উদাস এর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ

ভারতের বিখ্যাত গজল শিল্পী পঙ্কজ উদাস এর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ

কবিতা ‘তেলবাজি’

কবিতা ‘তেলবাজি’

কবিতা ‘যুদ্ধ মানে’

কবিতা ‘যুদ্ধ মানে’

রক্তে কেনা মাতৃভাষা

রক্তে কেনা মাতৃভাষা

কবিতা ‘হতে হলে’

কবিতা ‘হতে হলে’

কবিতা, ‘তাহলে কেমন হতো’

কবিতা, ‘তাহলে কেমন হতো’

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj