বিল্লাল বিন কাশেম
ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে আনন্দ। তবে এবারের ঈদ যেন বিবর্ণ আর রঙহীন আয়োজন। ব্যক্তিগত জীবনেও নানা বিপর্যয়ের মধ্যে ঈদ পালন করেছি। তবে এমন কোন ঈদ পালন করিনি যে ঈদে নতুন জামা-জুতা ক্রয় করিনি। জীবনে এইবারেই প্রথম ঈদ উদযাপন করছি যে নতুন কোন কিছুই কেনা হয়নি। নেই কোন ব্যক্তগত ও পারিবারিক আয়োজন। আমি যেখানে বর্তমানে আছি বাসার সামনের পোরসনেই ব্রান্ড কাপড়ের দোকান। দোকানটি আমাদেরই ভাড়াটে। তারপরও মনে হয়নি নতুন কাপড় বা জামা কিনি। ছোট একটা কন্যা আমার ফারিহা। তারও মন ভালো নেই। খুব চঞ্চল। বাইরে বের হতে পারে না বহুদিন। ছাদ আর বাসা এই এখন তার পৃথিবী। প্রতিবার ঈদে তার অনেক জামা হয়। দোকান ঢাকা ও নানার বাড়ী থেকে বহু জামা কাপড় হয়। এবারে নতুন একটা কাপড় তাও ধোঁয়া হয়েছে। নতুনের আনন্দ নেই সেখানে।
বেশ কয়বার ঈদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঈদ আয়োজনে গিয়ে দেখেছি চরম হতাশার মধ্যেও বন্দীরা আনন্দ নিয়ে ঈদ করছে। বন্দীদের পরিবারের সদস্যরা তাদের রান্না করা খবার নিয়ে স্বজনদের দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এবারের ঈদে মনে হচ্ছে আমারা সবাই বন্দী। করোনা আতঙ্কে অনেক মানুষই ঘরে থাকবেন। বাসায় কিভাবে নামাজ আদায় করা যায় সেই পথ খুঁজছেন। মনে পড়ে গ্রামে ঈদ করতে একবার আম্মা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। সেবার নামাজের আগে পরে বৃষ্টি হয়েছিলো। কাদামাটি মেখে আম্মার চাচা আমাদের বড় নানার সাথে নানুর বাড়ী ফিরেছিলাম। আমাদের বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পরে ছিলো ঈদ সেবারও আমরা সবাই নতুন জামা কাপড় পরে ঈদ করেছি। আম্মা আমাদের হতাশ হতে দেননি। আব্বার মৃত্যুর পর আম্মাদের নিয়ে নানার বাড়ী উঠলেন। গ্রামের জীবনে ঈদ মানে নামাজ কেন্দ্রীক। নামাজ হয় কিছু খাওয়া দাওয়া। টেলিভিশন দেখা, সিনেমা দেখা। এই আয়োজনে অনেকগুলো ঈদ পার করেছি। মনে পড়ে আমার আম্মার খালু এককালে স্থানীয় সাংসদ গাজী এরশাদ আলী নানার রূপা সিনেমা হল নামে হল ছিলো। সেখানে প্রচন্ড গরমে মধ্যে আমাদের খালাতো ভাই সুমন সহ আমরা অনেকেই সিনেমা দেখতাম। চারদিক আবদ্ধ হলের মধ্যে ফ্যান চলতো।
তবে সে ফ্যানের বাতাসও আগুন গরম। সিনেমা শেষ করে যখন হলের বাইরে আসতাম মনে হতো কতো নির্মল বাতাস। খুব ছোট বেলায় আমাদের জীবন কেটেছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বাশার বেইজে। ঢাকা ক্যান্টমেন্ট সে সময়ে আমরা ঈদের নামাজ আদায় করতে বাসার বেইজের কেন্দ্রীয় মসজিদে (সেন্ট্রাল মসক) এ যেতাম। মসজিদের বাইরের আঙিনায় বিশাল নামাজের আয়োজন থাকতো। চারদিকে রং বেরঙের পতাকা আরবিতে কলেমা লেখা ফ্লাগ টানানো থাকতো। আমাদের আব্বা আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে ঈদের জামাতে যেতেন। তার আগে ভোরে আম্মা আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে গোসল করিয়ে দিতেন নতুন সাবান দিয়ে। আমাদের বড় চাচার মেয়ে ছবি আপা ছিলেন তখন আমাদের বাসায়। ছবি আপা, আমার বড় বোন সামিয়া বেগম পিয়া আপা মিলে আমরা কোয়ার্টারের বাদল, জন আরো কতো পড়সির বাসায় যেতাম। তখন বেইজের ছোট একটা বাজার ছিলো সেখানে দোকানীরা ঈদের মেলা করতো। তারপর খিলক্ষেত ও ক্যান্টমেন্টের পাশে মানিকদী এলাকায় কেটেছে অনেক ঈদ। সাংবাদিকতা করার আমলে ঢাকায় ঈদ আয়োজনে নানা প্রস্তুতির রিপোর্ট করতে হতো।
এদের দিনেও এ্যাসায়েন্টমেন্ট থাকতো। শুভেচ্ছা বিনিময় করতে রাষ্ট্রপতি ও সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে গিয়েছি বেশ কয়বার। একবার এসায়েন্টমেন্ট কাভার করতে ঈদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলাম। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি করতে এসে ঈদের জামাত ও ঈদের সংবাদ কাভার করতে আসা সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের কাজে সহযোগিতার জন্য সকালের প্রথম জামাতের সময় থেকে বায়তুল মুকাররম মসজিদে শেষ জামাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম। সেখানে দ্বীনি দাওয়াত বিভাগ থেকে নাস্তা খাওয়ানো হতো। কতো কি আয়োজন ঈদে যা বলে শেষ করা যাবে না। একবার বন্ধু নাজিম হাসানের সাথে বায়তুল মুকাররম মসজিদে নামাজ আদায় করে ঈদের একটা দিন কাটিয়ে ছিলাম। তখন দৈনিক জনকন্ঠের পাশাপাশি বি-বার্তা নামে একটা অনলাইন পোর্টালে কাজ করতো। সেবার সে বাড়ীতে যায়নি। আমরা তার নীলক্ষেত এলাকার অফিসে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরেছিলাম। দুপুরে আমরা খেতে গেলাম রোকেয়া হলের প্রভোস্ট ড. নাজমা শাহীনের বাসায়। নাজিমের সাথে ম্যাডামের মার্কিন প্রবাসী স্বামীর সখ্যতা ছিলো। আমরা দেশ বিদেশের গল্প কাটলাম দিন। নাজিদের একটি মেয়ে বৌ রাজবাড়ীতে।
সে করোনার ঝুঁকিতে একাই ঈদ করছে ঢাকায় একটায় ঈদ করছে। আমি নিজে ঢাকার বাইরে থাকালেও আম্মার সাথে ঈদ করতে ঢাকার বাসায় যাই। ঈদের দিন আমরা সব ভাইরা এক সাথে একত্র হই। এভাবেই বিরহ বেদনা ও হাসি আনন্দে ঈদ উদযাপন করেছি এতোকাল। এবারই মনে হয় ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রেই। লকডাউনের ফলে অনেক মানুষের কোনো উপার্জন নেই। ছোট ভাই নাসির এককালের হলের রুমমেট জানালো জীবন -জীবিকা নিয়ে। তার উপর সামাজিক আর শারীরিক দূরত্বের বিধিতে ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছে। তবু মাথার উপর ছাদ আছে। এটিও কম নয়। যারা ঘরে বসে ঈদের নামাজের মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে সেটুকুও হারিয়েছে বহু মানুষ৷ দেশের বহু এলাকার মানুষ তাঁদের এখন ঠাঁই হয়েছে ত্রাণ শিবিরে৷
এখন আর উৎসবের কথা ভাবতেই পারছি না৷ একদিকে তাদের হাতে টাকা নেই, অন্যদিকে ঝড়ে শেষ সম্বলটুকু উজাড় হয়ে গিয়েছে৷ এখন বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় চাহিদা৷ দূর্যোগ আর দুর্বিপাকে জীবন নিয়ে বেঁচে আছি এটাই সৃষ্টি কর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। এসব ভাবনায় সময় পার হচ্ছে। সব শেষে বলবো, সেরে উঠুক পৃথিবীর অসুখ। আবার হাসুক মানুষ। জীবন সুন্দর, হোক আরও আরও সুন্দর। ভালো হোক সবার। সম্প্রীতি, সহমর্মিতা, আন্তরিকতা ও মানবিকতার পরশে কেটে যাক, করোনাকালের অমানিশা। দূর থেকেও কাছে থাকি, হৃদয়ের উষ্ণতায়। করোনামুক্ত, আশাদীপ্ত সোনালী সকালের প্রত্যাশায়। সামাজিক নয় শারীরিক দূরত্বে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের মেলবন্ধনে নিশ্চিত হোক আগামীর নিরাপত্তা। সবাইকে ঈদ-উল-ফিতরের আন্তরিক শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক ।
বিল্লাল বিন কাশেম গল্পকার ও প্রবন্ধকার। bellalbinquashem@gmail.com