অবকাঠামো সংকট। নেই বিচারকদের বসার পর্যাপ্ত জায়গা। মামলা ভারে ফাইল রাখার জায়গার সংকুলান। প্রয়োজনের তুলনায় বিচারক নেই। যারা আছেন তাদেরও কর্মদিবস চলে এজলাস ভাগাভাগি করে। বিচারিক আদালতের অধিকাংশ বিচারকেরই যাতায়াতে গাড়ি নেই। এ জন্য মধ্যাহ্ন ভোজে গিয়ে সময়মতো এজলাসেও ফিরতে পারেন না। ফলে অনেক আদালতে লাঞ্চের পর এজলাসই বসে না। রয়েছে বিচার সহায়ক লোকবলেরও সংকট। এমন নানা ধরনের সমস্যা নিয়েই চলছে বিচার বিভাগ। সংকট সমাধানে কোনো পদক্ষেপই কাজে আসেনি। যুগ যুগ ধরে বহুবিধ সংকটে পড়ে অধস্তন আদালতের বিচারকরা মামলার ভারে জর্জরিত। মামলা নিষ্পত্তিতে গতি ফেরাতে গিয়েও দেরি হচ্ছে।
ফলে ট্রাইব্যুনালগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে মামলার মহাজট। শুধু নিম্ন আদালতই নয়, মামলার পাহাড় জমেছে উচ্চ আদালতেও। গেল এক দশক ধরে মামলা দায়েরের চেয়ে মামলা নিষ্পত্তির হার ছিল নিম্নমুখী। এতেই অনিষ্পন্ন মামলা বেড়েছে নজিরবিহীনভাবে। জট নিরসনে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েও কাজের কাজ হয়নি। সব উদ্যোগই মুখথুবড়ে পড়েছে। বর্তমানে উচ্চ আদালতসহ সারা দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ।
এসব মামলার নিষ্পত্তি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিচার বিভাগ। মামলাজট কমাতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বিচারক ও এজলাসের সংখ্যা বাড়ানো, আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জনবল বৃদ্ধি, আইনের পুনর্বিবেচনা, বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, মামলা ব্যবস্থাপনা ও বিচার প্রশাসনে তদারকি বাড়ানো এবং সেকেলের আইনের বিশ্লেষণ করেও জট কমানো যাচ্ছে না। দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ মিলে প্রায় দীর্ঘ দেড় বছর আদালতের নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।
এতে সীমাহীন সংকট সৃষ্টি হয়েছে বিচার বিভাগে। জটের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, মূলত মামলাজট শুরু হয় নিম্ন আদালত থেকে। কিন্তু এ জট কমাতে আগে থেকেই সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। করোনার সময়ে অপরাধ, গ্রেপ্তার, মামলাও হয়েছে। তবে সে হারে মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। উচ্চ আদালতেও এর প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু পরিকল্পনা নিয়ে নিম্ন আদালতের কর্মঘণ্টা বাড়ানো, হাইকোর্টের সব বেঞ্চে রিট আবেদন, ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার শুনানির এখতিয়ার, বাৎসরিক অবকাশ কমানো গেলে কিছুটা হলেও জট কমানো সম্ভব হবে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, নানা চেষ্টার পরও কোনোভাবেই বিচারে দীর্ঘসূত্রতা কমানো যাচ্ছে না। মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে সীমাহীন খরচে হাবুডুবু খাওয়ার পাশাপাশি পারিবারিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। অনেক সংসারই ধ্বংস হয়ে যায় মামলায় জড়িয়ে। ঘরের সোনা-গয়না বিক্রি করে মামলা চালানো, শখের জিনিস বিক্রি করে মামলা চালানোর ঘটনাও ঘটে। এছাড়া ভূমি-সংক্রান্ত মামলার পেছনে যুগের পর যুগও পার করেছেন দেশের লাখ লাখ মানুষ।
আইনজীবীর ফি, বিভিন্ন নথির সই, মুহুরি, নকল সংগ্রহ, যাতায়াত, খাবার ও আনুষাঙ্গিক খাতে সীমাহীন খরচ মেটাতে গিয়ে ভিটেমাটি বিক্রির ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত। তবে বিচারপ্রার্থী নিঃস্ব হলেও অর্থ-বিত্তে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন আদালতকেন্দ্রিক পেশাজীবী শ্রেণি। কেউ কেউ গড়ছেন আলিশান অট্টালিকাও। মামলার নথি দেখা, হাজিরা দেয়া, ওকালতনামায় সই করা, জামিননামা দেয়া, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলা-সংক্রান্ত যেকোনো কাজে ‘বখশিশ’ বা ‘খরচাপাতি’র নামে বিচারপ্রার্থীর কাছ থেকে আদায় করা হয় বাড়তি পয়সা। কম এগিয়ে নন এক শ্রেণির আইনজীবী এবং তাদের সহায়করা।
এমনকী মাঝেমধ্যে লঘুদণ্ডের মামলা নিষ্পত্তিতেও কেটে যায় যুগের পর যুগ। মামলা শেষ করতে আদালতে হাজিরা দিয়ে ক্লান্ত হন বিচারপ্রার্থীরা। অনেকে হাজিরা খরচ ও মামলার ব্যয় মেটাতে নিঃস্ব হয়ে বিক্রি করেন জমি-জিরাতও। তবুও মামলা শেষ হয় না। নিষ্পত্তিতে নিযুক্ত আইনজীবীরও নেই তোড়জোড়। মামলা জিইয়ে রেখেই হাজিরাপ্রতি মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা— এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এদিকে তদন্ত, চার্জশিট দাখিলে গাফিলতি ও সময়মতো সাক্ষী হাজির না হওয়াই মামলা নিষ্পত্তির মূল বাধা, এমনটিই জানান আইনজীবীরা।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, হাইকোর্টের বিচারপতিরা গড়ে প্রায় ১৫ জন অধস্তন আদালতের বিচারকের কার্যক্রম তদারক ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই তদারকটা পূর্ণমাত্রায় ক্রিয়াশীল হলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। কমবে মামলাজটও, এমনটিই মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সময় উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল তিন লাখ ১৩ হাজার।
ওই সময় উভয় বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ছিল ৮১ জন। বর্তমানে উভয় বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ৯৭ জন। মামলার সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতে আরও বিচারপতি বাড়ানোর মত দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের উচ্চ আদালতে বিচারপতির সংখ্যা অনেক কম। ফলে মামলাজট বাড়ছে, বিচার নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে, পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে দুর্ভোগ কমছে না।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫৩টি। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ১৭ হাজার ৫৪৭ এবং হাইকোর্ট বিভাগে পাঁচ লাখ ১৮ হাজার একটি মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া অধস্তন আদালতে গত জুন পর্যন্ত ৩৬ লাখ ৬৩ হাজার পাঁচটি মামলা ছিল বিচারাধীন। মামলার অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা না বাড়ায় মামলাজট ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
অবকাঠামোগত সংকটও রয়েছে অনেক জেলা আদালতে। সরকার বিচার বিভাগের সংকট নিরসনে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও তা যথেষ্ট নয়। তবে দীর্ঘদিন আদালতে মামলা নিষ্পত্তির মন্থর গতির মধ্যে গেল ৯ মাসে মামলা নিষ্পত্তিতে ইতিহাস গড়েছে বিচার বিভাগ। বেড়েছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিও।
এতে প্রধান ভূমিকা রাখছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে নবগঠিত মনিটরিং কমিটি। এখন মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। গত দুই বছরের মামলাজট পর্যালোচনায় দেখা যায়, সরকার ও বিচার বিভাগ কার্যকর কিছু উদ্যোগ নেয়ায় অধস্তন আদালতে মামলা দায়ের অপেক্ষা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা বিভাগে দুই লাখ ৬১ হাজার ৬২৬টি এবং চট্টগ্রামে এক লাখ ৩২ হাজার ৫০৮টি। দায়ের ও নিষ্পত্তি বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে। এ বিভাগে ৪৭ হাজার ৯০৪টি মামলা হলেও নিষ্পত্তি হয়েছে ৫১ হাজার ৮১১টি। অর্থাৎ পুরোনা মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে তিন হাজার ৯০৭টি।
সার্বিকভাবে মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির গড় ৯১ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। যদিও গত বছর করোনার কারণে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি দুই-ই কম ছিল। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে মামলা হয় ছয় লাখ ৫৫ হাজার ৯৮১টি। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয় তিন লাখ ৯০ হাজার ৩১১টি মামলা।
চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে দেশের অধস্তন আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ লাখ ৭২ হাজার ২৪৮টি মামলা। ১১ লাখ ৯ হাজার ৫৩৯টি মামলার মধ্যে এই নিষ্পত্তি হয়েছে। অধস্তন আদালতে এ বছরের প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মামলা নিষ্পত্তির হার ছিল শতকরা ৮৫ শতাংশ। কিন্তু পরবর্তী তিন মাস অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তা বেড়ে শতকরা ১০১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর সবশেষ তিন মাস তথা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ১০৫ শতাংশে।
তবে ফৌজদারি মামলার চেয়ে দেওয়ানি মামলা বেশি নিষ্পত্তি হয়েছে। আর সব বিভাগের মধ্যে নিষ্পত্তির হার সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে। এদিকে এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অধস্তন আদালতে সর্বমোট দুই লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৫টি দেওয়ানি মামলা দায়ের হয়েছে। আর নিষ্পত্তি হয়েছে দুই লাখ ৭৪ হাজার ৪৯৯টি দেওয়ানি মামলা।
এ সময়কালে দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তির হার শতকরা ১০২ শতাংশ। একই মেয়াদে ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছে আট লাখ ৪০ হাজার ৬০৪টি। আর নিষ্পত্তি হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার ৭৪৯টি। ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তির হার শতকরা ৯৫ শতাংশ। অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগে গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট দায়ের হয়েছে ৬৪ হাজার ৬৪১টি মামলা। আর নিষ্পত্তি হয়েছে ৫০ হাজার ৯১০টি মামলা। হাইকোর্ট বিভাগে মামলা নিষ্পত্তির হার শতকরা ৭৯ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি একান্ত প্রয়োজন। এতে তাড়াতাড়ি মামলা নিষ্পত্তি হবে। সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। মামলা ফাইল হলে এটা মীমাংসা করা যায়। পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ক্রিমিনাল মামলাও এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। এ ব্যবস্থা না হলে বিচার ব্যবস্থায় ধস নামবে। জনগণ দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচার পাচ্ছে না। এডিআরের ফলে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মামলা করার প্রবণতা দূর হবে।
মামলাজট কেমন হবে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মামলাজট শুরু হয় বিচারিক আদালত থেকে। কিন্তু এ জট কমাতে আগে থেকেই সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। এখন থেকে পরিকল্পনা নিয়ে নিম্ন আদালতের কর্মঘণ্টা বাড়ানো, হাইকোর্টের সব বেঞ্চে রিট আবেদন, ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার শুনানির এখতিয়ার, বাৎসরিক অবকাশ কমানো গেলে কিছুটা হলেও জট কমানো সম্ভব হবে।
সূত্রঃ মানবজমিন, যুগান্তর ও আমার সংবাদ পত্রিকা।