সব
facebook apsnews24.com
তালাক, হিল্লা বিবাহ আইন, সামাজিক প্রথা ও কঠিন বাস্তবতা - APSNews24.Com

তালাক, হিল্লা বিবাহ আইন, সামাজিক প্রথা ও কঠিন বাস্তবতা

তালাক, হিল্লা বিবাহ আইন, সামাজিক প্রথা ও কঠিন বাস্তবতা

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম

তালাক হচ্ছে একজন মুসলিমের জন্য সবচেয়ে নিকৃষ্তম ভালো কাজ যা কোরান-হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। তালাক দেয়ার নিয়ম-কানুন বা তালাক কার্যকরী নিয়ে যত সব বিভ্রান্তমূলক তথ্য ও প্রশ্ন রয়েছে যেমন তালাক দিতে বিয়ের কাবিননামা প্রয়োজন আছে কি-না, তালাকের নোটিশ পাঠানোর নিয়ম-কানুন কি, কাজীর কাছে কখন, কিভাবে যেতে হবে, কি কি কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হবে, কত টাকা খরচ হবে, হিল্লা বিবাহ তালাকের আগে না পরে, তালাক কার্যকর হওয়ার যথাযথ নিয়ম কি কি ঘরে বসে এ সকল প্রশ্নের সঠিক আইনী সমাধান জানতে নিবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন। আজকের এই নিবন্ধে তালাক হিল্লা বিবাহ নিয়ে সমাজ, সামাজিক প্রথা কি ভাবে দেখে এবং পুরো বিষয়টি বাস্তবতার নিরিখে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। তবে আইন কানুনের বিষয় লিখতে গেলে তথ্যের উৎস বা বাক্যের গঠনে হুবহু বিদ্যমান আইন তুলে ধরা লাগে।বই পত্রে বা পত্র-পত্রিকায় এসব বিষয় নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে সেখান থেকে বা পত্রিকার কলাম থেকে আইনের বিষয় হওয়ায় কখনোও কখনো ও লেখার মধ্যে বা বাক্যে মিলে যেতে পারে। তাই লেখক হিসেবে এই অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে তথ্যের সকল উৎস্যের প্রতি শুরুতেই কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখছি।

তালাক কখন, কেন এবং কিভাবে দিবেন-

আপনি চাইলে তালাক ঘরে বসেই দিতে পারেন। তাই তালাক দেওয়ার জন্য কাজীর কাছে কিংবা কোর্ট কাচারীতে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই, এমনকি বিয়ের কাবিননামারও কোন প্রয়োজন পড়ে না। মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন পূর্ণ বয়স্ক এবং সুস্থ মস্তিস্কের স্বামী বা স্ত্রী যে কোন সময় একে-অপরকে তালাক দিতে পারেন। কিন্তু এজন্য আইনের বিধান মেনেই তা করতে হয়। বিধান না মানলে আইনে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তালাক দেবার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে যে, স্বামী বা স্ত্রী তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যাকে তালাক দিচ্ছেন তিনি যে এলাকায় বসবাস করছেন সে এলাকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর মেয়র/সিটি কর্পোরেশন মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে। সেই সাথে তালাক গ্রহীতাকে অর্থাৎ আপনি যাকে তালাক দিচ্ছেন তাকে উক্ত তালাক নোটিশের নকল কপি প্রদান করতে হবে। অনেকে তালাক দিয়ে তালাকের কপি চেয়ারম্যান কিংবা যাকে তালাক দেয়া হয় তাকে না পাঠিয়ে তিন মাস পরে পাঠাবেন তাহলে তালাক কার্যকর হবে-এমন ভ্রান্ত ধারনা নিজের মনের মধ্যে লালন পালন করে থাকেন। তাদের উদ্দেশ্যে এ লেখা, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারনা এবং আপনারা এখনও ভুলের মধ্যে রয়েছেন। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তালাকের নোটিশটি কত সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। আইনে বলা আছে তালাক দেয়ার পর যথাশীঘ্রই সম্ভব তালাকের নোটিশ পাঠাতে হবে। কাজেই তালাক দিয়ে তালাকের নোটিশ নিজের কাছে বা ঘরের মধ্যে রেখে দিলে তালাক হবে না।

তালাকের নোটিশ কিভাবে লিখবেন-

তালাকের নোটিশ কিভাবে লিখতে হবে সে বিষয়টি ও জেনে রাখা জরুরী।তালাক প্রদানের জন্য আইন নির্দিষ্ট কোনো ফরম বা বক্তব্য নির্ধারণ করেনি।আপনি ঘরে বসে নোটিশ লেখা কাজটি নিজেই লিখতে পারেন। তালাক দেয়ার কারণ, আপনি কথাগুলো একটি সাদা কাগজে লিখে এটাকে তালাকের নোটিশ হিসেবে পাঠাতে পারেন। নোটিশ পাঠানোর কাজটি আপনি নিজেও করতে পারেন, আবার অন্য কাউকে দিয়েও করাতে পারেন। নোটিশ পাঠানোর কাজটি ডাকযোগেও হতে পারে, আবার সরাসরিও হতে পারে। ডাকযোগে রেজিষ্ট্রি করে এ/ডি সহযোগে পাঠালে ভাল হয়। আর সরাসরি পাঠালে নোটিশের এক কপি করে রিসিভ করে নেয়া ভাল। চেয়ারম্যান/মেয়র নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো তালাক বলবৎ হবে না। কারন নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ (৭ ধারা) গঠন করে থাকে। এর মধ্যে প্রতি ৩০ দিনে একটি করে মোট তিনটি নোটিশ দেবে তালাকদাতা ও তালাকগ্রহীতাকে। এর মধ্যে আপোষ মীমাংসা হয়ে গেলে যিনি তালাক দিয়েছেন, তিনি নোটিশ প্রত্যাহার করলে তালাক আর কার্যকর হবে না। তবে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে গর্ভকাল শেষ হওয়ার পর তালাক কার্যকর হবে। সমঝোতার ৯০ দিন সময় চেয়ারম্যান কর্তৃক নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে শুরু হয়। তালাক দেয়া বা নোটিশ লেখার তারিখ থেকে শুরু হয় না। এ প্রসঙ্গে ৪৬ ডি.এল.আর. (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা ৭০০ তে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। আর মনে রাখবেন নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই যদি কেউ অন্য কারও সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে উক্ত বিয়ে অবৈধ বলে গণ্য হবে। এ বিষয়ে ১৫ ডি.এল.আর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা-৯ তে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। কারণ তালাক সম্পূর্ণ কার্যকরী না হওয়া পর্যন্ত পক্ষগন আইনসম্মতভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই থেকে যায়। এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রী কে ভরণপোষণও দিতে বাধ্য। এখানে বলে রাখা দরকার যে, নোটিশ পাঠানোর কোনো দায়িত্ব বিধিবদ্ধভাবে কাজির নেই। যিনি তালাক দিলেন, তিনিই কাজটি করবেন। তবে কোনো তালাকদাতা যদি নিজের অসামর্থ্য বা অজ্ঞতার কারণে কোনো কাজিকে ওই কাজের উপযুক্ত ব্যক্তি বলে মনে করেন, তবে তিনি কাজীকে দিয়ে নোটিশ পাঠানোর কাজটি করাতে পারেন। লাইসেন্সপ্রাপ্ত দেশের বেশির ভাগ কাজিই ‘মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭(১) ধারায় তালাকের নোটিশ’ ধরনের শিরোনামযুক্ত নোটিশ নিজেরাই ছাপিয়ে রেখেছেন এবং সেগুলো দিয়ে যার যার চাহিদামতো তালাকের নোটিশ পাঠাচ্ছেন।

তালাক কার্যকর কখন, কিভাবে-

জেনে রাখা ভালো যে, নোটিশ পাঠানো এবং ৯০ দিন অতিক্রান্ত হলেই তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। আপনাকে এর জন্য আর কাজীর কাছে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ তালাক রেজিস্ট্রি আইনে বাধ্যতামূলক নয়। বিয়ে রেজিস্ট্রি যেমন বাধ্যতামূলক এবং বিয়ে রেজিষ্ট্রি না করলে আইনে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তালাক রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে এরকম বাধ্যবাধকতা কিংবা কোন শাস্তির ব্যবস্থা নেই। তবে তালাক নোটিশ প্রাপ্তির পর ৯০ দিন পার হলে তালাক যদি কার্যকর হয়, তখনই কেবল তা রেজিস্ট্রি করার সুযোগ আসবে। কোনো তালাক রেজিস্ট্রি করার আগে ওই তালাকটি বিধি অনুযায়ী কার্যকর হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা কাজির রয়েছে।

তালাক প্রদানের পরে উহার নোটিশ কয়টি পাঠাতে হয়, একটি, দু’টি না তিনটি-তা নিয়ে আমাদের সমাজে বেশ ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অনেকে বলে থাকে তিন মাসে তিনটি নোটিশ পাঠাতে হয়। প্রকৃতপক্ষে তালাকের একটি নোটিশ একবারই পাঠাতে হয়। আর এই নোটিশ কিভাবে পাঠাবেন, পাঠানোর নিয়মাবলী কি, যথাযথ নিয়ম মেনে না পাঠালে আইনে কি শাস্তির বিধান রয়েছে-এসব বিষয়ে আইনী আলোচনা জানুন। আগেই বলা হয়েছে যেকোনো যুক্তিসংগত কারণে মুসলিম স্বামী বা স্ত্রী একে অপরকে তালাক প্রদান করতে পারেন। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭(১) ধারা অনুযায়ী, কেউ তালাক দিতে চাইলে, তালাকের নোটিশ নিজেই তৈরী করে কিংবা কারো মাধ্যমে তৈরী করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাকে তালাক দিচ্ছেন, তিনি যদি ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় বসবাস করেন, তাহলে সেই ইউপি চেয়ারম্যানকে উক্ত তালাকের নোটিশ দিতে হবে। আর তিনি যদি পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাস করেন তাহলে পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কাছে লিখিত নোটিশ পাঠাতে হবে। ওই একই নোটিশের একটি কপি যাকে তালাক দিচ্ছেন অর্থাৎ তালাক গ্রহীতাকে পাঠাতে হবে। আর মনে রাখবেন তালাকের নোটিশে দু’জন উপযুক্ত সাক্ষীর কলাম রাখবেন এবং তাদের স্বাক্ষর নেবেন। অনেকেই মনে করেন তালাকের নোটিশ কাজির মাধ্যমে না পাঠালে তা কার্যকর হয় না। এটি ভুল ধারনা। তালাকের নোটিশ স্বামী বা স্ত্রী যিনি তালাক দিবেন, তিনি নিজে নিজেই কিংবা কারো মাধ্যমে লিখিত আকারে পাঠিয়ে দিলেই হবে।

তালাকের নোটিশ পাঠাবেন যেভাবে-

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে তালাকের নোটিশ পাঠাতে কাজীর কাছে যেতে হবে-এমন কোন কথা লেখা নেই। এখন জানার দরকার, আপনি নোটিশটি কিভাবে চেয়ারম্যান মহোদয় ও তালাক গ্রহীতার কাছে পাঠাবেন। আপনি দুটি উপায়ে স্ব-স্ব ব্যক্তির কাছে তালাকের নোটিশ পাঠাতে পারেন।

ক) সরাসরি তালাকের নোটিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট পৌঁছে দিয়ে রিসিভ কপিতে স্বাক্ষর করিয়ে নিতে পারেন। খ। সরকারী ডাক যোগে অর্থাৎ পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে প্রাপ্তি স্বীকার সহ রেজিস্ট্রি করে চিঠি সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় পাঠাতে পারেন। এতে সুবিধা বেশী এবং আইনী জটিলতা কম। কারণ সংশ্লিষ্ট ঠিকানার ব্যক্তিদ্বয় চিঠি গ্রহণের পর প্রাপ্তি স্বীকার ডকুমেন্টস আপনার নিকট ফিরে আসে।

তালাকের নোটিশ গ্রহণ না করলে তালাক কার্যকর হবে কি-না অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন। যাইহোক আপনি এই নিয়মে তালাকের নোটিশ পাঠালে তালাক গ্রহীতা নোটিশ গ্রহণ না করলে কেন গ্রহণ করেননি তা পোষ্ট অফিসের মন্তব্য সম্বলিত নোটিশটি আপনার নিকট ফেরত আসবে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী সিরাজ প্রামাণিক তার কলামে লিখেছেন চিঠির খামের উপর লেখা থাকে ‘প্রাপক চিঠি গ্রহণ না করায় ফেরত’ অথবা ‘গ্রহণে অস্বীকৃতি’ অথবা ‘খুঁজে পাওয়া গেল না’ ইত্যাদি। যেদিন চিঠিখানা আপনার নিকট ফিরে আসবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন পার হয়ে গেলে তালাক আপনা আপনিই কার্যকর হয়ে যাবে। অনেকে নোটিশ গ্রহণ না করে মিথ্যা বলে থাকে যে তালাকের নোটিশ পায়নি। তারা নিছক বোকার মতো কাজ করে থাকে।

তালাকের নোটিশ পাওয়ার পরে যা ঘটে-

তালাকের নোটিশ যে পক্ষ থেকেই দেওয়া হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান বা মেয়র নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষের মনোনীত প্রতিনিধি নিয়ে সালিসি পরিষদ গঠনের জন্য প্রতিনিধির নাম চেয়ে উভয়ের কাছে লিখিত চিঠি পাঠিয়ে থাকেন। প্রথম নোটিশে কোনো পক্ষ হাজির না হলে পরবর্তী দুই মাসে আরও দুটি নোটিশ পাঠিয়ে থাকেন। সমঝোতার চেষ্টা সফলও হতে পারে, ব্যর্থও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সালিসি পরিষদের কাজ হলো আপসের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, না সফল হয়েছে, তা তাদের রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা। তবে চেয়ারম্যান বা মেয়র মহোদয় আপনাদের কাছে চিঠি পাঠাতে কিংবা সালিশী পরিষদ গঠনে বাধ্য নয়। কারণ, আইনে তাদের এ বিষয়ে বাধ্য করা হয়নি। সেকারণ দেখা যায়, চেয়ারম্যান বা মেয়র মহোদয় তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির পর কোন সালিশী পরিষদ গঠন কিংবা কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। ফলে নোটিশ প্রাপ্তির ৯০ দিন পার হলেই তালাক আপনা আপনিই কার্যকর হয়ে যায়। তবে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে গর্ভকাল শেষ হওয়ার পর তালাক কার্যকর হবে।

তালাক রেজিস্ট্রি করার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। যিনি তালাক দিয়েছেন, তিনি ৯০ দিন পর তালাকের নোটিশ, নোটিশ পাঠানোর ডাক রশিদ, প্রাপ্তি স্বীকার পত্র, আর যদি নোটিশ গ্রহণ না করে সেক্ষেত্রে ফেরত সম্বলিত নোটিশ এগুলো সংগ্রহ করে আপনার এলাকার কাজী অফিসে যাবেন তালাকটি নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন করতে। মুসলিম বিবাহ ও তালাক বিধিমালা ২০০৯-এর ২১ বিধি অনুযায়ী তালাক নিবন্ধনের জন্য ৫০০ টাকা ফি গ্রহণ করতে পারবেন তালাক রেজিস্ট্রার। নকল প্রাপ্তি ফি বাবদ নেবেন মাত্র ৫০ টাকা। বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার কাজী যদি আপনার বাড়িতে গিয়ে তালাক রেজিস্ট্রি করেন, তাহলে যাতায়াত বাবদ প্রতি কিলোমিটার ফি নিবেন ১০ টাকা আর পরবর্তীতে তালাক রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত সার্টিফাই কপি নিতে গেলে তল্লাশি ফি বাবদ নেবেন মাত্র ১০ টাকা।

কোনো কারণে কাজী মহোদয় তালাক নিবন্ধন অস্বীকার করলে অস্বীকারের তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে জেলা রেজিস্ট্রার অফিসার এর কাছে আপিল করার বিধান আছে। তবে আনন্দের সংবাদ এই যে, বিয়ে রেজিস্ট্রি না করলে যেমন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, এক্ষেত্রে তালাক রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক কিংবা শাস্তির কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কাজেই নিয়ম মেনে তালাকের নোটিশ পাঠানো ও উক্ত ডকুমেন্টসগুলো সংগ্রহে রাখলেই তালাক কার্যকরে আইনত কোন বাঁধা নেই।

আবার ১৯৬১ এর ৭(১) নং ধারার বিধান অনুযায়ী তালাকদাতা যদি চেয়ারম্যান ও তালাক গ্রহীতাকে তালাকের নোটিশ প্রদান না করে তাহলে ৭ (২) ধারা অনুযায়ী তালাকদাতা শাস্তি পাবে ঠিকই, কিন্তু তালাক বাতিল হবে না। উক্ত তালাক কার্যকর হবে।

আপনাদের জানিয়ে রাখার মতো আরও আরেকটি বিষয় রয়েছে, যেমন নোটিশ পাঠালেই কিন্তু তালাক কার্যকর হয়ে যায় না। নোটিশ পাঠানোর পরে ৯০ দিন পার হওয়ার আগেই যদি আপনাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়, তাহলে আপনি একই নিয়ম অনুসরণ করে তালাক প্রত্যাহার করে নিতে পারেন এবং একই স্ত্রীর সাথে হিল্লা বিয়ে বাদেই ঘর সংসার করতে পারেন, এতে আইন ও ধর্মের কোথাও বাঁধা নেই। আর যদি ৯০ দিন অতিক্রান্ত এমনকি কয়েক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও আপোষ হয়ে যায়, তাতেও একই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঘর সংসারে আইন ও ধর্মের কোথাও বাঁধা নেই। এক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রম রয়েছে যে, পূণরায় বিয়ে করে নিতে হবে।

হিল্লা বিবাহ নিয়ে যত কথা-

এবার আসি হিল্লা বিবাহ নিয়ে আমাদের সমাজ কি ভাবনা ভাবে? হিল্লা বিয়ে একটি কুসংস্কার ও আমাদের দেশের প্রচলিত আইন বিরোধী। তালাকের পর নিয়ম মেনে একই ব্যক্তির সাথে বিয়ে করতে আইনে কোথাও বাঁধা নেই। মুসলিম আইনে এ ব্যপারে যথাযথ বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ‘নানা মুনির নানা মত’ নিয়ে শরিয়া নিয়মের অজুহাত দেখিয়ে কারও কারও দাম্পত্য জীবন বিষিয়ে তোলা হয়। মূলত হিল্লা বিয়ে হচ্ছে, তালাক হওয়া একই নারী বা পুরুষের মধ্যে পূণরায় বিয়ে হওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় কোন ব্যক্তির কাছে একটি নিয়মের মাধ্যমে বিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া। ২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ এ জাতীয় হিল্লা বিয়ে, ফতোয়াকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেছেন। হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে এই রায়ে বলা হয়েছে, হিল্লা বিয়ের ফতোয়া হচ্ছে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা নম্বর ৭ এবং বাংলাদেশ দন্ডবিধির ধারা নম্বর ৪৯৪, ৪৯৮, ৫০৮ ও ৫০৯ লংঘন করা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ নম্বর ধারাটি আমাদের সমাজে কতটুকু মানা হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে সাধারণ জনগণ বা কথিত ইসলামী চিন্তাবিদরা কতটুকুই বা জানে। ‘১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭-এ বলা আছে, কোনো লোক যদি তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, তাহলে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে যত শিগগির সম্ভব লিখিত নোটিশ প্রদান করতে হবে এবং এর একটি কপি স্ত্রীকে দিতে হবে। নইলে তালাক কার্যকর হবে না। সুতরাং এখানে মৌখিক তালাকের অকার্যকরতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

এ ধারায় বলা হয়েছে, নোটিশ জারি হওয়ার পর ৯০ দিন অতিবাহিত না হলে তালাক কার্যকর হবে না। পূর্ণভাবে তালাক কার্যকর হওয়ার পর স্ত্রী যদি স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চান, তবে কাবিনের মাধ্যমে যথাযথ আইনগত পদ্ধতিতে পূণরায় বিয়ে করলেই যথেষ্ট হবে। এক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে সাময়িক বিয়ের প্রয়োজন নেই এবং তা তিন বার পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে। তবে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে হিল্লা বিয়ের কিছু সংশোধিত বিধি লিপিবদ্ধ আছে। দম্পতির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তালাক হয়ে যাওয়ার পর যদি উভয় পক্ষ মনে করেন তাঁরা পূর্বাবস্থায় ফিরতে ইচ্ছুক, তবে বিয়ের কাবিন মোতাবেক তৃতীয় বার পর্যন্ত পূণর্বিবাহ করা যায়। কিন্তু তৃতীয়বারের পরে হিল্লা বিয়ের প্রয়োজন হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের কিছু বিধান নিয়ে মতভেদও রয়েছে। কিন্তু এই আইনের একটি ধারায় বলা আছে, এ আইন দেশে বলবৎ অন্য যে কোনো আইন বা প্রথা থেকে প্রাধান্য পাবে।

হিল্লা বিবাহ ও ফতোয়ার প্রভাব-

ফতোয়া কি? বিষয়টি জেনে রাখি। ফতোয়া আরবী শব্দ যার অর্থ হচ্ছে ‘আইন সম্বন্ধীয় মত।’ যিনি ধর্মীয় আইনবিশেষজ্ঞ বা ফিকাহশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি তিনি ফতোয়া দিতে পারেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে যখন শরিয়ত-সম্পর্কিত অনুশাসন গুলোতে কোনো জটিল প্রশ্নের সরাসরি মীমাংসা পাওয়া যায় না, তখন মুফতিরা সাধারণত ফতোয়ার মাধ্যমে পূর্ববর্তী নজির এনে সমাধান দেন। বর্তমানে যেসব ফতোয়া জারি করা হচ্ছে, তার মধ্যে দোররা মারা, পাথর ছুড়ে মারা, জুতাপেটা, মাথার চুল কেটে দেওয়া, বেঁধে পেটানো, মাটিতে অর্ধেক পুঁতে পাথর ছোড়া, হিল্লা বিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এসব নির্দেশ কোনো মতেই ফতোয়ার সুষ্পষ্ট সংজ্ঞাকে সমর্থন করে না। সব ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার-সম্পর্কিত যেসব বিধান আছে এর ২৭, ২৮, ৩১,ও ৩৫ অনুচ্ছেদের সরাসরি লংঘন। ২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের বেঞ্চ থেকে ফতোয়াকে যে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়, তা সাইফুল ও শাহিদা দম্পতির মৌখিক তালাক ও হিল্লা বিয়েকে কেন্দ্র করে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া হয়। উক্ত রায়ে স্পষ্টভবে বলা হয়, এসব ফতোয়া বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনসহ বিভিন্ন আইনের লংঘন করা হচ্ছে। রায়ে বলা হয় কেবল তিনবার ‘তালাক’ (একবারে, বা এক এক করে তিনবারে) করলেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না৷ এই চর্চা কোরান, হাদীস এমনকি মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ (ধারা-৭) এরও বিরোধী৷ ‘স্বামী কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদের এই অসাধু পন্থা এবং এর অপপ্রয়োগ নবী স্বয়ং নিজেও দৃঢ়ভাবে নিষেধ করেছেন৷’ বাংলাদেশে হিল্লা বিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ ও আইনত দন্ডনীয়। হিল্লা বিয়ের উপস্থিত অতিথিসহ কাজীর ৬ মাসের জেলের বিধান করে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান হিল্লা বিয়ে নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আইন করেন। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ৭(৬) ধারা অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে, তালাক হওয়া দম্পতি আবার বিয়ে করতে চাইলে হিল্লা বিয়ে ছাড়াই পূণরায় বিয়ে করতে পারবে।

পরিশেষে বলতে চাই সঠিক নিয়মে তালাক প্রদান করার পর উহা কার্যকর হওয়া এবং না হলে আইন ও ধর্মমতে বিবাহের নৈতিক অবস্থান ও তৎপরবর্তীতে বিবাহের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসা সন্তানাদির ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিষয়ে পিতা-মাতা বা তালাক দাতা ও গ্রহীতার অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে। তাছাড়া হিল্লা বিবাহের বিষয়টি আরও জটিল এবং হিল্লা বিবাহের মাধ্যমে বিবাহকে নিয়মিত করার প্রক্রিয়া কঠিন হওয়ায় উহাকে ধর্মীয় রীতিতে ও আইনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। যাইহোক আমরা তালাক বিষয়ে বিস্তারিত জেনে বুঝে প্রয়োগ করার চেষ্টা করবো এবং আরও চেষ্টা করবো যেন কোনভাবেই তালাকের দিকে যেতে না হয়। সামান্য ভুল বোঝাবুঝি নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে সংসার টিকয়ে রাখতে পারলেই বিবাহের সার্থকতা। তাছাড়া তালাক প্রদানের বিষয়টি শুরুতেই মীমাংসা করতে খুব সহজেই মামলাজট বা মামলাধিক্য কমানো যায়।

লেখক: মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, কলামিস্ট ও আইন গবেষক,

ইমেইল: bdjdj1984du@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :

মরু অঞ্চলে বৃষ্টি ও বন্যা, প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

মরু অঞ্চলে বৃষ্টি ও বন্যা, প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

স্বাধীনতা দিবসের ভাবনাগুলো

স্বাধীনতা দিবসের ভাবনাগুলো

১৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটা স্মরণীয় দিন

১৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটা স্মরণীয় দিন

সর্বনাশা পরকীয়া, কারণ ও প্রতিকার

সর্বনাশা পরকীয়া, কারণ ও প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মূল্যবোধের অবক্ষয় এর শেষ কোথায়!

মূল্যবোধের অবক্ষয় এর শেষ কোথায়!

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj