২৫ জুন একটি ইতিহাস রচনার দিন। বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টোল প্লাজায় নিজ হাতে টোল দিয়ে সেতু এলাকায় প্রবেশ করেন। বেলা ১২টার দিকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও মুরাল-১ উন্মোচন করেন সরকারপ্রধান। ফলক উন্মোচন শেষে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দেন প্রধানমন্ত্রীসহ উপস্থিত অতিথিরা।
উদ্বোধনী ফলক উন্মোচনের পর প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়ি ছুটে চলে প্রমত্তা পদ্মার ওপর দিয়ে। আর এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসা দেশের ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উন্মোচন হলো, খুলে গেল এক নতুন দুয়ার। এই একটি সেতুর কারণে পুরো দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবনাধারা এখন পাল্টাবে অবহেলিত জেলাবাসীর।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকল দিনক্ষণটি। দেশের টাকার নিজেদের সেতুটি আজ সবার কাছে অহংকারের প্রতীক, জানান দিল সক্ষমতার এক বাংলাদেশের। যান চলাচলের জন্য আগামীকাল রোববার (২৬ জুন) সকাল থেকে উন্মুক্ত করা হবে স্বপ্নের এ সেতুটি।
পানি প্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরই পদ্মা নদীর অবস্থান। এমন খরস্রোতা নদীতে নির্মিত হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সেটা বাঙালি জাতির গর্ব ও অহংকার। বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা এই প্রকল্প উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শনিবার (২৫ জুন) রচিত হলো নতুন ইতিহাস।
সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবির ভাষায় বলেছেন, ‘যতবারই হত্যা করো, জন্মাবো আবার; দারুণ সূর্য হবো, লিখবো নতুন ইতিহাস।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক রঞ্জিত হয়েছে ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্ত ধারায়। কিন্তু বাঙালি আবার সদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।’
উৎসবের এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আসুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই ঐতিহাসিক দিনে যে যার অবস্থান থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার শপথ নিই, এ দেশের মানুষের ভাগ্য পবির্তন করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।’
সুধী সমাবেশে বক্তব্যকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোটি কোটি দেশবাসীর সঙ্গে আমিও আজ আনন্দিত, গর্বিত এবং উদ্বেলিত। অনেক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে আজ বহু কাঙ্ক্ষিত সেতু দাঁড়িয়ে গেছে। এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহার কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয়।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘সম্মানিত সুধীমণ্ডলী, আজকে বাংলাদেশ আনন্দিত। আমিও আনন্দিত এবং গর্বিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেই আমরা আজকে এই পদ্মা সেতু নির্মাণ সক্ষম হয়েছি।’
স্বপ্নটা দেখা শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে ২০০১ সালে। সেই বছর ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জায়ামাত জোট। ধীরে ধীরে গতিহীন হয়ে পড়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পটি। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। কনসালট্যান্ট সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করে। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে সরকার। কিন্তু কথিত দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন থেকে পিছিয়ে যায় বিশ্বব্যাংক। এ পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের আবেদন বিশ্বব্যাংক থেকে ফিরিয়ে নেয় সরকার। যদিও পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ কানাডার আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। নানা অভিযোগ ষড়যন্ত্র চাপ উপেক্ষা করে ২০১২-এর ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে।
২০১২ সালের ৪ জুলাই সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ জুলাই আবারও সংসদে দাঁড়িয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ জাতির সামনে বক্তব্য তুলে ধরেন তিনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতু নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বসে পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান। আর শেষ স্প্যান বসে ১০ ডিসেম্বর ২০২০ সালে। এতে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু। এরপর থেকে সেতুর অন্যান্য কার্যক্রম শেষ করার মাধ্যমে প্রস্তুতি নিতে থাকে উদ্বোধনের।
পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার। পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার স্বপ্নের কাঠামো নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।
গত কয়েক দিন ধরেই সেতুটির উদ্বোধনকে ঘিরে সারাদেশে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল। প্রতিটি জেলায় উৎসব করতে নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রাজধানীও সেজেছে নতুন আমেজে। মানুষের মধ্যে অন্যরকম উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে।
সকালে হেলিকপ্টারে পৌছে মাওয়া প্রান্তে সেতু উদ্বোধনের পর সুধী সমাবেশে অংশ নেন সরকারপ্রধান। এরপর মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীঘাট এলাকায় জনসভায় বক্তব্য দেবেন শেখ হাসিনা। সমাবেশ সফল করতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
জনসভাস্থল, নৌপথ ও স্থলপথে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন আইন- শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে সার্বিক নিরাপত্তায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সাড়ে পাঁচ হাজার সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন। এজন্য সাজানো হয়েছে ত্রিমাত্রিক নিরাপত্তা বলয়। সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। র্যাবের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।