মো. তাজুল ইসলাম। ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, ঝিনাইদহের বিচারক (যুগ্ম জেলা জজ)। মেধা, বিচক্ষণতা আর সৃজনশীলতায় মামলা দ্রুত পরিচালনার সুনাম আছে তার। গত বছর ও করোনা সংকটের আগে মোট ১৫ মাসে প্রায় দুই হাজার মামলা নিষ্পত্তি করেন তিনি। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে তিনি ভাষাশহীদদের স্মরণে ২১-এর ৪ গুণ মোট ৮৪টি মামলার রায় দেন।
১৯৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর সাতক্ষীরায় জন্ম নেওয়া তাজুল ইসলাম ২০০০ সালে এসএসসি এবং ২০০২ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০০২-২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ২০০৬ সালে এলএলবি (সম্মান) এবং চাকরিকালে সরকারের অনুমতি নিয়ে এলএলএম ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্পেশাল মাস্টার্স করেন।
২০০৮ সালে তৃতীয় বিজেএস (২০০৭ সালে আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস হওয়ার পরে প্রথম বিজেএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওই বছরেরই ২২ মে সহকারী জজ হিসেবে যোগ দেন তিনি। আজ তার চাকরিজীবনের ১২ বছর বা এক যুগ পূর্ণ হবে। এ উপলক্ষে তার মুখোমুখি হয় এপিএস নিউজ২৪.কম। সাক্ষাৎকারে তার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া, সৃজনশীলতা, মামলার পক্ষগুলোর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত উঠে আসে।
তিনি মনে করেন, দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন, আর তাই তিনি এত রায় দিতে পারছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, জনগণ যদি তাদের দায়িত্বের জায়গায় সৎ আর সচেতন হয়, তাহলে অনেক মামলা সহজেই সমাধান করা সম্ভব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এপিএস নিউজ২৪.কম প্রদায়ক নুরন্নবী সবুজ।
প্রশ্নঃ দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আপনার বেলায় কোন বিষয়টি কাজ করে?
মোঃ তাজুল ইসলামঃ ন্যায়বিচার পাওয়া সবার সাংবিধানিক অধিকার। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আমাদের শুধু সাংবিধানিক দায়িত্ব নয়, নৈতিক দায়িত্বও। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি যেমন আমি গুরুত্বের সাথে করি, তেমনি মামলার অন্যান্য নথিপত্র নিয়ে অফিস সময়ের বাইরে ঘাটাঘাটি করি, বাদী-বিবাদী পক্ষদ্বয়ের আচরণসহ সংশ্লিষ্ট আইন নিয়ে পড়াশোনা করি। এভাবে আইনের ভিতর থেকে আইনি প্রতিকার সবার জন্য সমানভাবে নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা থাকে। বাদী-বিবাদীর মামলার দীর্ঘসূত্রতার কষ্ট্বোধের পাশাপাশি আইনগত যে দায়িত্ব তা আমাকে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সাহস জোগায়।
প্রশ্নঃ দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য আর কাদের ভূমিকা প্রয়োজন?
মোঃ তাজুল ইসলামঃ বিচার প্রক্রিয়ায় আইন, আইনজীবী বা বিচারকরাই শুধু ভূমিকা পালন করেন তা না, বরং বাদী-বিবাদী পক্ষের ওপর তার অনেকাংশে নির্ভর করে। আদালতের প্রত্যেক কর্মচারীর ভূমিকাও এতে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মামলা জট নিরসন করার জন্য সব রকম ব্যবস্থা আমরা নিয়ে রেখেছি। কিন্তু তারপরেও মামলা জট কমানো যাচ্ছে না। কর্মজীবনের শুরু থেকেই এই বিষয়টি নিয়ে আমার যথেষ্ট ভাবনা ছিল। আর তাই সবার সহযোগিতায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। আদালতের সব কর্মচারী, বাদী-বিবাদী পক্ষসহ আইনজীবীদের আন্তরিকতায় দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। সবার আন্তরিকতা আর ভালোবাসা অর্জন ছাড়া এটি সম্ভব ছিল না।
প্রশ্নঃ ন্যায়বিচার বলতে কী বোঝেন?
মোঃ তাজুল ইসলামঃ সাধারণ জনগণ যেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, আর অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে যেন তার প্রতিকার হয়, পাশাপাশি যে অপরাধী তার শাস্তি ও সংশোধনের ব্যবস্থাই সহজ কথায় ন্যায়বিচার। আপনি শুধু অধিকার ফিরিয়ে দেবেন, কিন্তু যে অধিকার কেড়ে নিচ্ছে তার শাস্তি দেবেন না, তাহলে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে না। যার যা আইনত প্রাপ্ত শাস্তি বা প্রতিকার তা নিশ্চিত করাই ন্যায়বিচার। আর আইনের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচারের আলাদা ব্যাখ্যা, সেগুলোও মানতে হয়।‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তিটি ন্যায়বিচারের জন্য যথেষ্ট এবং আমি তা মেনে চলি এবং ন্যায়বিচার বলতে আমিও সেটি বুঝি।
প্রশ্নঃ আইনের শাসন, বিচারে প্রবেশাধিকার– এই বিষয়গুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
মোঃ তাজুল ইসলামঃ মনে করেন একটি আইন তৈরি করা হলো, বিচারকরা চাইলেই যে কারো সাজা ঘোষণা করতে পারে। বা এমন বলা হলো বিচারকরা যা বলবে তা-ই চূড়ান্ত। এই আইনের মাধ্যমে শাসন করে যদি বলা হয় এটাই আইনের শাসন তাহলে তো হয় না। আইনের শাসন বলতে বোঝায় জনগণ-বান্ধব ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য যে আইন ও আইনের প্রয়োগ। আর বিচারে প্রবেশাধিকার বলতে বোঝায় আপনি যদি কারো মাধ্যমে অধিকার থেকে বঞ্চিত হন বা কেউ আপনার ক্ষতি করে তাহলে আপনার মামলা করার অধিকার। মামলার কারণ তৈরি হলে আপনি মামলা করতে পারবেন, আর আদালত সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ন্যায়বিচার দেবে।
প্রশ্নঃ বিচার বিভাগ কি স্বাধীন?
মোঃ তাজুল ইসলামঃ আপনাকে একটি গাড়ির লাইসেন্স দিয়ে বলা হলো আপনি গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে স্বাধীন। এখন আপনি কি যেমন-তেমনভাবে গাড়ি চালাবেন নাকি কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চালাবেন। কিছু নিয়মের মধ্যে থাকা স্বাধীনতার হরণ নয়, বরং তা মঙ্গলজনক। বাংলাদেশ সংবিধানের ২২ নং অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হয়েছে। ১১৬ক অনুচ্ছেদে আমরা দেখতে পাই বিচার বিভাগ স্বাধীন অবস্থায় আছে। অনেকেই মনে করে বিচার বিভাগ স্বাধীন অবস্থায় নেই, কিন্তু এটা তো সত্য নয়। বিচার বিভাগ স্বাধীন বলেই ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে কারো হস্তক্ষেপ ছাড়াই আমি এত রায় দিতে পারছি।
প্রশ্নঃ বিচার কাজের পর বাকি সময় কেমন করে কাটান?
মোঃ তাজুল ইসলামঃ অফিস সময়ের পর যে সময়টুকু পাই তা পরিবারকে দেই। এর বাইরে প্রতিদিন কোনো না কোনো আইনের নতুন বিষয় শেখার চেষ্টা করি। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে লিখে থাকি। আর মামলার বিষয়বস্তু নিয়ে একটু কাজ করি। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আরো পড়াশোনা করি, মামলার শুনানির সময়গুলো মনে করা- এসব নিয়েই সময় চলে যায়।
প্রশ্নঃ একজন বিচারককে কি কঠোর নাকি নরম হওয়া দরকার?
মোঃ তাজুল ইসলামঃ বিচারক তো সাক্ষ্য-প্রমাণ অনুযায়ী রায় দিবেন। তার এখানে নরম বা কঠোর হবার তো কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তবে বিচারককে যেহেতু আইন অনুযায়ী বিচার করতে হবে, তাই তার জন্য আইন জানা ও প্রয়োগবিধি বোঝা বেশি জরুরি। এই প্রয়োগবিধির ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা খুব বেশি কাজে দেয়। বিচারককে তাই হতে হবে আইন বিশ্লেষক ও গবেষক, যে আইনের তথ্য আর বাস্তবতা সমন্ধে ভালো জ্ঞান রাখবে এবং নিজের বিচারের জায়গায় হবে সৎ আর দৃঢ। বিচারক আইন ও তার বাস্তবতা অনুযায়ী আইন প্রয়োগ করবে। তার আইনের বাইরে যাবার সুযোগ খুবই সীমিত।
প্রশ্নঃ মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমাতে আপনার পরামর্শ কী?
মোঃ তাজুল ইসলামঃ বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইনের ওপর গবেষণার সুযোগ বাড়াতে হবে। তাদের মাঠ পর্যায়ে কাজ করাতে হবে যাতে তারা জনগণকে আইন সম্বন্ধে সচেতন করতে পারে। পাশাপাশি মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আইনের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষা দিলে জনগণ আরো বেশি সচেতন হতে পারবে এবং আদালত সম্পর্কে তাদের ভীতি দূর হয়ে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। জনগণ যদি তাদের দায়িত্বের জায়গায় সৎ আর সচেতন হয় তাহলে অনেক মামলা সহজেই সমাধান করা সম্ভব। মামলার পক্ষ-বিপক্ষও অনেক সময় দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে চায় না। আইনজীবী এবং বিচারকদের মাঝে যদি কোনো ঘাটতি থাকে তা দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব, কিন্তু জনগণ সচেতন না হলে এসব তেমন কোনো কাজে আসবে না। জনগণের সচেতনতা আগে তৈরি করতে হবে। পাশাপশি বারবার টাইম পিটিশন, আপিল, রিভিউ, রিভিশন ইত্যাদির বিধানগুলো সহজ প্রক্রিয়ায় আনতে হবে।
প্রশ্নঃ বিচারকের পেশাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মোঃ তাজুল ইসলামঃ প্রথমত, আমি এই কাজকে পুরোপুরি সেবা হিসেবে দেখি। সমাজে শৃঙ্খলা আনতে আইন ও তার সঠিক প্রয়োগ অবশ্যই দরকার। এতে যদি সামান্য বিচ্যুতি ঘটে তাহলে সমাজের কাঠামোতে নেতিবাচক প্রভাব শুরু হয়, যার কুফল সব মানুষের ওপর পড়ে। ডাক্তাররা একজন ব্যক্তির রোগ সারাতে ভূমিকা রাখে, কিন্তু বিচার বিভাগ পুরো সমাজের রোগ সারাতে পারে। আমি এবং আমাদের বিচার বিভাগ সেই কাজ যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে করছে। বিচার বিভাগে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আশা করি বিচার বিভাগ তার সকল প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে। জনগণ ও সমাজের সেবা করার এই পেশা আমার কাছে গর্বের ।
প্রশ্নঃ বিচার বিভাগের কোন কোন সমস্যা আছে বলে আপনার মনে হয়?
মোঃ তাজুল ইসলামঃ আপনাকে এর আগেও কিছু কিছু বিষয় বলেছি। আইনজীবী বা বিচারকরা অনেক আন্তরিকতার সাথে মামলার নিষ্পত্তি করতে চাইলেও মামলার পক্ষগণ অনেক সময় তাতে আন্তরিক থাকে না। অনেকেই ব্যক্তিগত জেদের বশে মামলা করে বছরের পর বছর ধরে মামলা চালায়। গ্রামের বা এলাকার কিছু দালাল টাইপের ব্যক্তি এর থেকে সুবিধা পায় বলে তারা পক্ষগণকে এই কাজে উৎসাহিত করে। জনগণের কাছে যদি আইন ও আইনের বিষয়ে সহজে জানার মাধ্যম থাকত, তাহলে নাগরিক সচেতনতা বিচার বিভাগের কাজের গতি আরো দ্রুত করত। আমাদের আইনগুলোর কিছু কিছু সংশোধনী আনলে ভালো হয়। অধিকাংশ আইন যেগুলো আদালতে প্রায়ই প্রয়োগ করা হয় তা ব্রিটিশ আমলের, তাই বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে তার পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা জরুরি। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি জোরদার করতে হবে। যেসব আ্দালতের নিজস্ব কোনো স্টাফ আজও নিয়োগ হয়নি, সেখানে দ্রুততার সাথে প্রয়োজনীয় কর্মচাঋ নিয়োগ দিতে হবে। বিচারক নিয়োগ ও বিচার বিভাগে বিচারকের অপ্রতুলতা দূর করতে হবে। বাংলাদেশে বিচার বিভাগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। খুব দ্রুত আমরা আমাদের ছোটখাটো দুর্বলতাও কাটিয়ে উঠব।
প্রশ্ন: দেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন এবং কোন বিষয়টি পাল্টে দিতে খুব ইচ্ছে হয়?
মোঃ তাজুল ইসলাম: দেশ নিয়ে অনেকের মতো আমারও অনেক স্বপ্ন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া এই বাংলাদেশ নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সবার জন্য নিরাপদ আবাসভূমি হবে সেই স্বপ্ন সব সময় দেখি। তাই মনে হয়, আমাদের দেশে যদি সবকিছু আইন মেনে চলত! সবাই যদি করোনার সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলত, তাহলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করোনামুক্ত দেশ যদি পেতাম! যদি সুযোগ থাকত, তাহলে একটি বিষয় পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সেটা হলো— মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস ভীতি ভয়ানক রকমের ইনটলারেন্স বাড়ার কারণে যে অশান্তি ও সংকট চলছে সারা বিশ্বজুড়ে, সেটি পাল্টে দিতে ও আগের মতো শান্ত পৃথিবী দেখতে খুব ইচ্ছে হয়।
( এপিএস নিউজ২৪.কম/পিটিআই)