মোশাররাফ হোসেন
বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরে ভারাক্রান্ত চিত্তে বলেছিলেন – ” পাকিস্তান আমার সব কিছু নিয়া গেছে, কিন্তু সব চোরের গুষ্টি রাইখা গেছে । সবাই পেল স্বর্ণের খনি, আমি পেলাম চোরের খনি”। হ্যাঁ, স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানিরা আমাদের সব নিয়ে গেলেও চোর গুলো কিন্তু রেখেই গেছে। পৃথিবীর সব দেশের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপক চোর বসবাস করে। সর্বশেষ দেখলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে গরীব দুখী অসহায় মানুষের পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে উপহার হিসাবে ২৫০০ টাকা প্রদান কার্যক্রমে এই চোরদের দৌরাত্ম।
আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামে আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে।গ্রামের কথা মনে এলেই মনের মধ্যে ভেসে ওঠে সুশীতল ছায়া ঘেরা কোনো দৃশ্যের ছবি। ফসলের মাঠের মাঝ দিয়ে আঁকা বাঁকা সরু মোঠো পথ। সবুজ গ্রামের মধ্যে উঁকি দেওয়া সবুজ গাছের সারি। গ্রামের মানুষগুলোও যেন ছিল একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। একে অপরের সুখে-দুখে এগিয়ে আসত।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে গ্রামীণ সমাজের চিত্র সংঘাতময় হয়ে উঠছে। মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসে ধরেছে চিড়। জনপ্রতিনিধিরা জনসেবা ছেড়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে; রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার মাত্রা বাড়িয়ে দলীয় আনুগত্যে এগিয়ে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বে অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়ছে ব্যাপকভাবে। রাজনৈতিক পরিচয়ে বেশি পরিচিত হওয়ায় মানুষের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাবের ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। গ্রামীণ নেতৃত্ব বদলে যাচ্ছে, নেতৃত্বে আসছে তরুণরা। কিন্তু তারা শাসনের পরিবর্তে শোসন ও স্বার্থপরতার মন্ত্রণা পাচ্ছে অগ্রজদের কাছ থেকে। ফলে তাদের কাছে গ্রামে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বিধান করা, আইন-শৃঙ্খলা ও শান্তি নিশ্চিত করা, শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীর শাস্তি দেয়া ও শায়েস্তা করা, গ্রামের লোকদের মধ্যে বিরোধ, ঝগড়া-বিবাদ প্রভৃতি নিবৃত্তি করার চেয়ে নিজের পকেট ভারি করাটাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
সাম্প্রতিক ত্রাণের খাদ্যপণ্য চুরিসহ লুটেরা জনপ্রতিনিধিদের ঘৃণ্য চেহারা দেখার পাশাপাশি এখন বাটপার জনপ্রতিনিধিদের মুখ দেখারও দুর্ভাগ্য হচ্ছে জাতির। সরকারি ত্রাণ দেয়ার ক্ষেত্রে নানারকম জটিলতা পাকিয়ে মূলত: চাল-আটার বস্তাগুলো নিজস্ব গোডাউনে ঢুকানোর কুটকৌশলে ব্যস্ত তারা।
গ্রামের অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি অল্প শিক্ষিত। এই অল্পশিক্ষিত লোকেরাই বাংলাদেশে প্রাচীন কালের চৌর্যবৃত্তি সিঁধেল চোর নামক শব্দটাকে আবার জনসম্মুখে নিয়ে আসছে। এদেশের চোরের গুষ্টি গুলোর চৌর্যদোষ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চোরের গুষ্টির চেয়েও কিন্তু ব্যাপক মারাত্বক, ভয়ংকর, নির্লজ, বেহায়া ও চরিত্রহীন। ঋতু বা কাল পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের চৌর্যবৃত্তির ধরনটাও বদলিয়েছে। কালক্রমে তারা কম্বল চোর, চাউল চোর, ডাল চোর, গম চোর, আলু চোর, আটা চোর, তেল চোর, ঢেউটিন চোর, মাছ চোর, মসজিদের জুতা চোর, ব্যাংক বীমা চোর, শেয়ার বাজার চোর নামক তকমা নিজেদের গায়ে লাগিয়েছে।
তবে হ্যাঁ এখনও ভাল মানুষ এই পৃথিবীতে বিরাজমান। গুটি কয়েক অসৎ জনপ্রতিনিধির জন্যে পুরা সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে না। সৎ এবং যোগ্য জনপ্রতিনিধিরাও তাদের জীবন বাজি রেখে যে জনসেবা করে যাচ্ছেন সেটাও নেহাত কম নয়। ভাল মন্দ মিলেই আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা।
লেখকঃ মোশাররাফ হোসেন, ব্যাংকার ও সমাজসেবক।