রাজধানীর গুলশানের হোলে আর্টিসান বেকারিতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা, নুসরাত হত্যা মামলা, রিফাত হত্যা মামলা, অভিজিৎ হত্যা মামলা ও দীপন হত্যা মামলা নিম্ন আদালতের রায়ের পর এখন উচ্চ আদালতে। উচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে এসব মামলায় নিহতদের স্বজন ও দেশবাসী। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনে উচ্চ আদালতে স্বাভাবিক বিচারকার্যক্রম বন্ধ থাকায় শুরু হয়নি এসব মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন করোনায় আদালতের নিয়মিত বিচারকার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তা আবার শুরু হলে এসব মামলার শুনানি শুরু হবে।
হোলে আর্টিসান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা : রাজধানীর গুলশানের হোলে আর্টিসান বেকারিতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। নৃশংস সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০১৯ সালের নভেম্বরে নিম্ন আদালতে সাত উগ্রবাদীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। তবে সেই রায়ের পর দেড় বছর পার হলেও রায়ের ডেথ রেফারেন্স শুনানি এখনো শুরু হয়নি হাইকোর্টে। এ কারণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রায় কার্যকর এখনো সম্ভব হয়নি। তবে এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক তৈরি শেষ হয়েছে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানিয়েছেন।
তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হোলে আর্টিসান মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য পেপার বুক গত বছরই প্রস্তুত হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে নিয়মিত আদালতের কাজ বিঘœ ঘটায় শুনানি শুরু হয়নি। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেই একটি বেঞ্চ নির্ধারণের মাধ্যমে এ মামলা শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হোলে আর্টিসান রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে বিদেশী নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করেন নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন নব্য জেএমবির (আত্মঘাতী) সদস্যরা। তাদের গুলিতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে পাঁচ উগ্রবাদী নিহত হন।
২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর এ মামলার বিচারকাজ শেষ হয়। ওই দিনই আদালত রায় ঘোষণার জন্য ২৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেন। রায়ে মামলার আট আসামির সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। আসামিরা হলো- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন। এ ছাড়া ঘটনার সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
নুসরাত হত্যা মামলা : করোনাভাইরাসের কারণে বহুল আলোচিত ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিল শুনানি শুরু হয়নি। উচ্চ আদালতের নিয়মিত বেঞ্চ শুরু হলেই আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হবে। শুনানির জন্য বেঞ্চও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। হাইকোর্টে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নুসরাত হত্যা মামলার পেপারবুক প্রস্তুতের পর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। গত বছরের মার্চ মাস থেকে নুসরাত হত্যা মামলা হাইকোর্টের কার্যতালিকায় রয়েছে। কিন্তু মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে এই মামলার শুনানি আটকে আছে।
নুসরাত হত্যা মামলায় ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর রায় দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাতকে হত্যার দায়ে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এরপর ২৯ অক্টোবর ডেথ রেফারেন্সের জন্য নুসরাত হত্যা মামলার রায়সহ নথিপত্র হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আসে। নুসরাত হত্যা মামলায় দণ্ডিত সব আসামি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।
রিফাত হত্যা মামলা : বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলা হাইকোর্টে আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় আছে। এই মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেয়া প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, পেপারবুক প্রস্তুত হলেই রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও দ্রুত শুনানি হয় সে বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নেবো। গত বছরের ৪ অক্টোবর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মিন্নিসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামির ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে।
অভিজিৎ হত্যা মামলা : বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার মামলা এখন হাইকোর্টে। লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়াসহ পাঁচ উগ্রবাদীর ডেথ রেফারেন্স ও মামলার নথি হাইকোর্টে আসে। এখন এ মামলার পেপারবুক প্রস্তুত হলেই আপিল শুনানির উদ্যোগ নিতে পারবে রাষ্ট্রপক্ষ। অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার মামলায় সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়াসহ পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং উগ্রপন্থী ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
দীপন হত্যা মামলা : জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলা এখন উচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আট উগ্রবাদীর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। এখন আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত করবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আটজনের ফাঁসির রায় দেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো: মজিবুর রহমান।
রায়ে আট আসামির সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে জিয়াসহ দু’জন পলাতক রয়েছেন। বাংলাদেশে লেখক-প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর ধারাবাহিক হামলার মধ্যে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ে আক্রান্ত হন দীপন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে দীপনকে গলাকেটে হত্যা করা হয়।