মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
করোনা মহামারিতে প্রায় ১৬ মাস স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা কোভিড-১৯ আসায় সারাবিশ্বে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। এর মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন তথা শতবর্ষ উদযাপন করা করোনা পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে সম্ভব নয়। কেননা করোনাভাইরাসে দফায় দফায় লকডাউন, বিধিনিষেধ ও ১ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে। চলাচল সীমিত করা হয়েছে। যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জন্মশতবার্ষিকী অনাড়ম্বর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পালিত হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে ১ জুলাই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। যারা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসে এবং পড়াশোনা করেছে তারা এই দিনে তথা জন্মশতবর্ষে অবশ্যই নিজ উদ্যোগে হৃদয় দিয়ে পালন করবে।
বাংলাদেশ ক্রমশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দিকে ধাবমান। কোনো দেশ বিভিন্ন সূচকে যখন এগুতে থাকে তখন সেদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত দিক বিবেচনায় রাখা হয়। টেকসই উন্নয়ন তথা শিক্ষাক্ষেত্রে কেমন উন্নতি করল তাও দেখা হয় কঠোরভাবে। টেকসই উন্নয়নের অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে শিক্ষাক্ষেত্রে। বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে ১০০০ ইউনিভার্সিটির তালিকায় নাম না থাকাটা তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের বেশি সময় পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৩ জারি করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণ–আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ওঠে। ইতিমধ্যে অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের নেতৃত্বে শিক্ষকদের একটি কমিটি স্বায়ত্তশাসনের বিভিন্ন দিকের ১৪ দফা সংবলিত একটি খসড়া তৈরি করেন এবং তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের প্রতিনিধি এয়ার মার্শাল নূর খানের সঙ্গে দেখা করে এই সব প্রস্তাব পেশ করেন (মনিরুজ্জামান মিয়া, রিভিজিটিং দ্য ডি ইউ অর্ডার, ১৯৭৩, দ্য ডেইলি স্টার, ১২ মে ২০০৮)।
বাংলাদেশের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভূত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনস্বীকার্য ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা তথা গবেষণার দিকে কোনো সরকারই ঠিকভাবে মনোযোগ না দিতে পারায় বর্তমান বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা ও র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়েছি যা সত্যিই হতাশার ও উদ্বেগের। সাম্প্রতিককালে প্রিয় বিদ্যাপিঠের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও সেখানকার বিরোধী মত ও পথের কন্ঠরুদ্ধ থাকায় ঠিক খোলস থেকে বের হতে পারছে না।
১৯৯০ সালের পরে ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ ঢাকসু নির্বাচন হলেও সেখানে গণতন্ত্র চর্চার সুষ্ঠু বিকাশ না হওয়ায় ছাত্রদের মৌলিক সমস্যা সমাধানেও খুব বেশি এগুতে পেরেছে বলে মনে হয় না। যাইহোক তবুও ঢাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারাটা ইতিবাচক এবং ভবিষ্যতে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করা ও হওয়ার পথ তৈরি যে হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত রিপোর্ট মতে লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রতি বছর বিশ্বের বিশ্ব্যবিদ্যালয়গুলোর যে র্যাংকিং প্রকাশ করে তাতে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এক হাজারের পরে। তালিকাটিতে ৯২টি দেশের ১৩শ বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের এই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই এই তালিকাতে স্থান পেয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম, সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, এখাত থেকে আয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতাসহ ৫টি মানদণ্ড বিশ্লেষণ করে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। র্যাংকিংয়ে বিদেশি ছাত্রের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে শূন্য। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়টির ৪ হাজার ১০৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থী নেই কিংবা থাকলেও সেই সংখ্যা সন্তোষজনক নয়। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ছয়শ থেকে আটশর মধ্যে। তবে এর বছর দুই পরেই এটির অবস্থান হঠাৎই নেমে যায়। ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান গিয়ে দাঁড়ায় এক হাজারেরও পরে। এ বছরই মে মাসে সাময়িকীটি এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই তালিকায় উল্লেখিত এশিয়ার ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও উল্লেখ ছিল না। এই র্যাংকিং বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে একটা ধারনা ও বার্তা দিয়ে যাচ্ছে যেটি কোনোভাবেই কাম্য এবং সুখকর নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর বেশ ভালোভাবেই এগুচ্ছে। সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকাও রাখছে। কিন্তু শিক্ষার মৌলিক কাঠামোতে তত অগ্রসর হয়নি বলে শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এজন্য শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে অতিমাত্রায় জড়িয়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন অনেকেই। বিগত এক যুগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যতটুকু পিছিয়ে গেছে সেখান থেকে বের হতে অনেক সময় লাগতে পারে। শিক্ষকদের মূল কাজ পাঠদানে মনোযোগী হওয়া, গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করা ইত্যাদি বেশি জরুরি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পড়াশোনা ও গবেষণা বাদ দিয়ে ভালো একটা পদ বাগিয়ে নিতে রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন। এত করে ওই শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও পুরো জাতি ও সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এই লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি পরিহার করে বঙ্গবন্ধু ও মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা ও উন্নয়নের রাজনীতিতে শিক্ষকদের সক্রিয় হতে হবে।
তাছাড়া ছাত্র রাজনীতি যাতে বিকশিত হয় এবং সব দলের অংশগ্রহণে যেন সেটা হয় সে বিষয়ে নীতি নির্ধারকদের দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। ছাত্রদের সংসদ সচল ও গণতান্ত্রিক করে তুলতে হবে। ছাত্র সংসদের সকলেই যদি ক্ষমতাসীন দলের হয় তাহলে সাধারণ ছাত্ররা জিম্মি হয়ে যায়। সাধারণ ছাত্রদের পক্ষেও কথা বলার নেতা ও প্রতিনিধি থাকতে হবে। ছাত্রদের আবাসিক সমস্যা সমাধানে ও হলে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে হলে ছাত্রদের সকল দলের অংশগ্রহণে হল ছাত্র সংসদ গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে ভালো শিক্ষার পরিবেশ গড়ে উঠবে না। ভালো ও সাধারণ পড়ুয়া ছাত্ররা হলে থাকতে নিরুৎসাহিত হবে। আগামীদিনে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে ছাত্র সংসদকে গণতান্ত্রিকভাবে চলার সুযোগ করে দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি তথা শিক্ষা ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এবং বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে যে যে পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
১) গবেষণা ও শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম, সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, এখাত থেকে আয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
২) করোনা পরিস্থিতিতে বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করে পাঠদান ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৩) জার্নাল প্রকাশনা বাড়িয়ে ভালোমানের গবেষকদের উৎসাহিত করতে হবে।
৪) ঢাকসু নির্বাচন নিয়মিত অনুষ্ঠিত করে ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হতে হবে।
৫) হল ছাত্র সংসদকে সব দলের অংশগ্রহণে করতে হবে।
৬) ছাত্রদের আবাসন সংকট দূর করতে হবে।
৭) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পাশাপাশি প্রত্যেকটি আবাসিক হলে উন্নতমানের লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৮) হলের ভিতরে ছাত্রদের উন্নত ও মানসম্পন্ন খাবার নিশ্চিতে মনিটরিংসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
৯) শিক্ষক রাজনীতি করতে গিয়ে শিক্ষকদের মূল কাজ পাঠদান হতে সরে গেলে চলবে না।
১০) ছাত্র, শিক্ষক, ও কর্মকর্তা সুচিকিৎসার ব্যবস্থাসহ চিকিৎসা বা মেডিকেল বিষয়ে ব্যাপক উন্নতি সাধনে মনোযোগী হতে হবে।
১১) করোনার সময়ে শিক্ষাকার্যক্রম যাতে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা কীভাবে নেওয়া যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
১২) বিষয়ভিত্তিক কর্মক্ষেত্র ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক।