সব
facebook apsnews24.com
অর্পিত সম্পত্তি: প্রাসঙ্গিক ভাবনা - APSNews24.Com

অর্পিত সম্পত্তি: প্রাসঙ্গিক ভাবনা

অর্পিত সম্পত্তি: প্রাসঙ্গিক ভাবনা

রাজীব কুমার দেব

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার রাজনৈকিত টানাপোড়নের কারণে অদ্ভূত ১৭ দিন ব্যাপি স্থায়ী ”তাসখন্দ যুদ্ধ” স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছে ”অর্পিত সম্পত্তি” নামক ”বিষফোড়া”। প্রায় ৫৩ বছর ধরে লালিত ”বিষফোড়া” কে প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রণয়ন ও জারী করতে হয়েছে অধ্যাদেশ, আইন, বিধিমালা এবং সরকারি আদেশ। আবার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কে বিচারিক পর্যবেক্ষণে রাখার নিমিত্তে তার সাথে যোগ হয়েছে মহামান্য উচ্চালাতের দিকনির্দেশনা মূলক প্রশসংশনীয় ভূমিকা। তবে বিদ্যমান আইনি অস্পষ্টীকরণ ”অর্পিত সম্পত্তি” র প্রকৃতিগত অবস্থান প্রয়োগে দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি করেছে।

তাসখন্দ চুক্তির পর তৎকালীন ভারত সরকার শত্রু সম্পত্তি অধ্যাদেশ রহিত করলেও তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যে সকল নাগরিক ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের আগে থেকে ভারতে ছিল এবং ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভারতে চলে গিয়েছিল, পাকিস্তান সরকার তাদেরকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করত: তাদের বাড়িঘর ও জমিজমা ”শত্রু সম্পত্তি” হিসেবে তালিকাভূক্ত করে যা ”সেনশাস লিস্ট” নামে পরিচিত।

অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ”শত্রু সম্পত্তি” কে ”অর্পিত সম্পত্তি” নামে এর উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্তির জন্য সরকার অথবা সরকার নির্দেশিত কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করার উদ্যেগ গ্রহণ করা হয়।

তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেমন- উপ তত্ত্বাবধায়ক (পরিচবালক, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ) শত্রু সম্পত্তির (জমি ইমারত) দখল গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনা, শত্রু সম্পত্তি (জমি ও ইমারত) চিহ্নিতকরণ, দখলগ্রহণ এবং অনধিক এক বছরেরর জন্য ইজারা প্রদান, অর্পিত সম্পত্তির (জমি ও ইমারত) ব্যবস্থাপনা, প্রশাসন ও বিলিবন্টন সংক্রান্ত বিস্তারিত নির্দেশাবলী (চার খন্ড), লুক্কায়িত অর্পিত সম্পত্তি” ইত্যাদি।

বাংলাদেশ সংবিধানের সম্পত্তির অধিকার ”অর্পিত সম্পত্তি” কে চূড়ান্তভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ১৯৬৯ সালের অধ্যাদেশ রহিতের সাথে সাথেই আইনটি বাতিল ও মৃত এবং ১৯৭৪ সালের পর নতুন কোনো সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা যাবে না মর্র্মে উচ্চাদালতের মত প্রকাশের পর সাংবিধানিক প্রশ্নটি স্পষ্ট হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাজু হোসেন বনাম বাংলাদেশ, আরতি রাণী পাল বনাম সুদর্শন কুমার পাল এবং অন্যান্য (যথাক্রমে ৫৮ ও ৫৬ ডিএলআর) উল্লেখযোগ্য।

বর্তমানে ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ও ২০১২ সালের অবমুক্তি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনে অর্পিত সম্পত্তিকে প্রত্যার্পণযোগ্য সম্পত্তি, অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি এবং প্রত্যার্পণযোগ্য জনহিতকর সম্পত্তি নামে তিন শ্রেণীতে ভাগ করে মূল মালিক বা উত্তরাধিকারী বা স্বার্থাধিকারী বা ইজারা বা অন্য কোনভাবে দখলখার সহ-অংশীদার বরাবরে ফেরত দেওয়ার বিধান করা হয়েছে।

সম্প্রতি ১৯৭৪ ও ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশ, অধ্যাদেশ অনুবলে গৃহীত কার্যক্রম, ১৯৭৪ সালের আইনের পরবর্তী সময়ে অন্তর্ভূক্তিকরণ এবং ২০০১ সালের আইনের ৬ (গ)(ঘ) ধারা কে চ্যালেন্জ (রিট নং ৮৯৩২/১৮) করা হলে উচ্চাদালত চ্যালেনজকৃত আইনটি বাতিল না করে ”ঐতিহাসিক ভূল” হিসেবে বিবেচনা করে ৯ দফা নির্দেশনা সহ সিদ্ধান্ত দেন। যেমন – ১৯৭৪ সালের পর অন্তর্ভ্ক্তূকরণে দায়ী ব্যক্তি আদালত অবমাননায় দোষী হবেন; আইনগত দাবিদারবিহীন অর্পিত সম্পত্তি শুধু মানবিক উন্নয়নকাজে ব্যবহার করতে হবে; সরকারের অনুকূলে অর্পিত সম্পত্তি ব্যবহারের জন্য আইন করতে হবে; আইনগত দাবিদারকে ফেরত দেওয়া না হলে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে আইন করতে হবে ইত্যাদি।

এই রায়ের নির্দেশনা অনুসারে আইন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন মূলে ভবিষ্যতে অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন না করার বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশনা জারির নিমিত্তে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও ভূমি সচিবকে চিঠি দিয়েছেন। তবে নতুন আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বিজ্ঞ ট্র্যাইব্যুনুল কে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যার সমাধান আইনে নেই। যেমন-
প্রথমত:– অ্যাবেটেড মামলার বাদীর নাম যদি ২০১২ সালের তালিকাতে অন্তর্ভূক্ত না হয়ে নালিশী সম্পত্তি তালিকাভূক্ত হয়, তদক্ষেত্রে বাদীর কি প্রতিকার তা আইনে বলা নেই।
দ্বিতীয়ত:-প্রকাশিত তালিকায় যদি কোন ভূল থাকে সেই ভূল সংশোধনের বিষয়ে নতুন আইনে কোন ব্যবস্থা নেই।
তৃতীয়ত:-নতুন আইনে দরখাস্ত মনজুর হওয়ার পর প্রার্থীকের নামে লেটেস্ট রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধনী বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস ও প্রার্থীক উভয়ে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে সংশোধন বা নামজারী প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি করছে। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণায়ের প্রজ্ঞাপন মূলে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না।
চতুর্থত:– একই দাগের তালিকাভূক্ত সম্পত্তি দুইজন আলাদা আলাদা ভাবে ট্র্যাব্যুনালে আবেদন করলে একটি আবেদন ইত:মধ্যে মনজুর হলে অপর বিচারাধীন আবেদনটি অবমুক্ত নাকি খারিজ হবে নতুন আইনে কিছু বলা নেই।
পন্চমত:- সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস যদি একাধিক দাগ বিশিষ্ট খতিয়ানের একটি দাগ তালিকাভূক্ত
হওয়ার কারণে খাজনা গ্রহণ না করে নতুন আইনে সমাধানমুলক নির্দেশনা নেই।
ষষ্টত:– অর্পিত আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন করতে না পারলে ফলাফল কি হবে তা বলা নেই। কিন্তু আইন বিজ্ঞানের মৌলিক নীতি অনুসারে আইনগত ফলাফলের অনুপস্থিতিতি প্রতিকারবিহীন অবস্থায় থাকবে না। পক্ষান্তরে ”প্রত্যার্পণযোগ্য সম্পত্তির দাবিতে নূতন মামলা দায়ের বা দাবী উত্থাপন নিষিদ্ধ ” বিধানটি নির্দিষ্ট সময়ের পর নতুন মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে নয়।

এমতাবস্থায় নির্ধারিত সময়ের পর প্রার্থীক বাদী হিসেবে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে ঘোষণামূলক মামলা আনয়ন করতে কোন আইনগত বাধা নেই। তদক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত কতেক আইন, নির্বাহী আদেশ ও উচ্চাদালতের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে উক্ত মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবেন। যেমন- পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৬৫ (১৯৬৫ সনের ২৩ নম্বর অর্ডিন্যান্স); পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা, ১৯৬৫ এবং উক্ত নিয়মের অধীন প্রদত্ত আদেশের যতটুকু দফা (উ) তে উল্লিখিত আইন বলে হেফাজতকৃত; এ্যানিমি প্রপার্টি (কন্টিনিউএ্যান্স অব ইমারজেন্সি) অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ (যা ১৯৭৪ সনের এক্স এল ভি রহিত); বাংলাদেশ ভেস্টিং অব প্রপার্টি এন্ড এ্যাসেট, ১৯৭২; এনিমি প্রপার্টি (কন্টিনিউএ্যান্স অব ইমারজেন্পি প্রভিশনস্ (রিপিল) আইন, ১৯৭৪, ভ্যাস্টেড এন্ড নন-রেসিডেন্ট প্রপার্টি (এমন্ডম্যান্ট) আইন, ১৯৭৪ এবং ১৯৬৫ সন হতে ১৯৬৯ সন পর্যন্ত সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন গেজেট প্রকাশিত নির্বাহী বিভাগের আদেশ।

আবার বিজ্ঞ বিচারিক আদালত বাদী পক্ষের ডিফেন্সের কারণগুলোর আলোকে ঘোষণামূলক মামলা সমূহ নিষ্পত্তি করতে পারবেন। যেমন-প্রথমত:- বিধিবদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ না করে নালিশী সম্পত্তি অর্পিত তালিকায় অন্তর্ভূক্তি করা হলে; দ্বিতীয়ত:- সরকার বিবাদী যদি অর্পিত সম্পত্তির সেনসাশ লিস্ট প্রমাণে ব্যর্থ হন; তৃতীয়ত:- ১৯৭১ সাল হতে ঘোষণামূলক মামলা দায়েরের আগ পর্যন্ত সময়ে বাদী বা তার পূর্বসূরী যদি বাংলাদেশে অবস্থান করেন; চতুর্থত:- নালিশী সম্পত্তি যদি দেবত্তোর সম্পত্তি হয়ে থাকে; পন্চমত:- অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ইস্টোপেল নীতি প্রযোজ্য হবে না। তবে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ঘোষণামূলক মামলায় ডিফেন্সের কারণ বিবেচনা করা হলেও অর্পিত মামলায় এই সুযোগ নেই।

পরিশেষে বর্তমান আইনি কাঠামোতে ”বিষফোড়া” অনেকটা আইনি গতি পেয়েছে। তবে প্রশাসনিক জটিলতা যেন আইনের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে তা রক্ষা করাই বড় চ্যালেন্জ।

রাজীব কুমার দেব, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চকরিয়া চৌকি আদালত, কক্সবাজার।

আপনার মতামত লিখুন :

বিচারপতির স্বাক্ষর জাল করে মেয়র জাহাঙ্গীর এর জামিন আপিল বিভাগ থেকে স্থগিত

বিচারপতির স্বাক্ষর জাল করে মেয়র জাহাঙ্গীর এর জামিন আপিল বিভাগ থেকে স্থগিত

৪২ লক্ষ মামলাজটে বিচার বিভাগ

৪২ লক্ষ মামলাজটে বিচার বিভাগ

আপিল বিভাগে বিচারকাজ চলাকালে ছাদ থেকে বিচারকদের আসনে বৃষ্টির পানি

আপিল বিভাগে বিচারকাজ চলাকালে ছাদ থেকে বিচারকদের আসনে বৃষ্টির পানি

মাদক মামলার ২৫ আসামির জামিন স্থগিত করেছেন চেম্বার আদালত

মাদক মামলার ২৫ আসামির জামিন স্থগিত করেছেন চেম্বার আদালত

হত্যা মামলা নিষ্পত্তিতে দেশ সেরা বিচারক তাজুল ইসলাম

হত্যা মামলা নিষ্পত্তিতে দেশ সেরা বিচারক তাজুল ইসলাম

সভাপতিসহ ০৬টি পদে বিএনপিপন্থী সম্পাদকসহ ০৮ টি পদে আওয়ামীলীগপন্থী আইনজীবীরা বিজয়ী।

সভাপতিসহ ০৬টি পদে বিএনপিপন্থী সম্পাদকসহ ০৮ টি পদে আওয়ামীলীগপন্থী আইনজীবীরা বিজয়ী।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj