করোনা মহামারির কারণে চাকরির বাজার থমকে আছে। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই লোক নিয়োগ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাও স্থগিত হয়ে গেছে। নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের কারণে বিসিএস জটে পড়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আসছে না, কিন্তু বয়স ঠিকই বেড়ে যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় হতাশা ক্রমশই বাড়ছেই। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে আবার অর্থনৈতিক সংকটও সামলাতে হচ্ছে চাকরিপ্রার্থীদের।
বিসিএসে জট এবং চাকরি প্রার্থীদের হতাশার বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, পরীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে পিএসসির আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। কিন্তু মহামারির কারণে আমাদের কিছুই করার নেই। পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে গত ৩১ মার্চ পিএসসির অধীন সকল পরীক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়া হয়। প্রায় দুই মাস সেই স্থগিত অবস্থায় আছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম। যদিও মাঝে সাড়ে চার হাজার চিকিত্সক ও নার্স নিয়োগের কার্যক্রম শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা থেমে গেছে। ২৩ মে থেকে ৪২তম (বিশেষ) বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল পিএসসি। লকডাউনের কারণে গত ১৮ মে ৪২তম বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়। করোনার কারণে গত ৩১ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের সিনিয়র স্টাফ নার্স পদের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। দশম গ্রেডের এ পদের লিখিত পরীক্ষা গত ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। স্থগিত হওয়ার পর পুনরায় আগামী ৯ মে এই পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকার লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর কারণে সেটিও স্থগিত করা হয়েছে। তবে লকডাউন শেষ হওয়ার পরপরই পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে।
করোনার কারণে ৪০তম বিসিএসের চলমান মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। সম্প্রতি ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে পিএসসি। ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নেন ৩ লাখ ২৭ হাজার পরীক্ষার্থী। তাদের মধ্যে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন ২০ হাজার ২৭৭ জন। ২০১৮ সালের আগস্টে ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। ৩৮তম বিসিএসের নন-ক্যাডার ফলাফল আটকে আছে দীর্ঘদিন। ফলাফলের আশায় বসে আছেন প্রার্থীরা। মহামারির মধ্যেই ১৯ মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। আগামী ৬ আগস্ট ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার কথা রয়েছে। মহামারির মধ্যে পিএসসি ৩৯তম বিশেষ বিসিএস (চিকিত্সক) কার্যক্রম শেষ করতে পেরেছিল। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর বড় একটি নিয়োগের পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় চাকরি প্রত্যাশীদের অনেকে কাজ ছাড়াই ঘরবন্দি। যারা টিউশন বা পার্টটাইম করে নিজের খরচ চালাত তারা পড়েছেন চরম বিপাকে। পিএসসিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অনিশ্চয়তার মধ্যে চাকরি প্রার্থীরা। তারা বলছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করতে ২৫/২৬ বছর পার হয়ে যায়। ৪/৫ বছর চাকুরির জন্য যুদ্ধ করতে হয়। তার মধ্যে করোনা একটি বছর কেড়ে নিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বয়সের ক্ষেত্রে এক দফা ছাড় দেয় সরকার। তাতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ যারা ৩০ বছর পেরিয়ে গেছেন, তারাও চাকরির জন্য আবেদন করতে পেরেছেন। তারপর পেরিয়ে গেছে আরও আট মাস। সরকারের তরফ থেকে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় চাকরি প্রত্যাশীদের উদ্বেগ বাড়ছেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থেকে পাশ করেছেন মারুফ হোসেন বিপ্লব। তার সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হবে ৩০মে। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন সামপ্রতিক সময়ে যতগুলো সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হবে, তাতে তিনি আবেদন করবেন। কিন্তু এখন নতুন কোনো চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত না হওয়ায় তিনিও হতাশ। এমন আরো অনেকের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে।
করোনার কারণে গতবছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। অনলাইনে ক্লাস হলেও পরীক্ষা নেওয়ার জটিলতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এক বছরের বেশি সময়ের জটে পড়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, সরকারি চাকরিতে ১৮ লাখ ২১ হাজার ২৮৪টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ১৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৬ জন কর্মরত আছে, ফাঁকা আছে তিন লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮টি পদ। মহামারির মধ্যে সেসব পদ পূরণের কাজটি থমকে গেছে। গত বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটির সময় সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ ছিল। পরে কিছু প্রক্রিয়া শুরু হলেও সংখ্যায় তা সামান্য। বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দেয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ-এনটিআরসিএ। সর্বশেষ ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদন গ্রহণ করেছে। এতে আশার আলো দেখেছিলো প্রায় ৮০ লাখের মতো আবেদনকারী। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক ঐ নিয়োগও আটকে আছে। তাদের মাঝেও বিরাজ করছে হতাশা।
সরকারি স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস-এর মতে, দেশে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। প্রতি বছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন ২৬ লাখ তরুণ। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ লাখ তরুণের চাকরির সংস্থান হয়, বাকিরা বেকার থাকেন। দেশের সরকারি খাত সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থানে সক্ষম। বাকি ৯৬ শতাংশ এখনো বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানা বা আত্মকর্মসংস্থানে জড়িত।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক শিক্ষা সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক ইত্তেফাককে বলেন, করোনার কারণে কর্মসংস্থান বা পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে, মানুষের জীবনযাপনের ক্ষতি হচ্ছে। ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দ্রুত সমাধান করে নিতে হবে। তবে আশার আলো হচ্ছে পিএসসি প্রতি বছরই বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে। স্নাতক যারা সম্পন্ন করেছেন তারা সেটাতে আবেদন করতে পারছেন—সেটি ইতিবাচক।