মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম
বাংলাদেশে অধিকাংশ বিবাদ ভূমি সংক্রান্ত বিষয় কেন্দ্রিক। সেই ভূমি সংক্রান্ত জরিপ কার্যক্রমে মাত্রাতিরিক্ত ভুল ভ্রান্তি থাকায় তা সংশোধনের জন্য ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। The State Acquisition and Tenancy Act (Act XXVIII of 1950), 1950 এর 145A ধারায় Land Survey Tribunal এর কার্যাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সর্বশেষ প্রস্তুতকৃত চূড়ান্ত Record of Rights তথা খতিয়ানের কোন ভুল রেকর্ডের কারণে ক্ষুব্ধ ব্যক্তি খতিয়ানটি সংশোধনের জন্য আনীত মোকদ্দমা Tribunal কর্তৃক বিচার্য হবে এবং যুগ্ম জেলা জজদের মধ্য থেকে একজন এর বিচারক হবেন। গত বছরের শেষের দিকে হাইকোর্ট বিভাগ হতে সরকারকে তিন মাসের মধ্যে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করার জন্য সব শেষ সময় বেঁধে দেয়। সেই মাফিক ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল হিসেবে প্রতিটি জেলার জেলা জজ কে ক্ষমতা দিয়ে আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেয় যদিও সেটা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। তবে আমরা আশাবাদী খুব শিঘ্রই করোনা ভাইরাস চলে গেলে কোর্ট আবার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনে সরকার প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করবেন।
সর্বশেষ প্রকাশিত খতিয়ান তথা রেকর্ড অব রাইটস (ROR) সংশোধনের জন্য ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল বর্তমানে বাংলাদেশের এখন আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক ট্রাইব্যুনাল হিসাবে মানুষের নিকট সমাদৃত হয়েছে। যাদের জমিজমা আছে বা কৃষি প্রধান অর্থনীতির উপর জীবিকা নির্ভর ও নির্ভার তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক জনগণ আছে যে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল এ দু একটি কেস মোকদ্দমা নেই। ভূমি জরিপ কার্যক্রমে জড়িত সেটেলমেন্ট অফিস, তহশিল বা নায়েব অফিসের এবং এসি ল্যান্ড অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারী ও সার্ভেয়ার এর অজ্ঞতা, অসাধুতা ও অতিরিক্ত আর্থিক লোভের বলির পাঠা হতে হয়েছে ভূমির মালিকদের। যার ফলশ্রতিতে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল আজ মামলার ভারে ভারাক্রান্ত।
২০০৪ সালের ০৯ নং আইন দ্বারা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় বর্ণিত জরিপ কার্যক্রমে সংঘটিত সর্বশেষ রেকর্ড অব রাইটস্ (ROR) এ সংশোধনের জন্য। ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৫এ (১) এবং (২) ধারা ও উপধারায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১৯০৮ দেওয়ানি কার্যবিধির সাথে সমন্বয় সাধন করে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল পরিচালিত হবে এবং ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৫ডি ধারায় ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের কাজ ও এখতিয়ার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। (Section 145D of this chapter laid down the power and procedure of the Tribunal where it was provided that for the purposes of disposal of suits or appeals, a Land Survey Tribunal or a Land Survey Appellate Tribunal shall exercise the powers and follow the procedure under the Code of Civil Procedure 1908.) কোন কোন ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল নিজ নিজ প্রচেষ্টায় ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল এর কেস দ্রত নিষ্পত্তি করলেও ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকায় শুধু ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল এর রায় ডিক্রি নিয়ে উপযুক্ত প্রতিকার পাচ্ছে না। সেকারণে আইন সংশ্লিষ্ট ও বিচার প্রার্থী জনগণ অতি দ্রæত ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য জোর দাবী করে আসছে।
ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করতে হলে কোর্ট ফিস প্রথমতঃ ৩০০ টাকা নির্ধারিত হলেও বর্তমানে মহামান্য হাইকোর্ট এর রায়ে কোর্ট ফিস আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ১০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে যা অদ্যাবধি চলমান আছে।|( Clause (ii) of Section-12 of the schedule II of the court-fees (Amendment) Act, 2010 provides thus-(II) “to alter or cancel any entry in a register of the names of proprietors of revenue paying estates” Tk. 1,000) চূড়ান্ত প্রকাশনা ও গেজেট বিজ্ঞপ্তির পর ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৫ এ (২) ধারায় গঠিত ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে রেকর্ড সংশোধনের জন্য মামলা করা যায়। (Section 145 (I) provides, ‘the Government may, by notification in the official Gazette, make rules for carrying out the purposes of this Chapter’) চূড়ান্ত খতিয়ান বা পর্চার গেজেট বিজ্ঞপ্তির পর ০১ (এক) বছরের মধ্যে অনায়াসে মামলা দায়ের করা যায়। উপযুক্ত কারণ দর্শানো সাপেক্ষে অতিরিক্ত আরও ০১ বছর সময় পাওয়া যায়। ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল এর রায়ের বিপরীতে ল্যান্ড সার্ভে আপীল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যায়। এটা প্রায়শই অভিযোগ করা হয় যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবৈধ উপায়ে অসাধুভাবে সরদার আমিন এবং রাজস্ব কর্মকর্তা ভুয়া ব্যক্তির নাম ঠিকানা প্রস্তুতকৃত চূড়ান্ত খতিয়ানে উল্লেখ করে রেকর্ড সম্পন্ন করে।
সমাজের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি জরিপ ও রাজস্ব কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশে তাদের চাহিদা মাফিক অফিসে বসে সরজমিনে পরিদর্শন ও মাপজোখ ছাড়াই রেকর্ড প্রস্তুত করাইয়া নেয়। কিন্তু প্রজাস্বত্ব আইনের XVIIA নং অধ্যায়ে জরিপে অভিজ্ঞ কমিশনারের বা সার্ভে জানা আইনজীবীর নালিশী সম্পত্তি স্থানীয় পরিদর্শনের কোন বিধান উল্লেখ করা হয় নাই। ১৯৫০ প্রজাস্বত্ব আইনের XVIIA নং অধ্যায়ে ১৪৫ (৫) ধারায় বলা হয়েছে, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল এর রায় ও ডিক্রি বিপরীতে রায় ও ডিক্রি হওয়ার পরবর্তী ০৩ মাসের মধ্যে সংক্ষুব্ধ যে কোন ব্যক্তি ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনালে আপীল দায়ের করতে পারবে এবং ১৪৫ (৬) ধারায় আরও বলা হয়েছে যে, ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনালের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও আরও ০৩ মাসের সময় পাইবে। যদিও আপিল ট্রাইব্যুনাল এখনও গঠিত হয় নাই।
এই ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের কেস মূলত দেওয়ানি প্রকৃতির এবং উক্ত এল এসটি কেসে প্রত্যেকটি ধাপে দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে যদিও তা প্রজাস্বত্ব আইনের XVIIA নং অধ্যায়ে উল্লেখিত হয় নাই। তবে ন্যায় বিচারের স্বার্থে দেওয়ানি কার্যবিধির (Code of Civil Procedure) আইন অনুসরণ যোগ্য হবে। বর্তমান এই ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের বিধি বিধানে কোন কেস এর পক্ষগণের মৃত্যুতে ট্রাইব্যুনাল মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদেরকে বা উত্তরসূরিদেরকে পক্ষ করতে বা তাদের নাম কর্তন করতে পারে না। এই ধরনের কেসে ট্রাইব্যুনাল এমনকি ন্যায় বিচারের স্বার্থেও নতুন পক্ষভুক্ত করতে পারে না।
দেওয়ানি আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাও ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে প্রয়োগ করার এখতিয়ার দেওয়া হয় নাই। অনেক সময় আর এস রেকর্ডে কোন ভুলভ্রান্তি থাকলেও আর এস নকশা বা ম্যাপে জমির অংশ বা পরিমাণ কম বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে ম্যাপ সংশোধনের কেস করে যেমন প্রতিকার পাওয়া যায় তেমনি ল্যান্ড সার্ভে সেটেলমেন্ট ম্যানুয়াল ১৯৩৫ এর ৬৯৮-৬৯৯ বিধিতে রেভিনিউ অফিসারের মাধ্যমেও ম্যাপ বা নকশা সংশোধন করা যায়।
আরেকটা বিষয় ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের বিচারক হয়ে শুনি যে রাজস্ব কর্মকর্তা বা সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসাররা তাদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব তারা সঠিকভাবে পালন করছেন না। যেমনঃ গত ০২/০৯/২০১৪ খ্রিঃ তারিখের ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি শাখা-০১ এর ৩১.০০.০০০০.০৪২.৬৭.০৩১.১১.৫৮৫. নং স্মারকে প্রজ্ঞাপন মতে রাজস্ব কর্মকর্তা বা সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসারগণ যদি নিম্নোক্ত আইন অনুযায়ী তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতো তবে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে অনেক মামলার চাপ কমে যেত এবং জরিপ ট্রাইব্যুনালে মামলা জট দেখা দিত না। প্রথমতঃ সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তা (Revenue Officer) বা সহকারী কমিশনার ভূমি (Assistant Commissioner of Land) The State Acquisition & Tenancy Act 1950 এর ১৪৩ ধারামতে এবং প্রজাস্বত্ব বিধিমালা ২৩(৩) অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ডের করণিক ভুল (Clerical Mistakes) নিজেই সংশোধন করতে পারেন। যেমনঃ নামের ভুল, অংশ বসানোর হিসেবে ভুল, দাগ-সূচিতে ভুল, ম্যাপের সাথে রেকর্ডের ভুল ইত্যাদি।
একইভাবে Fraudulent Entry বা জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ড সংশোধনের জন্যে প্রাপ্ত আবেদন বা প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে প্রজাস্বত্ব বিধিমালা ২৩(৪) অনুযায়ী রাজস্ব কর্মকর্তা রেকর্ড সংশোধনের জন্যে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। দ্বিতীয়তঃ The State Acquisition & Tenancy Act 1950 এর ১৪৯(৪) ধারামতে Board of Land Administration যে কোন সময় বোনাফাইড মিসটেক (bonafide Mistake) সংশোধন করতে পারেন। যেমনঃ জরিপকালে পিতার মৃত্যুর কারণে সন্তানদের নামে রেকর্ড হবার কথা থাকলেও জরিপকারদের ভুল বা অজ্ঞাত কারণে তা মূল প্রজা বা পিতার নামে রেকর্ড হওয়া ইত্যাদি। Board of Land Administration বর্তমানে বিলুপ্ত বিধায় তার ক্ষমতা সরকারের পাশাপাশি যুগপৎ ভূমি আপিল বোর্ডও সমভাবে প্রয়োগে ক্ষমতাবান। এই তিন কর্তৃপক্ষের আওতা বহির্ভূত বিষয়েই ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদেরকে অনুরোধ করলেও তা যথাযথ প্রতিপালিত না হওয়ায় ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা জট দেখা দিয়েছে যা সত্যিই হতাশাজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
সামগ্রিকভাবে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা এই যে ট্রাইব্যুনাল বা আদালত হচ্ছে মানুষের ন্যায় বিচার প্রাপ্তির সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। সরকার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে জনগণের দোর গোঁড়ায় ন্যায় বিচার পৌঁছে দেয়ার জন্য। কিন্তু অদ্যাবধি ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়ায়, এবং বিদ্যমান ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মচারী নিয়োগ না দেয়ায় এবং ১৯৫০ প্রজাস্বত্ব আইনের XVIIA নং অধ্যায়ে উল্লেখিত রুলস প্রণয়ন না করায় জনগণ এই ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল আইনের সুফল পাচ্ছে না।
মুজিববর্ষে জনগণ বিশ্বাস করে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ভূমি সংক্রান্ত বিবাদ মিটানোর জন্য ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে এবং ১৯৫০ প্রজাস্বত্ব আইনের XVIIA নং অধ্যায়ে উল্লেখিত রুলস প্রণয়ন করবে। ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করে নয় বরং ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন, ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় ল্যান্ড সার্ভে রুলস প্রণয়ন করে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সরকার জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ করবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে জনগণকে ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ক টেকসই ও লাগসই ভূমি ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থা উপহার দিতে হবে।
লেখকঃ আইন বিশ্লেষক ও গবেষক। Email-bdjdj1984du@yahoo.com