মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদুল ফিতর। এসময় মানুষ যে যেখানেই থাকুক না কেন নিজের বাড়িতে গিয়ে আপনজনের সাথে ঈদ পালন করে থাকে। তেমন বাঁধভাঙ্গা জোয়ার আমরা করোনাকালেও দেখছি। গাড়ি-যানবহণ একপ্রকার লকডাউনে বন্ধ রয়েছে। তা উপেক্ষা করেও মানুষ যে যেভাবে পেরেছে নিজ বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে এভাবে অসচেতন হলে আমাদের দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও যে কোন সময় তা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতে করোনা পরিসিস্থি ভয়াবহ। করোনা কত নির্দয় তা বর্তমানে পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালেই সহজেই অনুমান করতে পারি। ভারতে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার লোকের প্রাণহানি এবং প্রায় ৪ লক্ষ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা প্রতিবেশি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই উদ্বেগের। তাই ঈদুল ফিতর উদযাপনে মুসলিম বিশ্বসহ বাংলাদেশী মুসলিমান হিসেবে আমাদেরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদ উৎসব পালন করতে হচ্ছে।
ঈদের খুশি এবার করোনা কেড়ে নিয়েছে। না শুধু আমার বা আপনার নয় সারা বিশ্ববাসীর। ঘুম, খাওয়া দাওয়া, চলাফেরা সবকিছুতে প্রতিবন্ধকতা চাপিয়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। এই প্রজন্মের দানব রুপে আবির্ভূত হয়ে সদর্পে সারা পৃথিবীতে বিচরণ করছে এই ভয়াল সর্বগ্রাসী করোন ভাইরাস। আজকে দুএকটি কথা প্রথমে বলে নিতে চাই আমার আশংকার জায়গা কোনটি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও করোনা ভাইরাস নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে।এককে সময় সময় এককে রকমফের বক্তব্য প্রদান করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প হুশিয়ারি দিয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বাজেট আমেরিকা সংকুচিত করে দিবে। এ নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য বেশ চিন্তিত। কেননা মোট বাজেটের ৪৫ ভাগ যুক্তরাস্ট্র যোগান দেয়। মূলত সকল দেশ, সংস্থা ও ব্যক্তি এবং সর্বপরি সারা দুনিয়া আজ আতঙ্কিত।
WHO এর নতুন রেজুলেশন পাস করা হয়েছে যার নামকরণ করা হয় covid 19 response. যেসব বিষয় রয়েছে এই রেজুলেশনে তাহলো ১. সদস্য রাষ্ট্র গুলো এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা WHO এর নেতৃত্ব স্বীকার করবে। ২. নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য সূলভ মূল্য, সমতার ভিত্তিতে ঔষধ বন্টন করা হবে। ৩. মহামারি মোকাবেলায় কোন দেশ বাধা দিলে, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমস্যা দূর করা হবে। ৪. সদস্য রাষ্ট্র গুলো দীর্ঘ এবং মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করবে । ৫. নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গ্রহণে তাগিদ। ৬. স্বাস্থ্য কর্মীদের দেয়া হবে প্রতিরোধকমূলক পোশাক ও জরুরি সামগ্রী। ৭. ডিজিটাল উপায়ে কেউ যেনো গুজব ও মিথ্যা না ছড়ায়। ৮. ট্রিপস চুক্তি ও দোহা ডিক্লোরেশন মানা হবে। ফলে করোনা চিকিৎসার নতুন ঔষধ আবিষ্কারে মেধাস্বত্ব বিষয়ে অর্থ ব্যয় করতে হবে না।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এই রেজুলেশনের মধ্যে আমরা কিছু ইঙ্গিত পাই সেটা হলো যে খুব সহসা এই করোনা পৃথিবী থেকে বিতাড়িত হবে না। মানুষ সতর্কভাবে কতদিন চলবে বা চলতে পারে সে বিষয়ে সুস্পস্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে এই রেজুলুশনের মধ্যে। হাত ধোয়া, মুখে মাস্ক পরা এগুলো না হয় মানুষ করলো কিন্তু কাছাকাছি না যাওয়া, মসজিদে কাধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ না পড়া, বাজারে গিয়ে ভীড় ছাড়া বাজার করে নিয়ে আসা, স্কুলে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী সামাজিক দূরত্ব গ্রাম-শহরে কিভাবে বজায় রাখা যায়, ডাক্তার-রোগী কাছাকাছি না গিয়ে রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসা সেবা দেয়া বা নেয়া কিভাবে সম্ভব সে বিষয়টির সুস্টু সমাধান কি তা না বের করে চলা এবং মালিক-শ্রমিকের সমন্বয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ইত্যাদি বিষয় পরিস্কারভাবে পূর্বের ন্যায় পৃথিবী শান্ত না হলে যে কিভাবে দেশ তথা সারা দুনিয়া চলবে এসব বিষয়ে গবেষণা করার গবেষকও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিধাতা নাখোশ হলে নাকি পারস্পারিক আস্থা নস্ট হয়। কার কার আস্থা ও নির্ভরতা কিভাবে নস্ট করবেন তাতো সৃস্টিকর্তা ভালো করেই জানেন। করোনা এমন ভাইরাস যে সেই আস্থা তো পুরোপুরি বিনস্ট করে দিয়েছে। আমাকে আপনাকে অস্থির করে তুলেছে। গভীর চিন্তার সাগরে ডুবিয়ে দিছে। করোনা ভাইরাস আসল বা আসবে ভেবে তো রক্তের সম্পর্ক নিয়ে টানাটানি চলছে। পিতার জানাজা পুত্র দিতে পারছে না। করোনার ভয়ে সন্তানকে ফেলে পিতা পালিয়ে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীকে ফেলে যাচ্ছে । পারস্পারিক আস্থা একবারেই বিনষ্ট করছে এই ভাইরাস। সুতরাং সচেতন হওয়া বা মাস্ক পরার বিকল্প দেখিনা।
ঈদে বাড়ি যাওয়া, ঈদের আনন্দ ভাগ করে আপনজনের সাথে নাড়িরটানে বাড়ি বা নিজ জন্মস্থানে যাওয়া বাঙালি জাতির চিরাচরিত অভ্যাস। কিন্তু তাতে এবার পুরোটাই বাঁধ সেধেছে করোনা ভাইরাস। লকডাউন হলে হাদীস অনুযায়ী যে যেখানে আছে সাধারণত সেখানেই থাকার বিধান আছে। কোয়ারেন্টাইনে কমপক্ষে ১৫ দিন থাকতে হবে। মহামারি স্থান কাল ত্যাগে ধর্মীয় বিধিনিষেধ আছে। এবার রাস্ট্রীয়ভাবেও সেই বিধান বিশ্বব্যাপী মানতে প্রচারণা চলছে। মুসলমানদের নবী মুহাম্মদ যা দেড়হাজার বছর আগে বলেছে তা এখন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই মেনে চলছে। অত্যন্ত আনন্দের যে এই করোনা ভাইরাসই একমাত্র ভাইরাস যা সকলকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে।
শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রমজান মাসের ৩০ দিনের রোযা সহীহ ভাবে ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে বন্ধ হয়। একমাস রমজান পালনের যে গুরুত্বও তাৎপর্য সকল প্রকার অন্যায় ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকা তারই বাস্তবায়ন শুরু করা উচিত অন্যান্য মাস গুলোতে।। রোযা রাখার মূল উদ্দেশ্য হলো পানাহার বা খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকা যাতে করে ধনী শ্রেণী বুঝতে পারে যে না খেয়ে থাকলে কি কস্ট হয়। এরপরে ঈদে সকল ভেদাভেদ ও ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে ঈদের জামায়াতে শরিক হয়ে এক অপরের খোঁজ খবর নেয়া হয়া কোলাকুলি করে। একে অপরকে দাওয়াত দিয়ে থাকি। এক আনন্দদায়ক পরিবেশ থাকে। কিন্তু করোনা সংকট বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে। যা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় যা আজ অবধি বের হয়েছে তা হলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরিধান করা। কারন কোনো ওষুধ বা টিকা পৃথিবীতে আবিষ্কার হয়নি যা পুরোপুরি করোনা নিরাময়ে অব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।। বা ভবিষ্যতে শতভাগ নিরাময় যোগ্য টিকা তৈরি হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাহলে ঈদ উৎসব পালন হবে কিভাবে সেটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। হাদীসে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ বলেন ‘যখন কোনো এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়ে তখন যদি তোমরা সেখানে থাকো তাহলে সেখান থেকে বের হবে না। আর যদি তোমরা বাইরে থাকো তাহলে তোমরা সেই আক্রান্ত এলাকায় যাবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)। সুতরাং করোনকালে নিজেদের সুরক্ষার জন্য হাদীস মোতাবেক আমল করতে হবে। তাহলে সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
করোনাকালে ঈদ পালন করতে যা যা করা যেতে পারে তা হলোঃ
১.ঈদ উদযাপন যে যে অবস্থানে আছি সেখান থেকে পালন করি।
২. কোনো গরীব বা মিসকিনকে বাসায় নিয়ে খাওয়াতে পারব না সত্য কিন্তু কেউ যেন না খেয়ে থাকে সেজন্য সাধ্যমত প্রতিবেশিদেরকে আর্থিক বা খাদ্য-দ্রব্য দিয়ে সহায়তা করতে পারি।
৩. করোনার মধ্যে আরেক প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলো আম্ফান ঝড় যেটি সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগরেহাট, বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ তান্ডব ঘটিয়ে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে গেছে তাদেরকে আমরা সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতা করি।
৪. প্রতিবেশি যারা না খেয়ে আছে তাদেরকে আগে কিছু দিয়ে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই।
৫. মধ্যবিত্ত অনেকে আছে যারা কেউ কোন সাহায্য চাইতে লজ্জা পায় তাদেরকে হাদিয়া দিয়ে সহযোগিতার করতে পারি।
৬. সদকা-ফিতরা এবং যাকাত হিসেব মতে গরিবও বঞ্চিতদের মাঝে বিলিয়ে দেই।
৭. সরকারী সহায়তার পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত এই করোনা মহামারীর কালে। কেননা ধন-সম্পদ মারা গলে কেউ সঙ্গে নিতে পারবে না।
৮. নিজেরা সরকারী যে দিক নির্দেশনা আছে তা যথাযথভাবে পালন করি এবং মুখে মাস্ক এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সচেতনা বাড়াতে একযোগে কাজ করি।
৯. ঈদ বেঁচে থাকলে আগামীতে আরো সুন্দর করে উদযাপন করা যাবে এমন উপলব্দি মনের মধ্যে গেঁথে নিই এবং সেভাবে মেনে চলি।
১০. আপনি বা আমি যেভাবে ভালো আছি ঈদের শিক্ষা হিসেবে অন্যদেরকেও ভালো রাখার চেষ্টা করি। লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, কলামিস্ট ও আইন বিশ্লেষক। ইমেইল-bdjdj1984du@gmail.com