সব
facebook apsnews24.com
ভোক্তা সচেতন হলে অধিকার সংরক্ষণ হবে... - APSNews24.Com

ভোক্তা সচেতন হলে অধিকার সংরক্ষণ হবে…

ভোক্তা সচেতন হলে অধিকার সংরক্ষণ হবে…

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ দিবস প্রতি বছর ১৫ মার্চ। এই দিবসে একটি বাস্তব গল্প দিয়ে শুরু করবো। মাহাবুর আলম সোহাগ নামে একজন ভোক্তা তার গ্রামের বাড়ি ঠাঁকুরগাও যাচ্ছিল। যাওয়ার পথে রাস্তার বগুড়া শেরপুর হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে বাস থামল। তখন একটা এ্যাকুয়াফিনা পানির বোতল কিনল। বোতলে মূল্য লেখা ছিল ১৫ টাকা কিন্তু দোকানী বিলিংএর রিসিটে ২০ টাকা দাম ধরলো। ক্রেতা তা পরিশোধ করে রিসিট নিয়ে একজন সাধারণ ক্রেতা ও ভোক্তা হিসেবে ওই জেলার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্মকর্তার অফিসে গেল। গিয়ে বিলিং রিসিটে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৫ টাকা বেশি গ্রহণ করায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অধীনে কেস ঠুকে দিল। এবার সংশ্লিষ্ট অফিস অভিযোগ আমলে নিয়ে দোকানের মালিককে নোটিশ করলো ওই আইনের ৪০ ধারার অপরাধে। এবং শুনানীতে যদি তা প্রমাণিত হয় তাহলে দোকানীকে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ০১ বছরের জেল ও খাটতে হতে পারে। কথা হলো সচেতন হলে আপনার আমার সকলের অধিকার সংরক্ষণ হবে। সোহাগ এই অভিযোগ করে শুধু নিজের অধিকার নয় সমগ্র দেশবাসীর অধিকার সংরক্ষণ করেছেন। এজন্য তাকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানায়। আইনী বিষয়টি দেখুন যা নিম্নে চিঠিতে দেয়া হয়েছে।

উপরের ঘটনা থেকে নোটিশ

‘ভোক্তা’ বলতে সাধারণ অর্থে আমরা যেকোনো পণ্যের ক্রেতা বা গ্রহীতাকে বুঝি। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯–এ ভোক্তাকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আইনটিতে বলা হয়েছে, ভোক্তা অর্থ এমন কোনো ব্যক্তি, যিনি (ক) পুনর্বিক্রয় ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত (অ) মূল্য পরিশোধে বা মূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রুতিতে কোনো পণ্য ক্রয় করেন: (খ) যিনি ক্রেতার সম্মতিতে (ক)–এ উল্লেখিত পণ্য ব্যবহার করেন; ব্যবসায়ীদের যেসব কাজ ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ হিসেবে গণ্য হবে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ সেসব কাজের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

আইনটিতে বলা হয়েছে, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্য অর্থ—
ক. কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা;
খ. জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা;
গ. মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক কোনো দ্রব্য, কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, উক্ত রূপ দ্রব্যমিশ্রিত কোনো পণ্য বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা;
ঘ. কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রির উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপনে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা;
ঙ. প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা;
চ. কোনো পণ্য সরবরাহ বা বিক্রির সময় ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত ওজন অপেক্ষা কম ওজনের পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা;
ছ. কোনো বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ওজন পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্র প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শনকারী হওয়া;
জ. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত পরিমাপ অপেক্ষা কম পরিমাপের পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা;
ঝ. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দৈর্ঘ্য পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছু প্রকৃত দৈর্ঘ্য অপেক্ষা অধিক দৈর্ঘ্য প্রদর্শনকারী হওয়া;
ঞ. কোনো নকল পণ্য বা ওষুধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা;
ট. মেয়াদোত্তীর্ণ বা ওষুধ বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা; বা
ঠ. সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে এমন কোনো কার্য করা, যা কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ যে কার্যকলাপকে অপরাধ বলা হয়েছে তা হলো—
ক. আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও পণ্যে মোড়ক ব্যবহার না করা;
খ. মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করা;
গ. সেবার মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা; ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা;
ঘ. ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা;
ঙ. খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশ্রণ করা;
চ. মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা;
ছ. প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা;
জ. ওজনে কারচুপি করা;
ঝ. বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শন করা;
ঞ. পরিমাপে কারচুপি করা;
ট. দৈর্ঘ্য পরিমাপক কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা;
ঠ. পণ্যের নব প্রস্তুত বা উৎপাদন করা;
ড. মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা;
ঢ. সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করা এবং
ণ. অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দিয়ে সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ঘটানো;

মামলা ও বিচার হবে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮ অনুযায়ী, আইনে যা-ই থাকুক না কেন, সরকার বা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি, নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক এ আইনের অধীনে লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইনের অধীন কোনো অপরাধ বিচারার্থে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত আমলে নিতে পারবেন। এখন শুরু হয়েছে করোনাভাইরাস এবং তা মোকাবিলায় ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই মূল্যবৃদ্ধি ও মজুদদারি ঠেকাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এবং বিদ্যমান আইন ভোক্তা সংরক্ষণ আইন ও স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট কী বলে, তা জেনে নেওয়া যাক।

ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে—
জরিমানা ও শাস্তির বিধান আরও সুনির্দিষ্ট যেমন জীবননাশক বা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক বা ভারী ধাতু বা বিষাক্ত দ্রব্যমিশ্রিত কোনো খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, আমদানি, প্রস্তুত, মজুত, বিতরণ, বিক্রয় বা বিক্রয়ের অপচেষ্টা করলে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। পুনরায় একই অপরাধ করলে সাত বছর থেকে অনূর্ধ্ব ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন ১০ লাখ টাকা জরিমানা।

এ ছাড়া দূষণমিশ্রিত কোনো খাবার বিক্রি করলে; শর্ত ভঙ্গ করে কোনো খাদ্যদ্রব্য মজুত বা প্রস্তুত করলে; অনুমোদিত ট্রেডমার্ক বা ট্রেডনামে বাজারজাত করা কোনো খাদ্যপণ্য নকল করে বিক্রির চেষ্টা করলে; খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন বা সংরক্ষণের স্থানে শিল্পকারখানার তেল বা খনিজ বা বর্জ্য থাকার অনুমোদন দেওয়াসহ এমন ২০ ধরনের অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব সাত বছর থেকে কমপক্ষে দুই বছর শাস্তি এবং অনধিক ১০ লাখ টাকা অথবা কমপক্ষে তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। একই অপরাধ পুনরায় করলে শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ আরও বাড়ানোর বিধান রাখা হয়েছে।

নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯—দুটি মিলিয়ে পড়লে ওই আইনে যেসব কাজ করার বিষয়ে বিধিনিষেধ অথবা যেসব কাজ অপরাধ গণ্য করা হয়েছে, তা সব নাগরিককে জানতে হবে। কেননা ওই বিধিনিষেধ ব্যত্যয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা অধিদপ্তরকে ভেজাল পণ্য বাজেয়াপ্ত ও আটকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর ২৫ এবং ২৭ ও ২৮ ধারার বিধান প্রয়োগ করেও অবৈধ মজুতদার ও মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। অন্যায় ও অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে মূলত বিশেষ ক্ষমতা আইনটি করা হয়েছিল। একটু প্রয়োগ করলেই হয় অথচ এ আইনটি বেশির ভাগ ব্যবহার হয় ইন্ডিয়া হতে কে চকলেট আনল, কে রেলের টিকিট বিক্রি করল, কালোবাজারিতে তার বিরুদ্ধে যেটি এই আইনের মুখ্য বিষয় নয়।

করোনাভাইরাসের কারণে ও অনেক ব্যবসায়ী পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রতিকার নেওয়া যেতে পারে, এ বিষয়ে অনেকে হয়তোবা জানেন না। যেমন ১০ থেকে ১৫ টাকার মাস্ক বিক্রি হচ্ছে বা করছে ২০০ টাকায়। টিস্যু, হ্যান্ডওয়াশ–জাতীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ আছে, যা কঠোর নজরদারি করে ও আইনগত প্রতিকারের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

করোনাভাইরাস যেভাবে বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে সবাই আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে যদি সামান্য মাস্ক, টিস্যু, হ্যান্ডওয়াশ ও ন্যাপকিনের দাম বেড়ে যায়, তাহলে সেটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে। তাই ভেজাল পণ্য ও মূল্যবৃদ্ধি কার্যক্রমের সঙ্গে সুযোগসন্ধানী জড়িত ব্যক্তিদের আটক এবং মোবাইল কোর্ট অথবা উপযুক্ত আদালতে বিচারকার্য সম্পন্নের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। নিরাপদ খাদ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। কবির ভাষায় পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। জনগণ সচেতন হলে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত আরও দৃঢ় ও মজবুত হবে।

লেখক: আইন বিশ্লেষক ,গবেষক এবং কলামিষ্ট। bdjdj1984du@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :

মরু অঞ্চলে বৃষ্টি ও বন্যা, প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

মরু অঞ্চলে বৃষ্টি ও বন্যা, প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

স্বাধীনতা দিবসের ভাবনাগুলো

স্বাধীনতা দিবসের ভাবনাগুলো

১৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটা স্মরণীয় দিন

১৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটা স্মরণীয় দিন

সর্বনাশা পরকীয়া, কারণ ও প্রতিকার

সর্বনাশা পরকীয়া, কারণ ও প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মূল্যবোধের অবক্ষয় এর শেষ কোথায়!

মূল্যবোধের অবক্ষয় এর শেষ কোথায়!

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj