প্রথম অংশ:
শাস্ত্রমতে বা পন্ডিতজনরা প্রায়শই বলে থাকেন, “আইন সবার উপরে”, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়”, “আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে”। কিন্তু একজন সাধারণ আইনজীবী হিসেবে আমার মনে হয় কথাগুলি শতভাগ বিশুদ্ধ নয়। কিছুটা খাঁদ রয়েছে কথাগুলিতে। শুধু আমি নই, কোর্টের বারান্দায় যারা অনেক জ্ঞানী-গুণী এ্যাডভোকেটদের জুতা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করে, সেই মুচিগুলিও মনে হয় পুরোপুরি মানতে চাইবে না কথাগুলো। যদিও ভয়ে মুখের উপরে কিছু বলবে না এরা, কিন্তু যখন তারা নিজেদের গন্ডির মধ্যে আলোচনা করে তখন ঠিকই হড় হড় করে তাদের মনের কথা গুলো বলে ফেলে এরা। গ্রাম কিংবা শহরের অনেক খেটে খাওয়া কিংবা যারা সোজা-সাপ্টা কথা বলে থাকেন তাদের অনেক সময় বলতে শুনি, “অমুক লোকের টাকার জোর ছিল বলেই সে এই মামলায় জিতে আসছে।”
এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে হলো। আমি তখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। একটি মেয়েকে দেখতাম সে ক্লাসে খুব কম কথা বলত। হাসতও কম। তবে মুচকি হাসত তার বান্ধবীদের সাথে। সে হাতে গোনা দুই একটি মেয়ের সাথে চলত। তাকে দেখে আমি ভাবলাম মেয়েটি মনে হয় ভাল কথা জানে না। হাদারাম মেয়ে একটা! এই মেয়ে কেন আইনে ভর্তি হলো; কথা-বার্তা কিছু বলে না যে; কী ব্যাপার। একদিন আমি এবং আমার দুই তিনটা বন্ধু ডিপার্টমেন্টের সামনে গল্প করছিলাম। সেদিন সে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সেদিন দৈবক্রমে একটু বদমায়েশি চিন্তা-ভাবনা আমাদের মাথায় চেপে বসল- মেয়েটি কেন এত কম কথা বলে; তার সাথে কথা বলব আমরা আজ। দেখি সে কেমন করে কথা বলে; কিভাবে রেসপঞ্জ করে। কিন্তু আমরা যখন তার সাথে কথা বললাম আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম তার কথা শুনে। সে কম কথা বলে কিন্তু ভারী ভারী কথা বলে; ভাল কথা বলে। যদিও সে বেশ লাজুক কিংবা কম কথা বলে তার মানে এটা নয় যে সে জগত সম্বন্ধে কোন ধারণা রাখেনা। সেদিন আমরাই হাদারাম হয়ে গেলাম সবাই। তেমনি সাধারণ মুচি ও দিনমজুররা অনেক পড়া-লেখা না করলেও জগতের হাব-ভাব যে তারা একেবারেই বোঝে না- সেটি মনে হয় সঠিক নয়।
এই আলোচনার মূল বিষয় হলো কিভাবে ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। সাধারণ জনগন ও খেটে খাওয়া মানুষের মনে আইন সম্পর্কে বা বিচার প্রাপ্তি নিয়ে যে কিছুটা অসন্তোষ রয়েছে- সেটি কিভাবে কমিয়ে আনা যায়- সেটিই মূল লক্ষ্য। কোর্ট রুমে আমার মতে মোটামুটি ছয় ধরনের লোক থাকে। যেমনঃ (১) মাননীয় বিচারকবৃন্দ- যারা আমাদের সমাজেরই একদল শিক্ষিত লোক যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আইন বিষয়ে পড়াশুনার মাধ্যমে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করে তারপর জজগিরি শুরু করেছেন। যারা জজ কোর্টে জজগিরি করেন তারা একটি বিশেষ পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে ঊত্তীর্ণ হয়ে অল্প বয়সেই নিজ এলাকা আর বাপ-মায়ের মুখ ঊজ্জ্বল করে সানন্দে জজগিরি শুরু করেন।
সদ্য লেখাপড়া শেষ করে জজগিরির জন্য আয়োজিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে কিছুদিন পরেই ইনারা সমস্যাগ্রস্ত লোকজনের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য জজের চেয়ারে বসে পড়তে পারেন। অবশ্য ইনাদের হালকা ট্রেনিং এর ব্যবস্থা শুরুতেই মনে হয় কিছুটা করা হয়। নইলে হুট করে একজন ছাত্র মানুষ কিভাবে বিচার করবে? আবার যারা সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির চেয়ারে বসে বিচার কার্য করেন, তাঁরা হয় সুপ্রীম কোর্টে দশ বছরের অধিক সময় প্র্যাকটিস করেছেন কিংবা জজ কোর্টে জেলা জজ হিসেবে বিচারকার্য করেছেন। আমাদের মহামান্য প্রেসিডেন্ট তাঁর ক্ষমতা বলে ইনাদের মধ্যে থেকে কিছু ব্যক্তিকে বেছে নেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচার কার্য পরিচালনার জন্য। তবে কোন বিশেষ তত্ত্ব ব্যবহার করে মহামান্য প্রেসিডেন্ট মহোদয় এসকল বিজ্ঞ বিচারকদের বাছাই করে নিয়ে আসেন এবং জনগনের বিচার করার জন্য নিয়োগ প্রদান করেন, সেটি আমার অজানা। বিচারকরা যখন বিচারকের চেয়ারে আসীন হোন, তখন তাঁদেরকে আমরা ইয়োর অনার, মাই লর্ড ইত্যাদি বলে সম্মান দেখাই এবং আকুতি মিনতি করে রায় বা আদেশ আমাদের পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করি।
শুধু আকুতি-মিনতি দিয়ে হয় না আসলে, কিছু যুক্তিও লাগে। শুধু মিষ্টি কথায় চিড়া তো ভেজে না আসলে, এটি ভিজতে কিছুটা জলেরও দরকার হয়। যাই হোক, আদেশ পক্ষে আসলে আমরা আইনজীবীরা হিহি করে হাসতে হাসতে আনন্দে আটখানা হই এবং কোর্ট রুম থেকে বেরিয়ে আসি। ক্লায়েন্টের হাত থেকে টাকা বাগিয়ে নিই। অবশ্য, অনেক ভদ্রজনা মুচকি হাঁসি দিয়ে মনে মনে একটি গর্ব নিয়ে কোর্ট রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। আবার আমরা অনেক এ্যাডভোকেট এই বিজয়ী এ্যাডভোকেটের দিকে চেয়েও থাকি অনেক সময়। মনে মনে বলি, ব্যাটা ভাল সাবমিশন রেখেছে আজকে। আমরা অনেক আইনজীবীই আছি যারা অনেক সময় বড় মামলায় নিজেরা দাঁড়াই না, ভয় করি যদি নিজে দাঁড়িয়ে ভাল আর্গুমেন্ট না করতে পারি; যদি হেরে যাই? তাই, যেসব আইনজীবীরা পারদর্শী কিংবা রায় পক্ষে আনতে বেশ পটু তাঁদেরকে নিয়োগ দিই আমরা।
অর্থাৎ কোর্ট রুমে দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক হলো এ্যাডভোকেটগণ। তিন নম্বরে হলো বাদীপক্ষ অর্থাৎ যারা মামলা করে এবং চার হলো বিবাদী বা আসামী পক্ষ অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এই মামলাকারীরাও আবার কেউ ভালো আবার কেউ কেউ বেশ বদের হাড্ডি। বেশিরভাগ লোকই আসে প্রয়োজনের তাগিদে। তবে কিছু বদমায়েশ লোক যে কোর্টে আসে না তা নয়। এরা কোর্টে আসে হয়রানীমূলক মামলা নিয়ে। অপরপক্ষকে কিভাবে দমিয়ে রাখা যায় কিংবা কিভাবে একটি বিশেষ সুবিধা দীর্ঘদিন নিজের আয়ত্ত্বে রাখা যায় সে জন্য। তবে যারা প্রকৃত অর্থেই ন্যায় বিচার পেতে আসেন, তারা থাকেন অনেক উদ্বিগ্ন ও অস্থির। এ্যাডভোকেটকে মামলা দেওয়ার পরের দিন থেকেই এরা আইনজীবীর নিকট এসে বসে থাকেন। কখন তাদের প্রত্যাশিত রায় পাবেন কিংবা কখন তাদের আত্মীয়-স্বজন জেল থেকে বেরিয়ে লাফ দিয়ে এসে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরবেন। আদালতে পঞ্চম শ্রেণীর লোকজন হলো আদালতের কর্মচারি। অর্থাৎ সরকারি চাকর। এরা চাকর হলে হবে কী। এদের একেক জনের এ্যাটিটিউড দেখলে মনে হবে এরা একেকটা নবাবজাদা; এরা এখানে চাকরী করেনা। অনেকেই এদের দ্বারা হয়রানির শিকার হোন এবং মনে মনে হারামজাদা বলে গালি দিয়ে থাকেন।
আদালতে খুব কম কাজই রয়েছে যেগুলি টাকা ছাড়া হয়। তবে দুই একজন ভাল লোক আছেন। তবে এদের সংখ্যা হাতে গোনা। ষষ্ঠ শ্রেণীর লোক হলো সরকারি উকিল। অর্থাৎ সরকারের পক্ষে যে সকল উকিল কথা বলে থাকেন এবং সরকার জনগণের তহবিল থেকে যাদের টাকা দিয়ে থাকেন বেতন হিসেবে। উচ্চ আদালতে ইনাদের নাম হয় এ্যাসিস্ট্যান্ট এ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি এটর্নি জেনারেল, এ্যাডিশনাল এটর্নি জেনারেল এবং এটর্নি জেনারেল ইত্যাদি। আবার জজকোর্টে যারা থাকে তাদের বলা হয় পাবলিক প্রসিকিউটর বা পিপি কিংবা গভর্নমেন্ট প্লিডার বা জিপি। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই সরকার এই সকল সরকারি উকিল পদে তাদের নিজেদের চেতনার লোক নিয়োগ দেওয়ার দিকে মনোযোগ দেয় বেশি। গুণাগুণ? সেটি পরে ভাবা যাবে ।
দ্বিতীয় অংশ:
জ্ঞানীজনেবলেন, সংসারের কর্তা বা বাড়ির মালিকের নাকি চার চোখ থাকতে হয়। দুই চোখ সামনের দিকে আর দুই চোখ পেছনের দিকে। অর্থাৎ জীবনে চলার পথে তাঁকে খুব সাবধানে চলতে হয়; হিসেব কষে কষে প্রতি কদম ফেলতে হয়। সাধারণত, কর্তাই বাড়ির প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়ে থাকেন। তাকে সমাজের আর দশজন মানুষের সাথে চলাফেরা করতে হয়, সামাজিকতা ও সকল ভদ্রতা বজায় রাখতে হয়। সকলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে পরিবারের জন্য জীবিকা বাগিয়ে আনতে হয়। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য টাকা-কড়ি আয় করতে হয় সোজা কথায়। সেই আয়কৃত অর্থ দিয়েইতাঁর সংসার চলে। কর্তাকে তাঁর জীবিকার উৎসটি সচল রাখার জন্য যেমন অফিস বা ব্যবসার সাথেজড়িত লোকজন নিয়েচিন্তা করতে হয়। তেমনি, সন্ধ্যাবেলাক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে ছেলে-মেয়ে পড়াশুনা করল কিনা, বুড়ো বাবা-মা’র কিছু লাগবে কিনা, বউয়ের কোন পরামর্শ আছে কিনা সবকিছুই শুনতে হয়। পরেরদিন সকালেই আবার কর্মক্ষত্রে চলে যেতে হয়।
আমাদের বিচার ব্যবস্থায় যে লোকগুলোদূরে উঁচু সুন্দর চেয়ারগুলিতে বসে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণী রায় দিয়ে থাকেন-এরাই হলো সংসার নামক বিচার ব্যবস্থার কর্তা। সংসারের কর্তাকে যেমন ঘরে-বাইরের নানা বিষয়ে চিন্তা করতে হয়, সকল কাজ অতি সাবধানে এবং ভেবে-চিন্তে করতে হয়, তেমনি বিচার ব্যবস্থায় একজন বিচারককেও ঠিক সেভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং আচরণ করতে হয়। সবার কথা শুনে-বুঝে এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তবেই একটি রায় দিতে হয়।
আদালতকে যদি একজন বিচারকের পরিবার বিবেচনা করা হয়, তাহলে সেই পরিবারের সদস্য হলো বাদী, বিবাদী, আইনজীবী, কর্মচারি এবং তাঁর ঊর্ধ্বতন বিচারক মহোদয়। যেহেতু ঊর্ধ্বতন বিচারকের প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে একজন বিচারক বিচারকার্য পরিচালনা করেন, তাই তিনিও এই পরিবারের সদস্য। অর্থাৎ ঊর্ধ্বতন বিচারক মহোদয় হলেন বিচারক মহোদয়ের বাবা। অনেক সময় পরিবারের কর্তাকে তাঁর বাবার কথা শুনতে হয়, নইলে বাবা তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কর্তাকে সেভাবে ব্যবহার করতে দেন না কিংবা বঞ্চিত করেন। সুতরাং এব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হয় বিচারকদের।
অনেক সময় দেখা যায়, কর্তা একটি বিষয় সঠিক ও ন্যায় সঙ্গত মনে করছেন কিন্তু কর্তার বাবার বাধার কারণে সেটি ন্যায় সঙ্গত কাজ মনে হলেও কর্তা করতে পারছেন না।বাদী ও বিবাদী হলো বিচারকের সন্তান। আর দুই পক্ষের দুই আইনজীবী হলো কর্তার দুই ছোট ভাই। এই দুই ছোট ভাই কর্তার দুই সন্তানের পক্ষ নিয়ে কথা বলে। কেউ হারে কেউ জিতে। যে আইনজীবীর কথা বিচারক সমর্থনযোগ্য মনে করেন সেটি গ্রহণ করেন আর যেই আইনজীবীর কথা সমর্থনযোগ্য মনে করেন না তিনি মুখে যাই বলুক না কেন কর্তা হুম হুম করে শোনার ভান করে এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেন। পরিশেষে নিরূপায় হয়েই দাড়িপাল্লা এক দিকে একটু ভারী করে দিয়ে বিচারক চেয়ার থেকে নেমে পড়েন। এই হলো বিচারকের নিজ পরিবারের কথা।
এবার আসা যাক, বিচারকের সমাজ প্রসঙ্গে। বিচারক শুধু আদালতেই বসে থাকেন না, তাঁকে সমাজে মিশতে হয় চলতে হয়। অর্থাৎ কর্তার কাছে যেমন পরিবার চালাতে অর্থ লাগে, তেমনি আদালতের উঁচু চেয়ারে বসে বিচার করতে হলে পদাধিকার, ক্ষমতা ও আইন লাগে। এগুলি একজন বিচারকের নেই। সে নিজে নিজে এগুলি তৈরী করতে পারেনা। অন্য কর্তৃপক্ষের নিকট হতে এগুলি ক্রয় করে আনতে হয়। যেমন, তাঁর কাজের অধিক্ষেত্র, ক্ষমতা ব্যবহারের সীমা ইত্যাদি নির্ধারণ করে দেয় সরকার এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। প্রোমোশন, ট্রান্সফার, ছুটি ইত্যাদিও নির্ভর করে সরকারের হাতে। অনেক সময় দেখা যায়, এই কর্তার কর্মকান্ড সরকার এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের খুব একটা ভাল লাগে না। কর্তা নিজেকে তাঁর সমাজে ঠিক সেভাবে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। এই দায়কর্তার নিজের না কর্তার সমাজের সেটি সত্যই একটি বিতর্কিত এবং স্পর্শকাতর বিষয় বৈকি।
আইনের দুইটি দিক রয়েছে। এক হলো তত্ত্বীয় দিক অর্থাৎ যা বই বা পুস্তকে লেখা থাকে সেগুলিই সোজা ভাষায় তত্ত্বীয় দিক। আরেকটি হলো ব্যবহারিক দিক। পুস্তকে লেখা আইনগুলি বিচারকরা কিভাবে প্রয়োগ করবেন সেগুলিই হলো আইনের ব্যবহারিক দিক। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় আইনের যতটা না তত্ত্বগত সমস্যা রয়েছে, তার চেয়ে ব্যবহারিক সমস্যা রয়েছে অনেক গুণ বেশি। আইনে ভাল ভাল কথা লেখা থাকে কিন্তু সেগুলি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক সমস্যা রয়েছে বহুমুখী।
প্রথমে ব্যবহারিক দিক নিয়ে কথা বলতে চাই। আইনের ব্যবহারিক সমস্যার কথা চিন্তা করতে গেলে গোড়া থেকেই শুরু করা দরকার। অর্থাৎ একজন ছাত্র যখন আইন পড়ার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি হয় তখন থেকে।
তৃতীয় অংশ।
একজন শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের যাত্রা শুরু করে, তখন তার চোখে থাকে হাজারো স্বপ্ন। তাদের নিয়ে স্বপ্ন থাকে তাদের পিতা-মাতারও। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন অনেক বাবা-মাকেই দেখতাম তাদের আদরের নাদুস-নুদুসকে নিয়ে ক্যাম্পাসে আসতে। নাদুসগুলো আদরের ঠেলায় যেন একেবারে ডগমগ! মিঠা মিঠা অভিমানের সুর ছাড়া কোন কথাই যেন বের হয় না মুখ দিয়ে। আর গায়ে মনে হয় মাংস হবে আড়াই মন। বাবা-মা তাদেরকে ক্লাসে রেখে যেত নতুন অবস্থায়। অবশ্য কিছুদিন পর নাদুসগুলো একাই আসা শুরু করত; বাবা-মা আর কয় দিন আসবে! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আদরে ডগমগ ছেলে-মেয়ে বেশ কম পাওয়া যায়। এখানে পড়তে আসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিজয়ীরা; অধ্যবসায়ী আর পরীক্ষিত সেনারা। মফস্বল শহর এবং গ্রামের মধ্য-বিত্ত পরিবারের ধ্রুবতারা যারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। এর আগে এ বিষয়ে ধারণা নেওয়ার সুযোগ খুব কম। সচরাচর এখানে আইন শেখান এমন কিছু লোকজন যাঁরা কখনও কোর্টে যান না, প্র্যাকটিকাল নলেজ যাদের কম। তবে আইন বিষয়ে ইনাদের ভাল একাডেমিক রেজাল্ট ছিল। ওটুকুই সম্বল। এছাড়া থলিতে মনে হয় আর কিছু পাওয়া যাবে না লাইট মেরে খুঁজলেও। শিক্ষক হয়ে যাওয়ার পর ইনারা মনে হয় একেকটা নবাবজাদা হয়ে যান। এর পর শুধু আরাম আর আয়েশ! আর সাথে ফাঁকিবাজি চর্চা। কেউ কেউ রাজনীতি চর্চাও শুরু করেন যাতে চামচামির ফসল ঘরে তোলা যায় সময়মত। যাতে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া যায় সহজেই। তাহলে একাডেমিক চর্চা? সেটি পরে হবে। এর পর শুরু হয় সরকারি কোয়ার্টারে সুন্দরী বউ নিয়ে দিনযাপন আর বাচ্চা পালন; আর মাসে মাসে সময় মত বেতন উত্তোলন। আর সপ্তাহে দুই একদিন ক্যাম্পাসে গমন, সেথায় বসে চা ভক্ষণ এবং ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে পুস্তক পঠন।
ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নাম খুজে পাওয়া যায় না সহজে। এর কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচারদের জবাদীহিতার কোন জায়গা নেই। না করে এরা ছাত্রদের কাছে জবাবদীহি, না করে সরকারের কাছে। এ যেন এক ভূস্বর্গ। আরাম-আয়েশ আর ফাকিবাজির পীঠস্থান।
স্যাররা দ্রুত ক্লাস শেষ করে ছোঁ মেরে বাসার দিকে ছুটবেন কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পার্ট-টাইম কামলা খাটার জন্য সজোরে দৌড় মারবেন। একাডেমিক পড়াশুনা বা রিসার্চের পাছায় গুল্লি। নিজ অফিসে এক দন্ড বসে গবেষণা করার টাইম নাই ইনাদের। ছাত্রজীবনে যা শিখেছিলেন, ঐ একই ডায়ালগ সব জায়গায় মেরে বেড়াবেন। কোন কোন জনাব বলে বসেন, “আগামী মঙ্গলবারের ক্লাসটি বৃহষ্পতিবারে একসাথে নিয়ে নিব”, আবার অনেকের ক্লাসে আসার কথা থাকলেও আসেন না; সেদিন তার ক্লাস মিস। আবার কোন কোন পন্ডিতমশাই সকালে অন্য কোথাও ব্যস্ত থাকবেন বলে তার ক্লাসটি বিকেলে কোন এক ফ্রি শিডিউলে নিবেন বলে মেসেজ পাঠান ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভের কাছে। এই হলো ইনাদের হালচাল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ শুধু ছাত্র পড়ানো নয়। রিসার্চ এবং গবেষণা করাও। দুই একজন ছাড়া দেখলাম না কাউকে কোন গবেষণা করতে কিংবা কোন জার্নালে লিখতে। তাহলে বলেন, ইনাদের কাছ থেকে কতটুকু শিক্ষা নিবে আইনের একজন নবীন ছাত্র।
এছাড়াও, রাজনৈতিক চামচামি আরা দালালীর জন্য গঠিত হয়েছে নীল-দল, সাদা-দল। অনেক শিক্ষক পাওয়া যাবে যারা বিভিন্ন দলের চামচামি করার জন্য যে পরিমাণ দৌড়-ঝাপ আর মাথা খাটান, ক্লাসের পড়া প্রস্তুত করা নিয়ে তার দশ ভাগের এক ভাগ মাথা খাটান না। চামচামি করলে নানা পদ পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় যে! যেমন হাউস টিউটর, প্রোভোস্ট, প্রোক্টর, ডিন, প্রোভিসি, ভিসি ইত্যাদি হওয়ার চান্স। কেননা, যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, সে সরকার একই পালের গরু খোজা শুরু করে আগে। চেতনায় চেতনায় মিলে গেলে তালত ভাই। আর কী লাগে! গলাগলি শুরু এং যথারীতি গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন। মেধা, গ্রহণযোগ্যতা, বিচক্ষণতা এবং সমগ্র ছাত্রসমাজের কল্যাণের বিষয়টি মূখ্য বিষয় হয়ে ওঠে না তখন।
আবার, নিজ দলের অনেক মেধাবী ও স্বনামধন্য শিক্ষাবীদ থাকলেও তাঁদের অনেক সময় বড় পদে বসানো হয়না। কারণ, ইনারা মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে সম্মানিত জায়গায় পৌছেছেন, চাইলেই রাজনৈতিক দলগুলো ইচ্ছামত সকল কাজ ইনাদের দিয়ে করাতে পারে না। কিংবা ইনারা করেনও না। এজন্যই হয়তবা স্বনামধন্য শিক্ষাবীদ, জাতীয়ভাবে সুপরিচিত শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পদে দেখিনা আমরা খুব একটা।
আসিফ নজরুল। এই শিক্ষকটি একজন ভাল মানের শিক্ষক। ইনার ক্লাস কখনই বিরক্ত লাগতো না। অনেক সহজ ভাষায় কথা বলতেন তিনি। তবে কিছু কিছু শিক্ষকের লেকচার শুনে মনে হতো আইন মনে হয় রকেট সায়েন্সের কাছাকাছি কিছু একটা। এদের লেকচার শুনে মাথা কেমন জানি রকেটের মত ঘুরত। কাগজের রকেট আকাশে ছুঁড়ে মারলে যেমন বনবনাবন ঘোরে আর কী। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আইন একটি মজার সাবজেক্ট এবং আহামরি কঠিন সাবজেক্ট নয়। আমার এখন কেন জানি মনে হয় ঐসব শিক্ষকদের আসলে কিভাবে ছাত্রদের শেখাতে হয়- সেই জ্ঞানই আয়ত্ব করা উচিত সর্বাগ্রে। দরকার হলে ট্রেনিং নেওয়া উচিত।
আবার, অনেক শিক্ষকমহোদয় ক্লাসে প্রস্তুতি নিয়ে আসেন না। খবরের কাগজ পড়ার মত করে পুস্তক পড়েন আর একটু পর পর হাতের দামী ঘড়ির দিকে তাকান। কখন যে পঞ্চাশ মিনিট হবে! বেচারা শিক্ষক! তিনিও বাঁচবেন, ছাত্রদেরকেও রেহাই দিবেন। ছাত্ররা বাসায় পড়ে নিবে- এই ভেবে নিজেকে শ্বান্তনা দেন ইনারা।
চতুর্থ অংশ
অনেক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল রেজাল্ট করে বলে ধরে নেওয়া হয় এই ছাত্রকে শিক্ষক বানালে সে মনে হয় ভাল শিক্ষক হয়ে জাতীকে অনেক সেবা প্রদান করবেন। এই চিন্তাধারা সঠিক নয়। ভাল ছাত্র হলেই ভাল শিক্ষক হওয়া যায় না। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সিন্ডিকেট, স্বজনপ্রীতি, হ্যালো’র প্রভাব রয়েছে বেশ জোরালোভাবে। শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া পিএসসি’র হাতে অচিরেই তুলে দেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিম্নমানের হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এখানকার নিয়োগ প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ ও ত্রুটিপুর্ণ। দায়িত্ব সম্পর্কে নেই কোন জবাবদীহিতা। ইনাদের যে উদ্দেশ্যে স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হয়েছে, ইনারা সেটিকে কাজে লাগাতে পারছেন না বরং জাতী হিসেবে আমাদের দীর্ঘমেয়াদে পিছিয়ে দিচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নামমাত্র পরিক্ষা আর ভাইভা নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে কম যোগ্য লোকজন প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে আইনের মত প্র্যাকটিক্যাল একটি বিষয়ে এমন ব্যক্তিদের দিয়ে ছাত্রদের পড়ানো উচিত যাঁদের আইন বিষয়ে ব্যাপক বাস্তবিক অভীজ্ঞতা এবং সহজে বুঝানোর ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ এই প্র্যাকটিক্যাল সাবজেকটি প্র্যাকটিসরত আইনজীবীদের দিয়েই শেখানো উচিত। যদি তাত্ত্বিক বিষয়ে পটু শিক্ষক নিয়োগ দিতেই হয় তাহলে তাদের পড়ানোর সক্ষমতা যাচাই করে নিতে হবে নিয়োগ দেওয়ার সময়েই। কেননা, জ্ঞান জানলেই হবে না, সেই জ্ঞান সহজে ছাত্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে না পারলে কিংবা ছাত্ররা সেই শিক্ষককের কথা বুঝতে না পারলে সেই শিক্ষকের হাজারো মূল্যবান জ্ঞান মূল্যহীন হয়ে পড়বে।
শিক্ষকদের পাঠদানে ও গবেষণায় ব্যর্থতার সাথে সাথে রয়েছে হলের উলঙ্গ ছাত্র রাজনীতি এবং উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র নেতৃত্ব। আবরার ফাহাদ হত্যাই এর বড় প্রমাণ। এদের কাজই হলো রাজনীতি করা। স্বপ্ন হলো রাজনীতিতে ক্যারিয়ার গড়া আর বড় দলগুলীর বড় নেতাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া, প্রটোকল দেওয়া ইত্যাদি। ইয়ার ড্রপ দিয়ে হলেও এরা ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়। তবু নেতা হতে হবে। বড় পদ পেতে হবে। এ দায় শুধু ছাত্রদের একার ঘাড়ে চাপালে ভুল হবে। খারাপ ছাত্র রাজনীতির সংস্কৃতির জন্য মহান দলগুলির মহান নেতাগুলোই আসলে বেশি দায়ী। ছত্রানং অধ্যয়ং তপঃ। অধ্যয়নই ছাত্রদের প্রধান তপস্যা হওয়া উচিত। জানিনা পৃথিবীর কোন দেশে এত প্রফেশনাল ছাত্ররাজনীতি রয়েছে।
যাই হোক, হলে থাকতে হলে প্রথম দুই এক বছর রাজনীতির ছবক নিতে হয় নবীনদের। পরম শ্রদ্ধেয় বড় ভাইদের নিকট থেকে। গেস্টরুমে সিনিয়রদের গেষ্ট হতে হয় রাতের বেলা। গেস্ট হিসেবে বকা আর ইন্সাল্টিং হলো আপ্যায়ন। একটু ইচড়ে পাকা হলে প্যাদানী ফ্রি। কথাগুলি যে অসত্য নয় তা মাঝে মাঝে পত্রিকা পড়লেই বোধোদয় হয় আমাদের। আমরা পড়ি এবং কিছুদিন পর তা ভুলে যাই।
প্রথম কথা শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে আগে। ইনাদের নিয়োগ, প্রমোশনের জন্য আলাদা কমিশন যদি গঠন করা লাগে তবু করতে হবে। শিক্ষকরা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে কিনা তা এই কমিশন দেখভাল করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রক্ত মাংসের মানুষ। এরা ফেরেস্তা নন যে এরা কাজে ফাঁকি দিবেন না।
সরকারের আরও দায়িত্ব আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বড় বড় পদগুলিতে দল-মত নির্বিশেষ মেধাবী ও দেশ বরেণ্য শিক্ষাবীদদের নিয়োগ দিতে হবে- সে যেই দলেরই হোক না। রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাত্রদের হাতিয়ার বানানো থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলে ছাত্ররা এমনিতেই সুস্থ রাজনীতির দিকে ফিরে আসবে এবং নিরীহ ছাত্রদের উপর দমন-পীড়ন কমিয়ে দিবে।
ভার্সিটির হলগুলোতে দেখা যায় মাস্টার্স শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে, অথচ বুড়ো ছাত্রগুলো এখনও হল ছাড়ে নাই। এদের হল থেকে ঝেটিয়ে বিদায় না করলে নবীনরা হলে জায়গা পাবে কীভাবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বেশির ভাগ ছাত্র মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। গ্রাম থেকে কিংবা মফস্বল শহর থেকে। ছাত্রজীবনে প্রথম দু’বছরই সব চেয়ে ক্রিটিক্যাল সময়। সরকারের উচিত হবে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আগে সিট দেওয়ার ব্যবস্থা করা। তারপরে অন্যদের। কিন্তু আমাদের দেশে দেখি এর উল্টো টা।
শেষ অংশ
ভাল আইনজীবী কিংবা ভাল বিচারক পেতে হলে ছাত্রাবস্থা থেকেই তাদেরকে ভালভাবে গড়ে তোলা দরকার। ছাত্রজীবনে যদি ফাঁকিবাজি করে কিংবা সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে পড়াশুনা ভালভাবে করতে না পারে তবে তারা ভাল আইনজীবী হতে পারবে না, ভাল বিচারকও হতে পারবে না। জুডিশিয়ারি পরীক্ষা দিয়ে যারা অল্প বয়সে জজ হয়ে যাচ্ছেন এবং অল্প বয়সে জনগণের নানাবিধ বিষয়ে বিচার করা শুরু করে দিচ্ছেন, তাদের ব্যাপারে তেমন আপত্তি নেই তবে জজের চেয়ারে বসার আগেই যথাযথ ট্রেনিং দিয়ে দেওয়া উচিত এই সকল তরুণ বিচারকদের।
আইনজীবী তালিকাভুক্তির যে পরীক্ষানেওয়া হচ্ছে সেটিকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে তোলা প্রয়োজন। আইনজীবীর সার্টিফিকেট যেন খুব সস্তা না হয়ে যায়। আইনবিষয়ে ভালভাবে পড়াশুনা করে, জেনে তবেই যেন একজন আইনের ছাত্র এই সনদ হাতেপায়।দেশে মামলার তুলনায় আইনজীবীর আনুপাতিক হারের দিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার। এছাড়াও মাঝে মাঝে অনেক সিনিয়র আইনজীবীদের বলতে শোনা যায়, আইনজীবীর অদক্ষতার কারণে অমুক ক্লায়েন্টের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। সুতরাং আইনজীবীদের পরিমাণ এবং গুণগত মান- দুটির দিকেই মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে।
মানুষ যখন বন্দী হয়, তখন সে অসহায় হয়ে পড়ে। কারাগারে বন্দী অবস্থায় থাকলে যে কোন মানুষই সেখান থেকে মুক্ত হবার জন্য প্রতিনিয়তই ছটফট করতে থাকেন। কিংবা কারও বসত ভীটা কিংবা জীবিকা নির্বাহ করে খাওয়ার জমিটুকুর জন্যেও আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। তখন মানুষ একেবারে অসহায় হয়ে পড়ে। এই অসহায় অবস্থায় আবার যদি বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা হয়, ঢিলেমী হয়, তখন এই লোকগুলো সত্যই একেবারে আধ-মরা হয়ে পড়ে। সুতরাং এমন বিপদের মূহুর্তে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে যেসকল বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ সম্পৃক্ত রয়েছেন, তাঁদের সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা ও ক্ষমতা ব্যবহার করে এ সকল অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো দরকার।
উচ্চ আদালতে যখন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের পছন্দের আইনজীবীর মধ্য থেকে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয় বলে আদালত এলাকায় আলোচনা শোনা যায়। একটি রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের চেতনার লোককে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে চাইবেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেই অনেক ভাল ভাল আইনজীবী রয়েছেন। তাদের মধ্যে থেকেও যদি নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলেও খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু একেবারে দলকানা ও উগ্র রাজনৈতিক সমর্থকদের বিচারকের চেয়ারে না বসানোই শ্রেয়। কেননা প্রতিটি রাজনৈতিক দলই যদি অন্ধভাবে একই কাজ করে, তাহলে বিচারবিভাগও এক সময় অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বিচারক এবং আইনজীবীরা দুই ভাই। একভাই উপরে থাকে আর আরেক ভাই নীচে। দুজনেই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে। সুতরাং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায়, বিচার বিভাগের গৌরব ও মান-মর্যাদা রক্ষায় সব সময় একে অপরের পরিপূরক হওয়া উচিত, পাশে দাঁড়ানো উচিত। শত্রু কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা বুদ্ধিমানের কাজ নয় এবং সেটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য এবং বিচারবিভাগের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না।
কিছুদিন আগে সুপ্রীম কোর্ট বারের নির্বাচন হয়ে গেল। আমার মনে হয়, উক্ত নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল বিজয়ী হয়নি। বিজয়ী হয়েছে ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্বের প্রভাব যে রাজনৈতিক চেতনার চেয়ে বেশি হতে পারে সেটি এবারের নির্বাচনে প্রমাণ পাওয়া গেল। আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি-দু’দল থেকেইএকজন করে দুজন সর্বোচ্চ কর্তা নির্বাচিত হয়েছেন সুপ্রীম কোর্ট বারে। মনে হয় না কম প্রচার এবং সহযোগিতা করা হয়েছিল দলীয় পর্যায় থেকে। তবুও একই সাথে দুটি পদ ছিনিয়ে আনা সম্ভব হয়নি দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের কারও পক্ষেই। যারা পরাজিত হয়েছেন, আমার মনে হয়না ইনারা দলের কাছে পরাজিত হয়েছেন। আসলে ইনারা পরাজিত হয়েছেন ব্যক্তিত্বের কাছে। পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটাই ছিল খুব স্বচ্ছ। এখানে অনৈতিকভাবে বিজয়ী হওয়ার কোন খায়েস বা নির্বাচনকে বিতর্কিত করার কোন নীল নকশা ছিলনা। এই স্পিরিট টাকেই হৃদয়ে লালন করতে হবে বিচার বিভাগ ও আইনজীবীদের। অর্থাৎ রাজনৈতিক মতাদর্শের চেয়ে ব্যক্তিত্ব, স্বচ্ছতা, ন্যায়পরায়নতা, ভ্রাতিত্ব ও অসহায় মানুষের কল্যাণের চেতনাকে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হওয়া উচিত। তবেই সকল পর্যায়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলকের সূচনা করা সম্ভব হবে।
লেখকঃ রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।