।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।যে দেশের মানুষ রাষ্ট্রীয় পদ ও পদক পাওয়ার জন্য সদা উন্মুখ থাকেন এবং পাবার জন্য নীতি নৈতিকতাকে পর্যন্ত কবর দিতে বুল করেন না, সে দেশের একজন রাজনীতিক সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক গ্রহণ না করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। যা আজকের ও আগামী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় ও অনুস্মরনীয় হযৈ থাকবে।
আর সাহসী ও নির্লোভ ব্যাক্তিটি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজবনগর সরকারের অন্যতম সদস্য ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। যিনি কুঁড়েঘরের মোজাফফর বলেই পরিচিত ছিলেন। সরকার ২০১৫ সালে অন্যদের সঙ্গে তাঁকেও স্বাধীনতা পদক দেওয়ার ঘোষণা দিলে তিনি সবিনয়ে তা নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর মত ছিলো, ‘রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা। পদ বা পদবীর জন্য কখনও রাজনীতি করিনি। শেখ মুজিব আমাকে অনেক কিছু বানানোর চেষ্টা করেছিলেন, আমি হইনি। আমি মহাত্মা গান্ধী, মওলানা ভাসানীর অনুসারী। ’
তিনি বলেছিলেন, পদক দিলে বা নিলেই সম্মানিত হয়, এ দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই। দেশপ্রেম ও মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি রাজনীতিতে এসেছি, কোনো পদক বা পদবি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেনি। সত্যিকার অর্থে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তারা কেউই কোনো প্রাপ্তির আশায় করেনি।
সেই মহান নেতা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদের জন্মদিন আজ ১৪ এপ্রিল, ২০২১।
মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূইয়া, মায়ের নাম আফজারুন্নেছা। তার পিতা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। মোজাফফর আহমদ যথাক্রমে হোসেনতলা স্কুল ও জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশনে প্রাথমিক, দেবিদ্বার সরকারি রেয়াজ উদ্দিন পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং ইউনেস্কো থেকে একটি ডিপ্লোমা লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র জনাব মোজাফফর দীর্ঘদিন বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। শেষমেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। তার রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত বর্ণিল। রাজনীতি অঙ্গনে তার শুভসূচনা হয় ১৯৩৭ সালের দিকে। তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিজ জেলা কুমিল্লার দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দেন রাজনীতির ময়দানের সবাইকে। আওয়ামীলীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালের ৩রা এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ এর প্রতিনিধি নেতা হিশেবে অধ্যাপক মোজাফফর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে ১৯৫৮ সালের দিকে। তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা পর্যন্ত করা হয়। আত্মগোপন থাকা অবস্থায় তিনি আইয়ুব সরকার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সুসংগঠিত করেন। দীর্ঘ আট বছর সময়ব্যাপী আত্মগোপনে থাকবার পর ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বাম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুর জেলায় অনুষ্ঠিত এক কাউন্সিল অধিবেশনের পর চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী-এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মাওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী খান। মস্কো শিবিরে পূর্ব পাকিস্তানপন্থী ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ মোজাফফর ন্যাপ নামেও পরিচিত ছিল। অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কারাবরণও করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিবনগর সরকার ছয় সদস্যের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অন্যান্য সদস্যরা হলেন কমরেড মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করেন। সে সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নিজস্ব উনিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনে অধ্যাপক আহমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হলে তিনি ন্যাপ, সিপিবি এবং প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের শুরুতে অধ্যাপক আহমদ কারারুদ্ধ হন। রাজনীতি জীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের নানান দেশে সফর করেন। তার সহধর্মিণী আমিনা আহমদ বর্তমানে ন্যাপের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সভানেত্রী হিসেবে আছেন বাংলাদেশ নারী সমিতিতে। ১০ম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের মহিলা সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি।
সমাজতন্ত্র কি এবং কেন, প্রকৃত গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার কথা, মাওবাদী সমাজতন্ত্র ও কিছু কথা নামক বই রচনা করেছেন তিনি।
তার প্রয়াসে মদনপুরে তার প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের একমাত্র শিক্ষায়তন ‘সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ’। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেষ দিন পর্যন্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর নিজেকে ‘কুঁড়েঘরের মোজাফফর’ বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম এ ব্যক্তিত্ব নিজেকে সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করতে ভালোবেসেছেন আজীবন। অধ্যাপক আহমদ ব্যক্তিজীবনে কথাবার্তা বলতেন কিছুটা কৌতুকমিশ্রিতভাবে; কখনো থাকে প্রচ্ছন্ন হেঁয়ালির ছোঁয়া। তিনি কাছের মানুষদের কাছে একসময় বলতেন, “আমার নাম মোজাফফর আহমদে নূরী, আমি পথে পথে ঘুরি”।
দীর্ঘদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট রাত ৭টা ৪৯ মিনিটে ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
তার রাজনৈতিক জীবন ছিল অত্যন্ত বর্নিল। ১৯৩৭ সালে মাত্র ১৫ বছরের কিশোর বয়স থেকেই তিনি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ১৯৩৭ সালে কুমিল্লা জেলার চান্দিনা গরুবাজারে বৃটিশ হটাও আন্দোলনের অংশ হিসেবে আয়োজিত এক জনসভায় মহত্মা গান্ধী ভাষন দেয়ার সংবাদে গান্ধীকে দেখার জন্য অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ ওই সভায় বাড়ি থেকে পায়ে হেটে যোগদান করেন। তখন তার ধারনা ছিল একটি জাতীয় পোকা গান্ধীজী দেখতে কেমন। যখন দেখলেন গামছা পড়া লাঠি ভর করে এক ব্যক্তি (গান্ধীজি) মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিচ্ছেন,- ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই হো- এক হো, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাকো খতম কর’ আহবান জানিয়ে আরো দু’একটি কথা বলেই তিনি বক্তব্য শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে যান থকণ তিনি অবাক হলেন, এতোবড় নেতা যাকে দেখতে এলাম, বক্তিতা শোনতে এলাম তিনি একটি উপদেশমূলক আহবান জানিয়ে চলে গেলেন। সেই মর্মার্থ খুঁজতে যেয়ে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
একটি স্বাক্ষাতকারে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ রাজনীতির দুরবস্থা কেন? প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, রাজনীতি পেশাও নয়, ব্যবসাও নয়। রাজনীতি হলো একটি অঙ্গীকার, যার মূল লক্ষ্য জনসেবা। রাজনীতির ভিত্তি হবে নিজের দেশকে ভালোবাসা, গরিব মানুষের স্বার্থরক্ষা করা।মোজাফফর আহমদের এই উপলব্ধি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাবে কি না, সে প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎই দেবে।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদের শততম জন্মদিনে তার অমর স্মৃতির প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা। মেহনতি মানুষের সংগ্রাম যতদিন চলবে জনতা তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দেশের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভূমিকার কথা স্বরণ করেন। দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে তার অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করবে।
[ লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন]