মীর আব্দুল হালিম
চুক্তি আইনের প্রধান মূলনীতি রোমান আইনের এই নীতি থেকে উদ্গত যে, ‘Pacta Sunt Servanda’ তথা চুক্তি অবশ্যই পালন করতে হবে। এই মূলনীতি সিভিল ল, কমন ল এমনকি ইন্টারন্যাশনাল ল তেও গ্রহণ করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ৩০ শে জানুয়ারী ২০২০ তারিখে, ২০১৯-২০ সালে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরী অবস্থা এবং ১১ই মার্চ ২০২০ তারিখে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক বণিক সমিতি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং অন্যান্য বাণিজ্য সংস্থা গুলো বর্তমানে অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করছে। করোনা ভাইরাসের কারণে, অভ্যন্তরীণ এবং আন্ত:দেশীয় ব্যবসা বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশেষ করে সাধারণ অথবা বিনিয়োগ চুক্তিগুলো। কারণ, লকডাউন, জরুরী অবস্থা বা চলাফেরায় অন্যান্য সীমাবদ্ধতা থাকায় অনেক ব্যবসায়ী হয়তো তাদের বিনিয়োগকারী, সরবরাহকারী, চুক্তিকারী , ব্যবসায়ী বা পরমর্শকারীদের সাথে করা চুক্তি পালন করতে ব্যর্থ হতে পারেন। সুতরাং, এইসকল চুক্তি যেগুলো এই মহামারীর জন্য ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেগুলো পালন না করার পরিণাম কি ? বিনিয়োগকারীদের কি হবে? অথবা বিশেষ করে কারা এই মহামারীর স্বীকার?
করোনা মহামারী ২০১৯-২০ এবং বিনিয়োগ চুক্তির কথা হলো: করোনা ভাইরাসের কারণে রাষ্ট্র ও বিদেশী বিনিয়োগকারীগণ তাদের অবস্থান প্রযোজ্য বিনিয়োগ চুক্তির অধীনে বিবেচনা করতে পারে? করোনা ভাইরাসের কারণে উদ্ভূত সমস্যাগুলো মোকাবেলায় নেওয়া ব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে কি রক্ষা করা হবে, নাকি সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে? এইসকল প্রশ্নের উত্তর খুব দ্রুত দরকার।
দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির অবস্থা:
বিনিয়োগ বাড়াতে ও তা সংরক্ষণ করতে বাংলাদেশ ৩২ টি দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দেশগুলো হলো, অস্ট্রিয়া, উত্তর কোরিয়া, বেলজিয়াম, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চায়না, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, জার্মানি, ভিয়েতনাম, রোমানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, ইরান, নেদারল্যান্ড, ইন্ডিয়া, ইতালি, ফিলিপাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, তুরস্ক ও বেলারুশ। বাংলাদেশ MIGA, OPIC, ICSID, WAIPA, WIPO এবং WTO তেও স্বাক্ষরকারী দেশ। এছাড়াও বাংলাদেশ APTA, BIMSTEC, IORA, SAPTA, SAFTA, SAFAS, COMCEC, TPS-OIC এর মত বহুপাক্ষিক আঞ্চলিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া ডি-এইট দেশগুলোর সঙ্গে পক্ষপাতমূলক কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাছাড়াও বাণিজ্য সহায়তার জন্য বাংলাদেশে আরো ৪৫ টি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। রাষ্ট্রীয়করণ বা বাজেয়াপ্তকরন সংক্রান্ত বিষয় থেকে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগগুলো নিরাপদ। আন্তর্জাতিক বেসরকারি বিনিয়োগ (সমৃদ্ধি ও সংরক্ষণ) আইন ১৯৮০ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এফডিআইয়ের ২০১৮ সালে বাংলাদেশে আন্তঃপ্রবাহ 1415.99 মিলিয়ন ডলার। এই বিষয়টা ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে উদয় হতে পারে এবং আমাদের সরকার ও অন্যান্য আইনি সংস্থাগুলোর এ বিষয়ে ন্যায্য উত্তর দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।
সাধারণত যদি কোন বিনিয়োগকারী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় নেওয়া কোন দেশের কোন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে প্রধান যে ইস্যু উদগত হবে তা হলো যে এই ব্যবস্থাটি বিনিয়োগ চুক্তির কোন গুরুত্বপূর্ণ বিধান ভঙ্গ করে কিনা। রাষ্ট্র যুক্তি উত্থাপন করতে পারে যে, যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা ন্যায্য বাণিজ্যের বিধান ভঙ্গ করেনা এবং এটা রাষ্ট্রীয়করণ বা বাজেয়াপ্তকরনেরও ইঙ্গিত দেয় না। রাষ্ট্রের এটা প্রমাণ করতে হবে যে এই ব্যবস্থাটি প্রাসঙ্গিক কর্তব্যের সঙ্গে অসঙ্গত নয়। সুতরাং পরবর্তী প্রশ্ন উদ্ভূত হয় রাষ্ট্রের এমন দাবির একটি বৈধ আত্ম সমর্থনের সুযোগ আছে কিনা ? বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাষ্ট্র এই চুক্তির বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারে ব্যতিক্রম বিধি এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে।
ব্যতিক্রম বিধির অধীনে সুরক্ষা লাভ:
চুক্তির মধ্যে যদি কোনো ব্যতিক্রম বিধি রাখা হয় তাহলে তা প্রাধান্য পাবে ।সাধারনত ব্যতিক্রম বিধিগুলো উল্লেখ করে যে এই চুক্তির কোনকিছুই কোন রাষ্ট্রকে মানব জীবন অথবা মানব স্বাস্থ্যকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিতে বাধা প্রদান করবে না। তবে সেই ব্যবস্থা কোনক্রমেই স্বেচ্ছাচারী বা বৈষম্যমূলক হতে পারবেনা। অধিকাংশ দেশগুলো কোন মহামারীতে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম বিধিগুলো ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক চায়না-অস্ট্রেলিয়া মুক্তবাণিজ্য চুক্তি এটা উল্লেখ করে যে, জনস্বাস্থ্যের বৈধ কল্যাণের উদ্দেশ্যে নেওয়া কোন অবৈষম্যমূলক ব্যবস্থা কোন বিনিয়োগকারীর দাবির অধীনে থাকবে না।
প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সুরক্ষা লাভ:
রাষ্ট্রগুলো প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সুরক্ষা লাভ করতে পারে এমনকি যদি সেগুলো চুক্তিতে উল্লেখ করা নাও থাকে। কারণ এগুলো আন্তর্জাতিক ল কমিশন রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ সমূহের মাধ্যমে বিধিবদ্ধ করেছে। এগুলোকে ‘অবৈধতা প্রতিরোধকারী অবস্থা সমূহ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো কোন বিশেষ কাজ করার ক্ষেত্রে আইনী শৃংখলার অনুমতিকে নির্দেশ করে। আর আলোচ্য কাজ অবশ্যই বৈধ। আন্তর্জাতিক আইন লংঘন উল্লেখ করার পরিবর্তে, কোন কিছু যে লংঘণ করা হয়েছে তা তারা বর্জন করে। চুক্তি সম্পাদনযোগ্য থাকবে কিন্তু যে সকল অবস্থা গুলি রাষ্ট্রকে চুক্তি ভঙ্গের দায় থেকে সুরক্ষা প্রদান করে সেসকল অবস্থা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় চুক্তি ভঙ্গের জন্য রাষ্ট্রকে দায়ী করা যাবেনা। প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের এমন ৬ টি অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে যেখানে কোনো চুক্তি ভঙ্গ করলেও রাষ্ট্রকে চুক্তি ভঙ্গের দায়ে দায়ী করা যাবে না। এই অবস্থা গুলো অবশ্যই করোনাভাইরাস পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত। অবস্থা গুলি হল ২. দৈবশক্তি, ২.সংকটাবস্থা, ৩.অপরিহার্যতা। এই তিনটি পরিস্থিতির অধীনে সুরক্ষা পেতে কঠোর নিয়ম অনুসরণ করা হয়। এছাড়া আরো তিনটা অবস্থা আছে যেখানে প্রথম তিন অবস্থার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলোসেগুলো হলো: ১.যৌক্তিকতা, ২.কর বিহীন দাবি ও ৩.সমানুপাতিক।
এখন আমরা গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে এরকম পরিস্থিতিতে চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা দেখব।
২০০৯: সাইপেম এবং বাংলাদেশ সরকার:
2009 সালে ICSID সালিশ ট্রাইব্যুনালে, দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির অধীনে আইসিসিতে সাইপেমের সালিশের অধিকার বাংলাদেশী কোর্টের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে স্বত্বনিরসন করার কারণে বাংলাদেশকে দায়ী করা হয়। ট্রাইবুনালটি রায়ে বলে যে বাংলাদেশ নিউইয়র্ক কনভেনশন ভঙ্গ করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতির অধীনে তার অধিকারের অপব্যবহার করেছে ট্রাইব্যুনালটি আইসিসি কর্তৃক ঘোষিত ক্ষতিপূরণের সঙ্গে আরো কিছু মুনাফা যোগ করে রায় প্রদান করে। সাইপেমের পক্ষে দেওয়া রায়টি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ চুক্তি সম্পর্কিত সালিশ এ যে কোন বিবাদপূর্ণ বিষয়ক আলোচনায় একটি বিরাট মাইলফলক তৈরি করে।
বিরোধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই যে সাইপেম (একটি ইতালিয়ান বিনিয়োগকারী সংস্থা) এবং পেট্রোবাংলা (বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান) প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে কিন্তু জনগণের বিরোধিতার কারণে এটা কার্যকর হতে দেরি হয়। তারা চুক্তি সম্পাদনের সময় বাড়াতে একমত হয় কিন্তু তারা ক্ষতিপূরণ এবং বাড়তি খরচ সম্পর্কে একমত হতে পারেনি । এছাড়াও ওয়ারেন্টি বন্ড এবং রিটেনশন মানি সম্পর্কেও দ্বন্দ্ব উদয় হয়। সাইপেম তাদের পাওনা আদায়ের জন্য আইসিসিতে মামলা করে কিন্তু যখন পেট্রোবাংলা কোর্টে মামলা করলো তখন সাইপেম মামলায় পরাজিত হয়।
সাইপেম সালিশের জন্য আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি কেন্দ্রের (ICSID) কাছে আবেদন করে। সালিশে দাবির ভিত্তি ছিল বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি ভঙ্গের বিষয়টা। সাইপেমের দাবি ছিল বাংলাদেশী আদালতের অসঙ্গত হস্তক্ষেপ যেটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ও সাইপেম এর পক্ষে আইসিসির দেওয়া রায় বলবৎ করতে বাঁধা প্রদান করে। সাইপেমের এই সকল কাজের ফলে সাইপেম ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সুতরাং সাইপেম এই আবেদনে এ ঘোষণার দাবি উত্থাপন করে যে, বাংলাদেশ সাইপেমকে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ প্রদান ছাড়াই সাইপেমের বিনিয়োগ বাজেয়াপ্তকরন করেছে এবং বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
শেভরন বনাম বাংলাদেশ, ২০১০
২০১০ সালে ICSID ট্রাইবুনাল শেভরন ভার্সেস বাংলাদেশ মামলায় বাংলাদেশের পক্ষে রায় প্রদান করে । রায়ে বলা হয় যে, পেট্রোবাংলা বৈধভাবেই শেভরন থেকে আবর্তিত ব্যয় কর্তন করছে এবং এটা করার অধিকার তাদের রয়েছে, যা শেভরণ অস্বীকার করে।
এইভাবে ICSID বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আমেরিকার একটি শক্তিশালী তেল গ্যাস কোম্পানির ২৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থের দাবিকে নাকচ করে দেয়। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে শেভরন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ICSID এ মামলাটি করে এ দাবি নিয়ে যে, পেট্রোবাংলা অযৌক্তিকভাবে তাদের গ্যাস বিক্রির আয় থেকে ব্যয় কর্তন করছে। তিন বছর এড়িয়ে যাওয়ার পরে, বাংলাদেশে সালিশ ট্রাইব্যুনালের কাছে এ দাবি নিয়ে আসে যে আবর্তিত ব্যয় কর্তন বৈধ এবং ন্যায্য ছিল। পরবর্তীতে ২০১০ সালে ICSID উভয়পক্ষের যুক্তি শ্রবণ করে এবং শেভরনের দাবি নাকচ করে বাংলাদেশের পক্ষে এ রায় প্রদান করে।
উৎপাদন বন্টন চুক্তির অধীনে একটি আমেরিকান কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস খরিদ করার জন্য শেভরনকে প্রদেয় অর্থ থেকে পেট্রোবাংলা শতকরা ৪ টাকা হারে আবর্তিত ব্যয় কর্তন করছিল। জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্যাস কেন্দ্রে গ্যাস স্থানান্তর করার জন্য শেভরন পেট্রোবাংলার পাইপলাইন ব্যবহার করে, এজন্য এই ব্যয় চাপিয়ে দেয়া হয়। পেট্রোবাংলা এ দাবি করেছে যে, আগামী ২০ বছরে শেভরন থেকে আবর্তিত ব্যয় হিসেবে তারা আরো ৩১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করবে। চেভরন এ দ্বন্দ্ব অনেক আগেই মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছে কিন্তু পেট্রোবাংলা কোর্টের সামনে আসতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল।
শেভরন মামলাটি করার পর থেকে পেট্রোবাংলা ২০০৮ সাল পর্যন্ত ICSID এ যায়নি তার বদলে এটা স্থানীয় কোর্টের শরণাপন্ন হয়। শেভরন এই যুক্তি দিয়ে আসছে যে, আবর্তিত ব্যয় শুধুমাত্র তখনই প্রযোজ্য হবে যখন অন্য কোন জায়গায় গ্যাস সাপ্লাই করতে পেট্রোবাংলার পাইপলাইন ব্যবহার করবে। কিন্তু এটা জালালাবাদ, মৌলভীবাজার এবং বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে শুধুমাত্র পেট্রোবাংলাতেই গ্যাস সাপ্লাই দিচ্ছে। পেট্রোবাংলা যুক্তি দেয় যে, এটা শেভরন এর সাথে গ্যাস ক্রয় বিক্রয় চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ৪ পারসেন্ট হারে আবর্তিত ব্যয় কর্তন করছে। উভয় পক্ষের যুক্তি শ্রবণ করে ICSID পেট্রোবাংলার পক্ষে রায় প্রদান করে এবং রায়ে এটা বলে যে, পেট্রোবাংলা সঠিক ভাবে আবর্তিত ব্যয় কর্তন করেছে।
নাইকো এবং বাংলাদেশ সরকার, ২০১৪
২০১৪ সালের এ মামলায় ICSID নাইকোর পক্ষে রায় প্রদান করে এবং পেট্রোবাংলাকে নাইকোর ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে নির্দেশ দেয় এবং ‘দৈব শক্তি’ সম্পর্কে এ মতামত ব্যক্ত করে যে, এটা এমন হতে হবে যা পূর্ব কল্পিত নয় অর্থাৎ যা পূর্বে চিন্তা করা যায় না। উভয়পক্ষকে নিয়ন্ত্রণকারী চুক্তির যে বিধিটির অধীনে দৈবশক্তি এর সুরক্ষা লাভ করা যেত, সেই বিধিটি নিশ্চিত করেছে যে চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে এমন কোন ঘটনা যদি ঘটে যে ঘটনা উভয় পক্ষের কাছে জানা এবং পূর্ব কল্পিত, এমন কোন ঘটনা ঘটলে ‘দৈব শক্তির’ ডিফেন্স তথা সুরক্ষা ব্যবহার করা যাবে না।
এই মামলায় বাংলাদেশের আদালত, ২০০৫ সালে ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে (যেটা টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত) অবহেলার কারণে বিস্ফোরণের ঘটনার ফলশ্রুতিতে সরকারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কানাডিয়ান বিনিয়োগকারী সংস্থা নাইকো লিমিটেডের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করার নির্দেশ প্রদান করে। পেট্রোবাংলার সাথে স্বাক্ষরিত উৎপাদন বন্টন চুক্তির অধীনে কুমিল্লার হাইড্রোকার্বন ব্লক ৯ এ নাইকোর রাখা ৬০ শতাংশ পণ বাজেয়াপ্ত করতে ও নাইকো বা এর কোন শাখায় কোন প্রকার পারিতোষিক প্রদান না করতে কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দেয়। কোর্ট ২০০৩ সালের ১৬ই অক্টোবর বাপেক্স ও নাইকোর মধ্যকর স্বাক্ষরিত তেল ও গ্যাস উৎপাদনে ফেনী ও ছাতক গ্যাস ক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য যৌথ উদ্যোগ চুক্তি অবৈধ ঘোষণা করে। তাছাড়া ২০০৬ সালের ২৭ই ডিসেম্বর পেট্রোবাংলার সাথে নাইকোর স্বাক্ষরিত গ্যাস ক্রয় বিক্রয় চুক্তিও অবৈধ ঘোষণা করে। এই চুক্তিটি নাইকোকে ফেনী গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস ক্রয় বা বিক্রয়ের সুযোগ দেয়। মামলাটি নাইকো দুর্নীতি মামলা নামেও পরিচিত যেটার জন্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তার মন্ত্রী পরিষদকে দায়ী করা হয়। পরবর্তীতে এই মামলাটি ICSID সালিশের নিকট আনয়ন করা হয়।
বিচারাধীন মামলার অধীনে সালিশ চেয়ে গ্রামীণ ফোনের আইনী নোটিশ, ২০২০
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন নিরীক্ষণ পরিচালনার পর নরওয়ে ভিত্তিক টেলিনর কোম্পানির অধীনস্থ গ্রামীণ ফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা দাবি করে যেটা গ্রামীণ ফোন দিতে অস্বীকার করে। এর বদলে ২০১৯ সালের ১৪ই অক্টোবর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বরাবর তারা একটি আইনী নোটিশ পাঠায় যেখানে বলা হয়, যদি এই দ্বন্দ্বটি আগামী ছয় মাসের মধ্য যদি না মিটে যায়, তাহলে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের মধ্যকার করা বিনিয়োগ চুক্তির অধীনে তারা ICSID এ মামলা করবে এটা সমাধানের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বলেছে, দ্বন্দ্বটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এর ফলাফলের জন্য আমাদেরকে কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।
আমি মনে করি, চুক্তির ক্ষেত্রে দৈব শক্তি সম্পর্কিত বিষয়ে যদি বাংলাদেশ সরকার পরিষ্কার ব্যবস্থা নিতে পারেন, তাহলে যেসকল দ্বন্দ্ব বা মামলা ভবিষ্যতে উদয় হতে পারে তা কমিয়ে আনা সম্ভব।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত বক্তব্য একটি আইনী বিশ্লেষন ও শিক্ষামূলক।। ইহা আইনি মতামত/পরামর্শ হিসেবে গ্রহণ না করে প্রয়োজনে শ্রম আইন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হলো)
লেখক: মীর আব্দুল হালিম, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
ইমেইল: bnn.mir@gmail.com