সম্প্রতি এপিএস নিউজকে তার স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনি আতিক—
ফেসবুকের টাইমলাইনে কত স্ট্যাটাস চোখে পড়ে। কোনোটি পড়ি আবার কোনোটি দায়সারা লাইক দিয়ে এড়িয়ে যাই। মাঝেমধ্যে কিছু আইডি থেকে রক্তের জন্য পোস্ট চোখে পড়লে শুধু লাইক কিংবা শেয়ার দিয়েই দায়িত্ব সারি! ‘আহমেদ তৌফিক’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে এ ধরনের পোস্ট বেশি আসত। এক দিন কৌতূহলবশত সেই আইডিতে ঢুকলাম। বেশ কিছুটা সময় দেখলাম। টাইমলাইনে যত পোস্ট আছে তার প্রায় ৭০ শতাংশই রক্তের সন্ধান চেয়ে। ইচ্ছা হলো ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করি। এক সন্ধ্যায় সাদ্দাম হোসেন হলের সামনে বসলাম। ঘণ্টাখানেক আলাপচারিতার ফাঁকেই পাঁচ থেকে ছয়টি কল এলো ওর ফোনে। সব কলই রক্তের জন্য। ফোন ধরেই তৌফিকের কমন প্রশ্ন—‘রক্তের গ্রুপ কী?’, ‘কয় ব্যাগ লাগবে, কোথায়, কবে দিতে হবে?’ ইত্যাদি।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের দূর্গাপুরের ছেলে । বাবার নাম আবু সালেহ পেশা-কৃষি।
দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে শরীরে রক্তের প্রয়োজন হলে দরকার হয় রক্ত সরবরাহের। অনেক সময় রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে রোগী কিংবা স্বজনদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। আর নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত হলে তো কথাই নেই। হন্যে হয়ে খুঁজতে হয় চারিদিকে। ঢাকার বাইরে এ সমস্যা আরো প্রকট। কারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেকেই নিজের রক্তের গ্রুপ জানে না। যাই হোক, কিছু মানুষ এমন দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ান নিঃস্বার্থভাবে। তৌফিক আহমেদ তেমনই একজন যুবক। গাইবান্ধার ছেলে। পিতা মাতার দুই সন্তানেরর মধ্যে তৌফিক বড়। লেখাপড়া করছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে, এল এল এম এ।
রক্ত লাগলে আমাকে কল দেবেন এটি তার স্লোগান।
প্রায় বছর পাঁচেক হলো নিজে রক্ত দিচ্ছেন, নয় তো অন্যেরটা সংগ্রহ করে দিচ্ছেন। কথায় কথায় জানালেন, এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ব্যাগের মতো রক্ত জোগাড় করে দিয়েছেন বিভিন্ন জনকে। বলছিলেন, ‘‘স্কুল-কলেজে পড়ার সময় থেকেই নানা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে সেই শিশু তৌফিক”। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ‘তারুণ্যে’র (রক্ত নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন) খোঁজ পেলাম। এক দিন তাদের কাছে গিয়ে নিজের রক্তের গ্রুপ আর ফোন নম্বর দিয়ে এলাম। বললাম, ‘এ পজিটিভ’ রক্ত লাগলে আমাকে কল দেবেন।’’
প্রথমবার রক্ত দেওয়া
২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর। এক বান্ধবীর জন্মদিন উদযাপন করছিলেন। সে সময় হঠাৎ অপরিচিত এক নম্বর থেকে তৌফিকের মোবাইলে কল আসে। মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে জানানো হলো, কুষ্টিয়া শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর জন্য এক ব্যাগ ‘এ পজেটিভ’ রক্ত লাগবে। জন্মদিনের অনুষ্ঠান রেখে উঠে পড়েন তৌফিক। বললেন, ‘জীবনে প্রথমবারের মতো রক্ত দিলাম। হাসপাতালের কক্ষ থেকে বেরোনোর পর দেখি রোগীর স্বজনরা বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। একজন তো হাত ধরে কেঁদেই ফেললেন। এই ঘটনা আমাকে খুব নাড়া দিল। ভাবলাম, মানুষের বিপদের দিনে রক্ত দিয়ে পাশে থাকা—এর চেয়ে ভালো কাজ আর কী হতে পারে! তখনই ঠিক করলাম রক্ত নিয়ে কাজ করব।’
আমরা রক্ত নিয়ে খেলি…
ক্যাম্পাসে ফিরে তৌফিক মেসেঞ্জারে একটি গ্রুপ খোলেন। নাম ‘আমরা রক্ত নিয়ে খেলি’। তাঁর এই খেলা আসলে নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার। কোনো সংগঠন নয়; বন্ধু, সিনিয়র-জুনিয়রদের নিয়ে অনলাইনেই শুরু হলো পথচলা। প্রায় তিন বছরের এই পথচলায় এরই মধ্যে ব্যবস্থা করে ফেলেছেন প্রায় দুই হাজার ব্যাগেরও বেশি রক্ত। বিনিময়ে যেমন বহু প্রাণ বেঁচে ফিরেছে, তেমনি কখনো কখনো ঝরে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। রক্তের সন্ধান করতে গিয়ে নানা ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন তৌফিক। কখনো কখনো অনাবিল আনন্দ নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন; আবার কখনো কোনো ঘটনা এঁকে দিয়েছে বেদনার ছাপ।
শুরুর দিকে ফেসবুকে রক্ত চাওয়া পোস্ট দেখে সাহায্যের হাত বাড়ানোই ছিল তৌফিকের কাজ। বলেন, “প্রথমে কেউ চিনত না। তাই নিজেই বিভিন্ন গ্রুপে ঢুকে রক্তের পোস্ট দেখতাম, সেগুলো নিজের ওয়ালে শেয়ার করতাম। পরিচিতদের মধ্যে কারো শরীরে গ্রুপের রক্ত থাকলে সাড়া দিত, তখন রোগীদের জানাতাম। বলতে গেলে ‘যেচে পড়ে’ করা আর কী! কিন্তু এখন সারা দেশ থেকে ফোন আসে।”
তখন গভীর রাত চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার
এক রাতে হলে ঘুমাচ্ছিলেন তৌফিক। তখন রাত প্রায় ৩টা। অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “বাবা, ছোট বাচ্চা। কেটে গিয়েছে। কিছুতেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। ‘এ নেগেটিভ’ রক্ত লাগবে। বাবা, কিছু একটা করেন।” সৌভাগ্যবশত তৌফিকের পরিচিত একজনের রক্তের গ্রুপ ‘এ নেগেটিভ’। কিন্তু এত রাতে ডোনারকে কিভাবে কুষ্টিয়া পাঠাবেন? তবু ফোন দিলেন। কিন্তু ডোনার সকালে ছাড়া যেতে পারবে না। এটা শুনে রক্ত চাওয়া ব্যক্তি হু হু করে কাঁদতে থাকলেন। ফোনের ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ শুনে তৌফিকও নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। খারাপ লাগছিল, কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। পরে বুঝিয়ে বললেন, ‘দেখুন, এত রাতে ডোনার পাঠিয়ে কিভাবে রিস্ক নেব? প্লিজ ভোরে আসেন।’ ভোরে উঠে দেখেন, লোকটি একেবারে রুমের সামনে হাজির। বললেন, ‘ভোরেই লোকটির সঙ্গে ডোনারকে পাঠালাম। এদিকে আমি চিন্তায় ছিলাম। পরে শুনলাম বাচ্চাটি বেঁচে গেছে। খবরটি শুনে কী যে খুশি হয়েছিলাম, বলে বোঝানো যাবে না।’ অন্যদিকে মাগুরায় একবার এক সিজারিয়ান মাকে ১২ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন তৌফিক। সেই মা-ও এখন সুস্থ।
কষ্টের স্মৃতিও আছে
কুষ্টিয়ায় এক দিন এক বৃদ্ধা রোগীকে রক্ত দিয়ে আসেন। কয়েক দিন পর খবর পান রোগীটি মারা গেছেন। শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তৌফিক। তাঁর ঝুলিতে হাসি-কান্নার এমন অনেক গল্প জমা হয়েছে। রক্ত দিতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে হূদ্যতা তৈরি হয়েছে তাঁর। অনেকের বাসায় দাওয়াত পেয়েছেন। কিন্তু রক্ত জোগাড় করতে পেরেই তিনি খুশি। কারো বাড়ি পর্যন্ত যাননি কোনো দিন। বললেন, ‘এখনো অনেকে ফোন করে খোঁজখবর নেন। এতেই আমার আনন্দ।’
এখন অনেকে আছেন আমার সাথে……
তৌফিক রক্ত সংস্থানের কাজ করেন মূলত মোবাইলের মাধ্যমে। যখন রক্তের অনুরোধ আসে তখন সেটি ফেসবুকে পোস্ট করেন। পরিচিতদের মেসেঞ্জারে ফরওয়ার্ড করেন। জোগাড় না হলে ক্যাম্পাসে বন্ধুদের ফোন করে রাজি করান। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, গাইবান্ধাসহ প্রায় ১৫টি জেলায় রক্তের সংস্থান করেছেন এই তরুণ। তিন বছরের নিরলস যাত্রায় একটি ‘মানবিক সার্কেল’ই তৈরি হয়ে গেছে তাঁর। রক্তদাতাদের সংগঠন কুষ্টিয়া বাঁধনের শাহিন, রোটার্যাক্ট ক্লাবের সভাপতি তুষার রতন, মেহেরপুরের রাজ আহমেদ, ক্যাম্পাসের রাকিবুলসহ এখন অনেকেই সাহায্য করেন তৌফিককে। ক্যাম্পাসের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘তারুণ্য’ কিংবা ‘রক্তিমা’ও পাশে থাকে। ক্যাম্পাস তো বটেই, পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও সবাই তৌফিককে এখন এক নামে চেনে। শুধু রক্ত জোগাড় করা নয়, বন্যায় ত্রাণ বিতরণ, অসুস্থ বন্ধুর জন্য অর্থ সংগ্রহসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজে তিনি সদা তৎপর। মাস কয়েক আগে আল আমিন নামের এক বন্ধুর চিকিৎসার জন্য কয়েক লাখ টাকা সংগ্রহ করেন তাঁর বন্ধুরা। এখানেও নেতৃত্ব দেন তৌফিক। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব শুভ বলেন, ‘তৌফিক ছাত্র হিসেবে যতটা উদাসীন, মানুষ হিসেবে ততটা মানবিক’। একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আরমিন খাতুন বলেন, ‘মানবিক কাজে তৌফিক সবার আগে। একজন ছাত্র হিসেবে ও যা করে যাচ্ছে, অনেক ম্যাচিউরড মানুষ সেটা করতে পারে না।’
ওয়েবসাইট খোলার ইচ্ছা এবং অতি সম্প্রতি ‘ইমারজেন্সি রেসপন্স ফর হিউম্যানিটি’ সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছি…
তৌফিক জানালেন, “প্রান্তিক এলাকার মানুষের জন্য রক্তের সন্ধান পাওয়া খুব কঠিন। তাই একটি ওয়েবসাইট খুলতে চাই। সেখানে দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের ‘ব্লাড ডোনার’দের তালিকা থাকবে। ফলে মানুষ নিজেই খুঁজে নিতে পারবে তাঁদের প্রয়োজনীয় রক্ত। মাঝেমধ্যে খুব অসহায় রোগীর দেখা পাই, যাদের রক্তের ব্যাগ কেনার টানা থাকে না। এ জন্য কারো পৃষ্ঠপোষকতা পেলে স্থায়ী একটি ফান্ড করা যেত।”
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের গাইবান্ধার এই তরুণকে নিয়ে লিখেছেন আতিকুর রহমান অনি….
এপিএসনিউজ/এএটিআর