মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৫০ বছর পেরিয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর এই সময়ের মধ্যে নানা মত ও পথের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে। কেউ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি কেউবা বিরোধী শক্তি আবার কেউ সামরিক ফরমান নিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। ওই সামরিক সরকারের সময়ে প্রণীত সকল আইন যদিও উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে বাতিল হয়ে গেছে তবু ব্যতিক্রম যে নাই তা বলবো না। সামরিক শাসনামলে অনেক ভাল আইন হয়েছিল যা এখনও টিকে আছে। তবে বেশির ভাগ আইনই বাতিল বলে সর্ব্বোচ্চ আদালত ঘোষণা করেছে। আমার আলোচনা সেটি নয়। কে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসল বা গেল সেটিও মূখ্য নয়। প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো বিদ্যমান সরকার দেশ শাসন করার সময় প্রণীত আইন যেন জনগনের জন্য কল্যানকর ও সময়োপযোগী হয় এবং সাথে সাথে তা প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়াতে পারে।
‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’ নামে বাংলাদেশেও দারুণ কার্যকরী আইন আছে। জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে প্রচার না থাকায় করোনা সংকটে এই আইন মানতে চাই না জনগণ। কারণ জনগনএই আইন বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন। আইন প্রণয়নের সাথে প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু জনগণ আইন না জানায় এই আইন করোনা সংকটে লকডাউন ভেঙে ঘরের বাহিরে যাচ্ছে যা মোটেও কাম্য নয়।
সরকার ক্ষমতায় এসে নিজেদের স্বার্থে হোক আর জনগণের সুবিধার্থে হোক প্রত্যেকেই কিছু কিছু আইন প্রণয়ন করে। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকায় ২০০৯-২০০১৪ এবং ২০১৪-২০১৯ এবং ২০১৯ সাল হতে এ পর্যন্ত যত আইন প্রণীত হয়েছে তার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য আইন নিয়ে মূলত এই লেখা। যেমন ভোক্তা সংরক্ষন অধিকার আইন ২০০৯, তার সাথে মিলিয়ে নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ অসাধারণ দুটি আইন। অত্যন্ত জনবান্ধব ও কল্যানকর দুটি আইন। শিশু আইন ২০১৩, যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ২০১৪, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮, হস্তান্তর যোগ্য ও বিনিময়যোগ্য দলিল আইন ২০২০ (খসড়া) পূর্বে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইন ১৮৮১, নিরাপদ সড়ক আইন ২০১৮ তবে, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ (২০১৩ সালের ৫০ নং আইন)এবং আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন বিগত এক যুগে প্রণীত হয়েছে।
কিন্তু আমাদের দেশের জনগণের উদ্বেগের বিষয় হলো উপরোল্লিখিত আইনের শিরোনাম বাদে সাধারণ মানুষ একবারেই অন্ধকারে থাকে। অর্থ্যৎ আইনগুলোর বিষয়ে ব্যাপক প্রচার ও জনসচেতনতা সৃষ্টি না হওয়ায় বা সরকারি ভাবে আইনের সাধারণ বিষয়গুলো জনগণকে জানানোর কোন উদ্যোগ বা প্রচার না থাকায় জনকল্যানকর ওইসব আইনের সুফল সাধারণ জনগণ পাচ্ছে না। আইন জানা থাকলে মানতে সুবিধা হয়।না জানলে নিজের ও দশের সকলের ক্ষতি হয়।
প্রণীত আইন সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার ও প্রচারণা করতে হবে। মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার ফাদারদের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে এ সকল বিষয়ে আইনের সুফল জনগণের মাঝে বয়ান করতে হবে। স্কুল-কলেজের পাঠ্য বইয়ে ও আলাদা ভাবে (যেমন শিশু কিশোর দের সড়ক ও ট্রাফিক আইনের বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে)বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচার দরকার। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ৩২ ধারা নিয়ে বিস্তারিত প্রচার দরকার রয়েছে। তা নাহলে যুব সমাজ না জেনে অনেক সময় ভার্চুয়াল জগতে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিকৃত পোষ্ট ও বিরুপ মন্তব্য করে তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করছে।
প্রত্যেকটি আইনের জানা ও মানা না মানার ভাল-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সকল সরকার, রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদের দেশ ও সমাজের স্বার্থে একই প্লাটফর্মে থেকে কাজ করতে হবে। তাহলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সহজ ও টেকসই হবে। নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে পুরো জাতিকে সচেতন না করতে পারলে আগামী শতকে সমগ্রজাতি বিরাট স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। শিশু আইন ও অধিকার নিয়ে ম্যাসিভ ক্যাম্পেইন অতীব জরুরী। যে হারে শিশু ধর্ষণ এবং কিশোর গ্যাং বেড়ে গেছে তাতে এখনই জনগনকে সচেতন করতে না পারলে আগামী শিশু-কিশোর প্রজন্ম হুমকি ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠবে।
যারা ফেসবুক ও অন্যান্য জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করছে তাদেরকে সাইবার ক্রাইম আইন ও বহুল আলোচিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাউকে হয়রানি হতে না হয়। আবারও বলছি আইন জানালে আইন মানার হার বেড়ে যাবে এবং আইন প্রয়োগে সুবিধা হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ কমে যাবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন এবং তিনি সারাজীবন অন্যায় ও অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন । বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে শুধু নতুন নতুন প্রণয়ন করেই সরকার ক্ষ্যান্ত হবে না সেগুলো জনসচেতনা বাড়াতে প্রচার চালাবেন এবং নতুন আইনের সুফল জনগণের দৌড়গোড়ায় পৌঁছায দিবেন। আইন বিষয়ক জনসচেতনতা বাড়লে আইন প্রয়োগে ও বিচার প্রশাসনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (Sustainable Development Goal) অর্জন সহজ হবে।
লেখকঃ আইন বিশ্লেষক ও কলামিষ্ট, Email-tajul_jdjbd71@yahoo.com