মাজহারুল ইসলাম
রমজানের সঙ্গে কোরআনের সম্পর্কও সুগভীর। কোরআন নাজিল করা হয়েছে রমজান মাসে। যেমন আল্লাহ এরশাদ করেন— “রমজান মাস এমন যে, তাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে; মানুষের জন্য পথপ্রদর্শকরূপে ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনা ও সত্যাসত্যের পার্থক্য নির্ণয়কারী হিসেবে।” (সুরা বাকারা ১৮৫); কোরআন নাযিল হয়েছে রমজান মাসের ক্বদরের রাতে— “নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে” (আল কদর ১) তাই রমজান মাসে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা সন্নাত। এটা কোরআনের হক্ব। হজরত রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানে হজরত জিবরাইল (আ.)–কে অবতীর্ণ পূর্ণ কোরআন একবার শোনাতেন এবং হজরত জিবরাইল (আ.)ও নবী করিম (সা.)–কে অবতীর্ণ পূর্ণ কোরআন একবার শোনাতেন।
সাহাবায়ে কিরাম প্রায় সারা বছর প্রতি মাসের প্রতি সপ্তাহে পূর্ণ কোরআন শরিফ একবার তিলাওয়াত করতেন। প্রতি সাত দিনে এক খতম পড়তেন বলেই কোরআন মজিদ সাত মঞ্জিলে বিভক্ত হয়েছে। তঁারা রমজান মাসে আরও বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। এতে বোঝা গেল রমজান শুধু কোরআন নাজিলের মাস নয়; বরং রমজান মাস হলো কোরআন শিক্ষণ প্রশিক্ষণ, কোরআন পঠন পাঠন ও কোরআন চর্চার মাস এবং সর্বোপরি রমজান মাস হলো জীবনের সর্বক্ষেত্রে কোরআন অনুশীলন ও বাস্তবায়নের মাস।
এই রমজানে আমাদের জানা উচিত কোরআনে আল্লাহ কোরআনের পরিচয়, মর্যাদা, হক্ব সম্পর্কে কী বলছেন। ১। কোরআনের পরিচয়— ক। এটা আল্লাহ নাযিল করেছেন—“সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি নিজের বান্দার প্রতি এ গ্রন্থ নাযিল করেছেন এবং তাতে কোন বক্রতা রাখেননি।” (সূরা কাহফ ১); আমি সত্যসহ এ কোরআন নাযিল করেছি এবং সত্য সহ এটা নাযিল হয়েছে। আমি তো আপনাকে শুধু সুসংবাদাতা ও ভয়প্রদর্শক করেই প্রেরণ করেছি। (সূরা বনী ইসরাঈল ১০৫); আমি কোরআনকে যতিচিহ্ন সহ পৃথক পৃথকভাবে পাঠের উপযোগী করেছি, যাতে আপনি একে লোকদের কাছে ধীরে ধীরে পাঠ করেন এবং আমি একে যথাযথ ভাবে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা বনী ইসরাঈল ১০৬); যদি এ কোরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও থেকে আসত তবে এর মধ্যে অনেক গরমিল পাওয়া যেত। (সূরা নিসা-৮২।) খ। কোন মানুষ একে তৈরি করেনি—“তারা কি বলে? কোরআন তুমি তৈরী করেছ? তুমি বল, তবে তোমরাও অনুরূপ দশটি সূরা তৈরী করে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে নাও, যদি তোমাদের কথা সত্য হয়ে থাকে। অতঃপর তারা যদি তোমাদের কথা পুরণ করতে অপারগ হয়; তবে জেনে রাখ, এটি আল্লাহর এলম দ্বারা অবতীর্ণ হয়েছে; আরো একীন করে নাও যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই। অতএব, এখন কি তোমরা আত্নসমর্পন করবে? (সূরা হুদ ১৩-১৪); তারা কি বলে?
আপনি কোরআন রচনা করে এনেছেন? আপনি বলে দিন আমি যদি রচনা করে এনে থাকি, তবে সে অপরাধ আমার, আর তোমরা যেসব অপরাধ কর তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। (সূরা হুদ ৩৫) গ। এতে কোন সন্দেহ নেই—“সুতরাং তুমি যদি সে বস্তু সম্পর্কে কোন সন্দেহের সম্মুখীন হয়ে থাক যা তোমার প্রতি আমি নাযিল করেছি, তবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করো যারা তোমার পূর্ব থেকে কিতাব পাঠ করছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তোমার পরওয়ারদেগারের নিকট থেকে তোমার নিকট সত্য বিষয় এসেছে। কাজেই তুমি কস্মিনকালেও সন্দেহকারী হয়ো না।” (সূরা ইউনুস ৯৪); আপনার প্রতিপালকের বাক্য পূর্ণ সত্য ও সুষম। তাঁর বাক্যের কোন পরিবর্তনকারী নেই। তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। (সূরা আল আন-আম ১১৫) ঘ। এতে কোন বক্রতা নেই—“সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি নিজের বান্দার প্রতি এ গ্রন্থ নাযিল করেছেন এবং তাতে কোন বক্রতা রাখেননি।” (সূরা কাহফ ১) ঙ।
সবিস্তারে বর্ণিত কিতাব—“এটি এমন এক কিতাব, যার আয়াত সমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত অতঃপর সবিস্তারে বর্ণিত এক মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ হতে।” (সূরা হুদ ১) চ। ছোট-বড় সব কোরআনে আছে—“বস্তুতঃ যে কোন অবস্থাতেই তুমি থাক এবং কোরআনের যে কোন অংশ থেকেই পাঠ করা কিংবা যে কোন কাজই তোমরা কর অথচ আমি তোমাদের নিকটে উপস্থিত থাকি যখন তোমরা তাতে আত্ননিয়োগ কর। আর তোমার পরওয়ারদেগার থেকে গোপন থাকে না একটি কনাও, না যমীনের এবং না আসমানের। না এর চেয়ে ক্ষুদ্র কোন কিছু আছে, না বড় যা এই প্রকৃষ্ট কিতাবে নেই। (সূরা ইউনুস ৬১) ছ। বোঝার জন্য সহজ—“আর অবশ্যই আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, তাই উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?” (সুরা আল-কামার, ১৭, ২২, ৩২ এবং ৪০) ২। কোরআনে বর্নিত কোরআনের বৈশিষ্ট্য বা গুনাবলি— ক। মানুষের জন্য সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা—“আমি এই কোরআনে মানুষের জন্য সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছি।
আপনি যদি তাদের কাছে কোন নিদর্শন উপস্থিত করেন, তবে কাফেররা অবশ্যই বলবে, তোমরা সবাই মিথ্যাপন্থী।” (সূরা আর-রূম ৫৮) খ। সরল পথ প্রদর্শন করে– “এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্যে মহা পুরস্কার রয়েছে।” (সূরা বনী ইসরাঈল ৯) গ। ভীতি-প্রদর্শনের জন্য—“এটি একটি গ্রন্থ, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে করে আপনি এর মাধ্যমে ভীতি-প্রদর্শন করেন। অতএব, এটি পৌছে দিতে আপনার মনে কোনরূপ সংকীর্ণতা থাকা উচিত নয়। আর এটিই বিশ্বাসীদের জন্যে উপদেশ।” (সূরা আল আ’রাফ ২); এটা মানুষের একটি সংবাদনামা এবং যাতে এতদ্বারা ভীত হয় এবং যাতে জেনে নেয় যে, উপাস্য তিনিই-একক; এবং যাতে বুদ্ধিমানরা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা ইব্রাহীম ৫২) ঘ। হেদায়েতের পথ দেখানোর জন্য—“এটি একটি গ্রন্থ, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি-যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন-পরাক্রান্ত, প্রশংসার যোগ্য পালনকর্তার নির্দেশে তাঁরই পথের দিকে।” (সূরা ইব্রাহীম ১); এমনিভাবে আমি সুস্পষ্ট আয়াত রূপে কোরআন নাযিল করেছি এবং আল্লাহ-ই যাকে ইচ্ছা হেদায়েত করেন। (সূরা হাজ্জ্ব ১৬) ঙ। হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ—“সেদিন প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে আমি একজন বর্ণনাকারী দাঁড় করাব তাদের বিপক্ষে তাদের মধ্য থেকেই এবং তাদের বিষয়ে আপনাকে সাক্ষী স্বরূপ উপস্থাপন করব।
আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ।” (সূরা নাহল ৮৯) চ। সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দান করে – “একে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন যা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ভীষণ বিপদের ভয় প্রদর্শন করে এবং মুমিনদেরকে যারা সৎকর্ম সম্পাদন করে-তাদেরকে সুসংবাদ দান করে যে, তাদের জন্যে উত্তম প্রতিদান রয়েছে।” (সূরা কাহফ ২) ছ। মুমিনদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেন—“বলুন, একে পবিত্র ফেরেশতা পালনকর্তার পক্ষ থেকে নিশ্চিত সত্যসহ নাযিল করেছেন, যাতে মুমিনদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এটা মুসলমানদের জন্যে পথ নির্দেশ ও সু-সংবাদ স্বরূপ।” (সূরা নাহল ১০২) জ। পূর্ববর্তী কালামের সত্যায়ন করে – “আর কোরআন সে জিনিস নয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কেউ তা বানিয়ে নেবে।
অবশ্য এটি পূর্ববর্তী কালামের সত্যায়ন করে এবং সে সমস্ত বিষয়ের বিশ্লেষণ দান করে যা তোমার প্রতি দেয়া হয়েছে, যাতে কোন সন্দেহ নেই-তোমার বিশ্বপালনকর্তার পক্ষ থেকে।” (সূরা ইউনুস ৩৭) ঝ। অন্তরের রোগের নিরাময় করে—“হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশবানী এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য।” (সূরা ইউনুস ৫৭); আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গোনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়। (সূরা বনী ইসরাঈল ৮২) ঞ। সরল পথ প্রদর্শনের পরিষ্কার বর্ণনা —“আমি আপনার প্রতি এ জন্যেই গ্রন্থ নাযিল করেছি, যাতে আপনি সরল পথ প্রদর্শনের জন্যে তাদের কে পরিষ্কার বর্ণনা করে দেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছে এবং ঈমানদারকে ক্ষমা করার জন্যে।” (সূরা নাহল ৬৪) ত। তাদেরই উপদেশ যারা ভয় করে—“আপনাকে ক্লেশ দেবার জন্য আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করিনি।
কিন্তু তাদেরই উপদেশের জন্য যারা ভয় করে। (সূরা ত্বোয়া-হা ২-৩)’ আমি তোমাদের প্রতি একটি কিতাব অবর্তীর্ণ করেছি; এতে তোমাদের জন্যে উপদেশ রয়েছে। তোমরা কি বোঝ না? (সূরা আম্বিয়া ১০); এবং এটা একটা বরকতময় উপদেশ, যা আমি নাযিল করেছি। অতএব তোমরা কি একে অস্বীকার কর?” (সূরা আম্বিয়া ৫০) থ। আল্লাহভীরুদের অন্তরে চিন্তার খোরাক যোগায়—“এমনিভাবে আমি আরবী ভাষায় কোরআন নাযিল করেছি এবং এতে নানাভাবে সতর্কবাণী ব্যক্ত করেছি, যাতে তারা আল্লাহভীরু হয় অথবা তাদের অন্তরে চিন্তার খোরাক যোগায়।” (সূরা ত্বোয়া-হা ১১৩)৩। কোরানের প্রতি আদব— ক। যখন কোরআন পাঠ করা হয় তখন চুপ করে মনোযোগ দিয়ে শন্তে হয়—“আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চুপ থাক যাতে তোমাদের উপর রহমত হয়।” (সূরা আল আ’রাফ ২০৪); “বলুনঃ তোমরা কোরআনকে মান্য কর অথবা অমান্য কর; যারা এর পূর্ব থেকে এলেম প্রাপ্ত হয়েছে, যখন তাদের কাছে এর তেলাওয়াত করা হয়, তখন তারা নতমস্তকে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে।” (সূরা বনী ইসরাঈল ১০৭); যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ার দেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে।
(সূরা আল-আনফাল ২) খ। কোরআনের সম্পুর্ণ বিধান মানতে হয়—”তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ইমান রাখো আর কিছু অংশ অস্বীকার করো? তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কি প্রতিদান হতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।” (সূরা বাকারর ৮৫) গ। কোরআনে বর্ণিত বিষয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে হয়—“তাহলে কি তারা কোরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলো তালাবদ্ধ হয়ে আছে? (সূরা মুহাম্মাদ ২৪);
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, তারা কেন কোরআন নিয়ে গবেষণা করে না? (সূরা নিসা-৮২।) ৪। পরিবর্তন করার কেউ নাই— আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক। (সূরা হিজর ৯); আপনার প্রতি আপনার পালনকর্তার যে, কিতাব প্রত্যাদিষ্ট করা হয়েছে, তা পাঠ করুন। তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নাই। তাঁকে ব্যতীত আপনি কখনই কোন আশ্রয় স্থল পাবেন না। (সূরা কাহফ ২৭) নিশ্চয় আমি এ কোরআনে মানুষকে নানাভাবে বিভিন্ন উপমার দ্বারা আমার বাণী বুঝিয়েছি। মানুষ সব বস্তু থেকে অধিক তর্কপ্রিয়। (সূরা কাহফ ৫৪) ৫। কোরআনের বিষয়ে কাফেররা কী বলতো— যদি আমি কাগজে লিখিত কোন বিষয় তাদের প্রতি নাযিল করতাম, অতঃপর তারা তা সহস্তে স্পর্শ করত, তবুও অবিশ্বাসীরা একথাই বলত যে, এটা প্রকাশ্য জাদু বৈ কিছু নয়। (সূরা আল আন-আম ৭)
লেখকঃ মাজহারুল ইসলাম আইনজীবী এবং কোরআনের গবেষক Mail: mazhakj528@gmail.com