সম্প্রতি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২১’র উদ্বোধন ঘোষণার সময় সবাইকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বই পড়ার অভ্যাস করানোর ওপর তিনি জোর দিয়েছেন।
পড়ার মাধ্যমেই জ্ঞান অর্জন হয়। মহান আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান অর্জনের উপযোগী করেই সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কুরআনের প্রথম নির্দেশ- পড়। দ্বিতীয় নির্দেশও পড়। মুসলিম মাত্রই পড়ানির্ভর জাতি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা আলাক ১)। মোহাম্মদ সাঃ বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের ওপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ’ (ইবনে মাজাহ ২২৪)।
আমার বাবা একটি কবিতা প্রায়ই শুনাতেন –
“জ্ঞাতি নাহি নিতে পারে করিয়া বন্টন
চোর না লইতে পারে করিয়া হরণ।
দান করলে ক্ষয় নাহি হয় কদাচন
এর তরে লোকে বলে বিদ্যা মহাধন।”
— (কবির নাম জানা নাই।)
বারট্রান্ড রাসেলের একটা কথা উল্লেখযোগ্য – “সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়।”
কিন্তু আমরা বিপদকালে অনলাইনে ডুব দেই বা টিভি-সিরিয়াল নিয়ে পড়ে থাকি। এর মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার এবং ক্লান্তি দুর করারা উপায় খুঁজি। সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণার পাশাপাশি সুখ-আনন্দও হয়তো আছে। তবে যারা আগেই বুঝে যায় যে, সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো, তারা সংসার সর্বান্তকরণে এড়িয়ে থাকতেই চায়। পারা যায় কি না, জানি না।
অথচ রাসেলের কথার সূত্র ধরে সৈয়দ মুজতবা আলী নিজেই প্রশ্ন তুলেছিলেন – “কিন্তু প্রশ্ন, এই অসংখ্য ভুবন সৃষ্টি করি কি প্রকারে?” এর উত্তরও নিজেই দিয়েছেন–“বই পড়ে। দেশ ভ্ৰমণ করে। কিন্তু দেশ ভ্ৰমণ করার মত সামৰ্থ্য এবং স্বাস্থ্য সকলের থাকে না, কাজেই শেষ পর্যন্ত বাকি থাকে বই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ এস এম আলী আশরাফ বলেন, “বই চিন্তাভাবনাকে রঙিন করে। বিভিন্ন ধরনের বই আমাদের ভিন্নভাবে ভাবতে শেখায়। নানা রকমের বই সমসাময়িক অনেক কিছু সম্পর্কে ধ্যানধারণা পাল্টে দেয়। একই সঙ্গে নিজের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে সাহায্য করে।”
কিন্তু ডিজিটাল যুগ আর ক্যারিয়ার বা চাকরি কেন্দ্রিক পড়াশোনা আমাদের বই পড়ার অভ্যাস তথা জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহ কেড়ে নিচ্ছে। আমরা ২৪ ঘন্টায় কতবার ফেসবুক-এ ব্যয় করি তার ইয়ত্তা নাই। এছাড়াও, আমরা সব কিছু করি লাভ দেখে – যা করলে লাভ নাই, তা করি না – লাভ বলতে টাকা আয়। সেই লাভ আবার দেরিতে চাই না – নগদে চাই। অথচ জ্ঞানার্জনের বাস্তব মূল্য আমরা বুঝিনা।
বোঝতে কষ্ট হয় সমাজের অবস্থা-চাহিদার কারণে। যখন আপনজনের সাথে ফোনে কথা বলি; বেশিরভাগ কথাই শুনি গ্রামে কে কতা টাকা আয় করে, কে প্রবাস থেকে কত টাকা পাথায়, কারা বাড়িতে ২/৩ তলা বাড়ি করছে – তাদের প্রশংসায় যেমন পঞ্চমুখ হয় তেমনই ভিতর থেকে চাপা আফসোস প্রকাশ পায় যে তার ছেলে মেয়ে তা পারছে না।
বাঙালিদেরকে বইমুখী করতে নিজের মন্তব্যের পাশাপাশি সৈয়দ মুজতবা আলী আরো অনেক গুণী ও জ্ঞানীজনের বই সম্পর্ক ওমর খৈয়ামের উক্তিটি নিজেদের লেখায়ও ব্যবহার করেছেন–
“রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে,
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে,
কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা-যদি তেমন বই হয়।”
বই পড়া অভ্যাস না থাকলে কেনার অভ্যাসও যাও আছে – বিশেষ করে প্রতি বছর বই মেলায় – তাও লোপ পাবে বই কি! সৈয়দ মুজতবা আলী তার ‘বই কেনা‘ প্রবন্ধে বাঙালির বই কেনার প্রতি বৈরাগ্য দেখে মনে হয়, সে যেন গল্পটা জানে, আর মরার ভয়ে বই কেনা, বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে। গল্পটা ছিল এরকম- “এক রাজা তাঁর হেকিমের একখানা বই কিছুতেই বাগাতে না পেরে তাঁকে খুন করেন। বই হস্তগত হলো। রাজা বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে বইখানা পড়ছেন। কিন্তু পাতায় পাতায় এমনি জুড়ে গিয়েছে যে, রাজা বারবার আঙুল দিয়ে মুখ থেকে থুতু নিয়ে জোড়া ছাড়িয়ে পাতা উল্টোচ্ছেন। এদিকে হেকিম আপন মৃত্যুর জন্য তৈরি ছিলেন বলে প্রতিশোধের ব্যবস্থাও করে গিয়েছিলেন। তিনি পাতায় পাতায় কোণের দিকে মাখিয়ে রেখেছিলেন মারাত্মক বিষ। রাজার আঙুল সেই বিষ মেখে নিয়ে যাচ্ছে মুখে। রাজাকে এই প্রতিহিংসার খবরটিও হেকিম রেখে গিয়েছিলেন কেতাবের শেষ পাতায়। সেইটে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজা বিষবাণের ঘায়ে ঢলে পড়লেন।”
বই কেনায় টাকা খরচের ক্ষেত্রে আমরা দেওলিয়া হওয়ার ভয় করি। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা‘ প্রবন্ধে বলেছেন, বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলে হয় নি। বই কেনার বাজেট যদি আপনি তিনগুণও বাড়িয়ে দেন, তবু তো আপনার দেউলে হবার সম্ভাবনা নেই। মাঝখান থেকে আপনি ফ্রাঁসের মাছির মত অনেকগুলি চোখ পেয়ে যাবেন, রাসেলের মত এক গাদা নূতন ভুবন সৃষ্টি করে ফেলবেন।
লেখকঃ মাজহারুল ইসলাম, আইনজীবী।