মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
করোনা সংকটে সবকিছু থমকে গেছে। ধর্ম কর্ম পালনও থমকে গছে। মক্কা-মদীনায় যেখানে ইবাদতে লকডাউন নেমেছে সেখানে আমাদের দেশের কথা বাদই দিলাম। মাহে রমজান মাস শুরু হচ্ছে। এই মাসে কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। সেই সুযোগে রমজানে আবার মুসলিম নামধারী ব্যবসায়ীগণ এবং দোকানদাররা জিনিষপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়।
যদিও মুসলমানগণ রমজান মাস এলে সারা বছরের পাপ মোচন করবে বলে কোমর বেঁধে নামে। রমজানের প্রথমভাগে মসজিদে জায়গা পাওয়াতো বেশ কষ্টসাধ্য । কিন্তু সেই মসজিদে গিয়ে এবার গিয়ে নামাজ ও তারাবি পড়া কতটুকু বাস্তবসম্মত হবে তা বিবেকবান মুসলমানদের উপর ছেড়ে দিলাম। আমি কিন্তু মসজিদে যাওয়ার বিপক্ষে নই। আমিও মসজিদে না যেতে পেরে ব্যাথাতুর ও শোকগ্রস্থ। তবে এবার চিন্তাটা একটু বেশি।
করোনায় অর্ধেকের বেশি জেলা লকডাউনে। গনপরিবহণ ঠিকমত চলছে না। বাজার পর্যন্ত উৎপাদিত কৃষি ও ভোগ্যপণ্য পৌঁছানো সম্ভবপর হচ্ছে না। সেই অজুহাতে ও করোনা সংকটের কারণ দেখিয়ে রমজানে বেশি পরিমাণে ব্যবহার হয় এমন নিত্যপণ্যের দাম ব্যবসায়ীরা বাড়াতে পারে। তবে এই বাজার নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান কি কি আইন আমাদের দেশে আছে এবং কিভাবে প্রয়োগ করলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেটা বলার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশে যেকোনো গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। গুজবে আবার একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী গুজব–সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। যেমন লবনের ক্ষেত্রে সম্প্রতি আমরা তা দেখেছি। পেঁয়াজের ঝাঁজের কথা তো আমরা সবাই জানি। এখন শুরু হয়েছে করোনাভাইরাস ও রমজান মাস এলে বরাবরের ন্যায় এবার নিত্য পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই মূল্যবৃদ্ধি ও মজুদদারি ঠেকাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এবং বিদ্যমান আইন ভোক্তা সংরক্ষণ আইন ও স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট কী বলে, তা জেনে নেওয়া যাক।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ বলা হয়েছে, ‘ভেজাল’ অর্থ পিউর ফুড অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৯–এর ধারা ৩(১) এ সংজ্ঞায়িত Adulteration এবং স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট, ১৯৭৪–এর ধারা ২৫সি বা অন্য কোনো আইনে উল্লিখিত Adulteration বা ভেজাল।
‘ভোক্তা’ বলতে সাধারণ অর্থে আমরা যেকোনো পণ্যের ক্রেতা বা গ্রহীতাকে বুঝি। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯–এ ভোক্তাকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের যেসব কাজ ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ হিসেবে গণ্য হবে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ সেসব কাজের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
আইনটিতে বলা হয়েছে, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্য অর্থ—
ক. কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা।
খ. জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা।
গ. মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক কোনো দ্রব্য, কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, উক্ত রূপ দ্রব্যমিশ্রিত কোনো পণ্য বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা।
ঘ. কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রির উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপনে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা।
ঙ. প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা।
চ. কোনো পণ্য সরবরাহ বা বিক্রির সময় ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত ওজন অপেক্ষা কম ওজনের পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা।
ছ. কোনো বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ওজন পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্র প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শনকারী হওয়া।
জ. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত পরিমাপ অপেক্ষা কম পরিমাপের পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা।
ঝ. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দৈর্ঘ্য পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছু প্রকৃত দৈর্ঘ্য অপেক্ষা অধিক দৈর্ঘ্য প্রদর্শনকারী হওয়া।
ঞ. কোনো নকল পণ্য বা ওষুধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা।
ট. মেয়াদোত্তীর্ণ বা ওষুধ বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা।
ঠ. সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে এমন কোনো কার্য করা, যা কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ যে কার্যকলাপকে অপরাধ বলা হয়েছে তা হলো—
ক. আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও পণ্যে মোড়ক ব্যবহার না করা।
খ. মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করা।
গ. সেবার মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা; ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা।
ঘ. ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা।
ঙ. খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশ্রণ করা।
চ. মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা।
ছ. প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা।
জ. ওজনে কারচুপি করা।
ঝ. বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শন করা।
ঞ. পরিমাপে কারচুপি করা।
ট. দৈর্ঘ্য পরিমাপক কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা।
ঠ. পণ্যের নব প্রস্তুত বা উৎপাদন করা।
ড. মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা।
ঢ. সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করা এবং
ণ. অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দিয়ে সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ঘটানো।
মামলা ও বিচার হবে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮ অনুযায়ী, আইনে যা-ই থাকুক না কেন, সরকার বা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি, নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক এ আইনের অধীনে লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইনের অধীন কোনো অপরাধ বিচারার্থে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত আমলে নিতে পারবেন।
ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে—জরিমানা ও শাস্তির বিধান আরও সুনির্দিষ্ট যেমন জীবননাশক বা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক বা ভারী ধাতু বা বিষাক্ত দ্রব্যমিশ্রিত কোনো খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, আমদানি, প্রস্তুত, মজুত, বিতরণ, বিক্রয় বা বিক্রয়ের অপচেষ্টা করলে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। পুনরায় একই অপরাধ করলে সাত বছর থেকে অনূর্ধ্ব ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন ১০ লাখ টাকা জরিমানা।
এ ছাড়া দূষণমিশ্রিত কোনো খাবার বিক্রি করলে; শর্ত ভঙ্গ করে কোনো খাদ্যদ্রব্য মজুত বা প্রস্তুত করলে; অনুমোদিত ট্রেডমার্ক বা ট্রেডনামে বাজারজাত করা কোনো খাদ্যপণ্য নকল করে বিক্রির চেষ্টা করলে; খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন বা সংরক্ষণের স্থানে শিল্পকারখানার তেল বা খনিজ বা বর্জ্য থাকার অনুমোদন দেওয়াসহ এমন ২০ ধরনের অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব সাত বছর থেকে কমপক্ষে দুই বছর শাস্তি এবং অনধিক ১০ লাখ টাকা অথবা কমপক্ষে তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। একই অপরাধ পুনরায় করলে শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ আরও বাড়ানোর বিধান রাখা হয়েছে।
নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯—দুটি মিলিয়ে পড়লে ওই আইনে যেসব কাজ করার বিষয়ে বিধিনিষেধ অথবা যেসব কাজ অপরাধ গণ্য করা হয়েছে, তা সব নাগরিককে জানতে হবে। কেননা ওই বিধিনিষেধ ব্যত্যয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা অধিদপ্তরকে ভেজাল পণ্য বাজেয়াপ্ত ও আটকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর ২৫ এবং ২৭ ও ২৮ ধারার বিধান প্রয়োগ করেও অবৈধ মজুতদার ও মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। অন্যায় ও অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে মূলত বিশেষ ক্ষমতা আইনটি করা হয়েছিল। একটু প্রয়োগ করলেই হয় অথচ এ আইনটি বেশির ভাগ ব্যবহার হয় ইন্ডিয়া হতে কে চকলেট আনল, কে রেলের টিকিট বিক্রি করল, কালোবাজারিতে তার বিরুদ্ধে যেটি এই আইনের মুখ্য বিষয় নয়।
করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী দানবে রুপলাভ করেছে। রমজান মাসও আগত। লকডাউনে এমনিতে মানুষ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন। কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন। চারিদিকে লকডাউন, হোম কোয়ারেন্টাইন বা বন্দিদশা অবস্থা। মানুষের কাজ করার স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি থমকে গেছে। কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন।
গরিব, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মানসিক ও আর্থিক টানাপোড়েন, চিকিৎসা সংকট, তীব্র খাদ্য সংকট নানাবিধ সমস্যা বিরাজমান। এর মধ্যে গরিবের ত্রাণ আত্নসাৎ ও চাল চুরি কোনভাবেই থামছে না। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য কৃষক পাচ্ছে না। কৃষি অর্থনীতি বিপর্যস্ত। চারিদিকে হাহাকার কিভাবে উত্তরণ ঘটবে মানুষের। কোন গবেষণাই কাজে লাগছে না। সামনে রমজান মাস আগত । এই মাসে মানুষ ইবাদত বেশি বেশি করে সে সুযোগও নাই। মসজিদ এ যাতায়াত করোনায় সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।
জিনিষপত্রের দাম যেভাবে বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে সবাই আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। করোনায় সামান্য মাস্ক, টিস্যু, হ্যান্ডওয়াশ ও ন্যাপকিনের দাম বেড়ে যায়, তাহলে সেটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে। রমজানে মূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে তাই ভেজাল পণ্য ও মূল্যবৃদ্ধি কার্যক্রমের সঙ্গে সুযোগসন্ধানী জড়িত ব্যক্তিদের আটক এবং মোবাইল কোর্ট অথবা উপযুক্ত আদালতে বিচারকার্য সম্পন্নের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।
নিরাপদ খাদ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। কবির ভাষায় পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। জনগণ সচেতন হলে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত আরও দৃঢ় ও মজবুত হবে। হাজার বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নাই নিশ্চিত জেনে নৈতিকতা ও নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে হবে। ব্যবসায়ীদেরকে পণ্যের মূল্য সহনশীল রেখে রমজান এর পবিত্রতা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। না হলে করোনা কিন্তু কাউকে করুনা করবে না।
লেখক: আইন বিশ্লেষক ও কলামিস্ট, ইমেইলঃ bdjdj1984du@gmail.com