তৃতীয় পরীক্ষকের নিয়ম চালুর পর লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে দ্বিগুণ সময় লাগার কারণে তা থেকে সরে আসার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। কিন্তু বিষয়টি রাষ্ট্রপতির পরামর্শে চালু করায় এ পদ্ধতি থেকে সরে আসতে হলে তার মতামত নেওয়াটা জরুরি বলে মনে করছেন কমিশন সদস্যরা।
পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘থার্ড এক্সামিনারের কারণে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশে সময়টা একটু বেশিই লাগছে। আমরা পুরো প্রক্রিয়ার অর্থাৎ বিসিএসের সময় কমিয়ে আনতে চাই। সেটা করতে হলে লিখিত পরীক্ষার ফলপ্রকাশের সময়ও কমিয়ে আনতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও কথা বলব।’
তৃতীয় পরীক্ষক পদ্ধতি চালু হয় ২০১৭ সালে। পরীক্ষার্থীদের মেধা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে ৩৮তম বিসিএসে এটি প্রথম প্রয়োগ করা হয়। এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা হয় ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে। ১০ মাস পর ২০২০ সালের ৩০ জুন লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। ৩৯তম বিসিএস হচ্ছে বিশেষ বিসিএস। প্রিলিমিনারি ও ভাইভার ওপর ভিত্তি করে বিশেষ বিসিএসে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর আসে ৪০তম বিসিএস। গত ২৭ জানুয়ারি ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি। এই ফল প্রকাশ করতে পিএসসি সময় নিয়েছে ১২ মাস। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা হয়। এরই মধ্যে ৪১তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামী ১৯ মার্চ এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হবে। ৪২তম বিশেষ বিসিএসের প্রিলিমিনারি হবে ২৬ ফেব্রুয়ারি। ৪৩তম বিসিএসের আবেদন চলছে। আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই বিসিএসর আবেদন চলবে। এরপর আগামী আগস্টে এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হতে পারে। তৃতীয় পরীক্ষক প্রথা চালু থাকলে এসব বিসিএস শেষ হতেও সাড়ে তিন বছর থেকে চার বছর লাগবে।
তৃতীয় পরীক্ষক পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশে এত দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হতো না। ৩৭তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় মাত্র পাঁচ মাসে। তার আগের বিসিএসগুলোর ক্ষেত্রে পিএসসি আরও কম সময়ে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে।
একজন পরীক্ষক খাতা মূল্যায়ন করার পর তা নিরীক্ষকের কাছে যায়। নিরীক্ষক মূলত খাতার নম্বরের যোগফল যাচাই করেন। প্রথম পরীক্ষকের খাতা মূল্যায়ন সঠিক হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য দ্বিতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হয়। পুনরায় পরীক্ষা করার সময় পরীক্ষক দেখেন, যেখানে যেমন নম্বর দেওয়ার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়েছে কি না। এরপর খাতা আবার দ্বিতীয় নিরীক্ষকের কাছে যায়। দুই পরীক্ষকের নম্বরের পার্থক্য ২০ শতাংশের বেশি হলে খাতা পাঠানো হয় তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে। এই প্রক্রিয়া শেষ হলে তবেই লিখিত পরীক্ষার ফলাফল চূড়ান্ত করে পিএসসি।
৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন ২০ হাজার ২৭৭ জন। তাদের প্রায় ১ লাখ খাতা মূল্যায়ন করতে হয়েছে পরীক্ষকদের। এসব খাতার মধ্যে ৮ হাজার ৫৮৩টি তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায়।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘আগে একজন পরীক্ষকই খাতা দেখতেন। তার দেওয়া নম্বরই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতো। সব পরীক্ষক একরকম মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখেন না। তাদের বিবেচনার মানদ-ও সমান হওয়ার কথা নয়। তাই পিএসসি হয়তোবা লিখিত পরীক্ষায় আরও স্বচ্ছতার জন্য দ্বৈত পরীক্ষক ব্যবস্থা চালু করেছে। তাদের বিবেচনাবোধ নজিরবিহীন এবং বিলম্বিত বিসিএস পরীক্ষাকে আরও বিলম্বিত করছে। এমনিতেই এখানে স্বাধীনতার কিছুদিন পর থেকেই জট লেগেছিল। ক্ষেত্রবিশেষে বিসিএস শেষ করতে চার বছরও লেগেছে। তবে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সেটা প্রায় সোয়া দুই বছরে নেমে এসেছিল। সিভিল সার্ভিস বাছাই শেষে এক বছরের মধ্যেই চাকরিতে যোগ দেওয়া জন্য। উপমহাদেশের এই ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। কিছুটা কাছাকাছি হতে গিয়েও আবার বিপরীতমুখী হয়ে পড়েছি।’
তিনি আরও বলেন, পিএসসির সুপারিশ পাওয়ার পরও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নেয় আরও সময়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে বিসিএস পরীক্ষার্থীর বয়স ৩০ বছরের কাছাকাছি, তিনি মনোনীত হলে নিয়োগ পাবেন ২০২৩ সালের সূচনায় অর্থাৎ ৩৪ বছর বয়সে। কাজ করবেন ২৫ বছর। এভাবে সময়ের অপচয় আমরা জাতীয় জীবনে বিভিন্নভাবে ঘটাচ্ছি। কাজেই দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরীক্ষক ব্যবস্থা বাস্তবসম্মত নয়। পিএসসি মূল্যায়নকে অধিকতর স্বচ্ছ করতে গিয়ে যে অতিরিক্ত সময় নিচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অধিকতর নিখুঁতভাবে করতে গিয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করা ঠিক হয়নি। তাই আগের সব বিসিএসের ধারাবাহিকতায় এবং উপমহাদেশের সাধারণ ঐতিহ্য অনুসরণে দুই বা তিন পরীক্ষক ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টি পিএসসির বিশেষভাবে বিবেচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি।’
পিএসসির একজন পরীক্ষক যিনি বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের জন্য একজন পরীক্ষকের তত্ত্বাবধানে খাতা মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। তখনো খাতা দেখতেন একজন পরীক্ষক। ভারত ও পাকিস্তানে এখনো এ ব্যবস্থাই চালু রয়েছে। বাংলাদেশেও ছিল। কিন্তু ৩৮তম বিসিএস থেকে বদলে যায় নিয়ম। ফলে অতিরিক্ত সময় লাগছে। দ্বিতীয় পরীক্ষকের ব্যবস্থা আছে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অনেক কলেজেও অনার্স ও মাস্টার্স চালু রয়েছে। এসব পরীক্ষায় পরীক্ষক থাকেন একজনই। এখানে দ্বিতীয় পরীক্ষকের ধারণাই চালু করা হয়নি। দ্বিতীয় পরীক্ষক না হলে সব ভ-ুল হয়ে যায়, এমনটা তো নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যত ছাত্রছাত্রী অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি পান, তার চেয়ে বেশি ডিগ্রি পান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষকদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই থাকেন। বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সীমিত। এখানে পরীক্ষকের জবাবদিহি থাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। সময়মতো খাতা না দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিশ^বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় পরীক্ষক হন সাধারণত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের কোনো শিক্ষক। তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তাই বিশ^বিদ্যালয়ে অল্প সময়ে ফল প্রকাশের বিষয়টি দুরূহ হয়ে ওঠে না। এই ক্ষেত্রে পিএসসির নিজস্ব কোনো পরীক্ষক নেই। তারা ধার করা পরীক্ষক দিয়ে খাতা দেখান। মূলত বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তা, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই তাদের পরীক্ষক বা ভরসা। পদ্ধতিগত কারণেই তাদের সংখ্যা সীমিত। ধার করা পরীক্ষক দিয়ে খাতা দেখালে এ ধরনের বিলম্ব হওয়াই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরীক্ষকের কারণে এখন প্রয়োজন পড়েছে তিনগুণ শিক্ষকের। তাছাড়া যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে পরীক্ষকের মান বাড়ানো যেতে পারে। একটা ২০০ নম্বরের খাতা দেখার জন্য পরীক্ষক ২৫০ টাকা পান। আর ১০০ নম্বরের খাতা দেখে পান ২০০ টাকা। এই পারিশ্রমিক আরও বাড়ানো উচিত।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, পিএসসি সাধারণত কয়েক লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করে এক থেকে দুই হাজার প্রার্থীকে চাকরিতে নিয়োগের সুপারিশ করে। তাদের মেধা যাচাই প্রক্রিয়াগত কারণেই হয়ে যায়। বিসিএসে প্রার্থীর সংখ্যা থাকে অনেক। প্রিলিমিনারি বাছাইপর্বটি অনেকটাই কঠোর। দিনরাত দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে অনেকে প্রিলিমিনারিতেই বাদ পড়ে যান। আর লিখিত ও মৌখিকে তো পড়েনই। কাজেই এসব ডিঙ্গিয়ে যারা চাকরি পান তাদের আলাদাভাবে দেখতেই হবে। তবে বিশ^বিদ্যালয়ের কিছু মেধাবী তরুণ থাকেন তারা বিসিএসে আসতে চান না। সেটা বাদ দিলে বিসিএসে মেধাবীরাই আসেন। এখন সময় এসেছে মেধাবী তরুণদের সময় বাঁচানোর। তাদের সময়কে কাজে লাগাতে হবে।
পিএসসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পিএসসির ক্ষমতা মৌখিক পরীক্ষার পর ফল ঘোষণা করে সরকারের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করা পর্যন্ত। সাম্প্রতিক কালে সাংবিধানিক এই সংস্থা প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো একরূপ নিয়মিত ব্যাধি ঠেকাতে পেরেছে। এ সাফল্য কম নয়। তবে বাছাইপর্বের সময়সীমা যত কমবে, তত উপকৃত হবে পরীক্ষার্থী থেকে শুরু করে সরকার পর্যন্ত। যারা বাদ পড়ে যাবেন, তারা চেষ্টা চালাতে পারবেন অন্য কোনো কর্মসংস্থানের। বাছাইপর্বের বিলম্বে অনেকের সরকারি চাকরির বয়সসীমা চলে যায়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে প্রতিবছরই একটি বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হচ্ছে। সরকারের কাছে নিয়মিতই যাচ্ছে নিয়োগের সুপারিশ। তবে সে পরীক্ষাটি কখনকার, তা দেখলে হতাশ হতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘পদ্ধতিগত কারণেও লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশে অনেক সময় লাগছে। এক লাখ খাতার মধ্যে ৮ হাজার খাতা খুঁজে বের করা খুবই জটিল একটি কাজ। কারণ খাতার ওপর কোনো প্রার্থীর নাম ঠিকানা লেখা থাকে না। ডাবল লিথুকোড যুক্ত ওএমআর সিট স্ক্যান করে এসব খাতা খুঁজে বের করতে হয়। লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে তৃতীয় পরীক্ষকের বিধান সম্পর্কে মতামত দেওয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী মাসে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে পুরো বিষয়টি নিষ্পত্তি করবে পিএসসি।’