ভাবুন তো, পৃথিবীতে একদিনের জন্য কোনো আলো থাকবে না! চারদিকে ঘোর অন্ধকার, কীভাবে দিন পার করবেন? অনেকে নিশ্চয়ই চিন্তা করে এখনও কোনো উত্তর পাননি। আবার অনেকে ভাবতেও পারেন, একদিন তো কেটেই যাবে! কিন্তু যে মানুষটি ৫৮ বছর ধরে অন্ধ হিসেবে জীবন-যাপন করছেন; দৃষ্টিহীন হয়েও এইচএসসি পরীক্ষায় বোর্ডে হয়েছেন ১৯তম, পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আইনপেশায় পার করেছেন প্রায় চার যুগ; সেই মানুষটিকে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে একটি ‘স্যালুট’ দেবেন। স্যালুটযোগ্য মানুষটি হলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মোশাররফ হোসেন মজুমদার।
চার বছর বয়সেই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে হারিয়েছিলেন দৃষ্টিশক্তি। কিন্তু দমে যাননি; চোখের সামনের অন্ধকার দূরে ঠেলে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার অদম্য ইচ্ছায় এগিয়ে গেছেন মোশাররফ হোসেন মজুমদার। বাবার অনুপ্রেরণায় ব্রেইল পদ্ধতিতে (কাগজের ওপর বিন্দুকে ফুটিয়ে তুলে লেখার পদ্ধতি, এসব বিন্দুতে আঙুল বুলিয়ে দৃষ্টিহীনরা পড়েন) শুরু করেন পড়ালেখা।
ডাক্তার বললেন, আমার দৃষ্টিশক্তি আর ফিরে আসবে না। চোখ টোটালি নষ্ট হয়ে গেছে। এটা শুনে আমার বাবা হতভম্ব হয়ে গেলেন। ওনার চেহারা দেখে ডাক্তার বললেন, আপনি ভাবছেন কেন? আপনার ছেলে চোখ থাকলেও যেমন পারত না থাকলেও সে সব ধরনের কাজ করতে পারবে। সে ব্যবস্থা আমার কাছে আছে।
দৃষ্টিহীন মোশাররফ পড়াশোনায় কতটা মেধাবী ছিলেন— এর প্রথম স্বাক্ষর রাখেন ১৯৭৭ সালে। ওই বছর উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় যশোর শিক্ষা বোর্ডে মানবিক বিভাগ থেকে ১৯তম স্ট্যান্ড করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। তিনি ছিলেন ঢাবির আইন বিভাগের দৃষ্টিশক্তিহীন প্রথম শিক্ষার্থী। আইন পড়া শেষে ১৯৮৩ সালে ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন মোশাররফ। এরপরই শুরু হয় আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন। ১৯৮৫ সালে অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ১৯৮৯ সালে হাইকোর্টে আইনপেশা পরিচালনার অনুমতি পান। ২০০২ সাল থেকে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন দৃষ্টিহীন মোশাররফ। শিশু বয়সে চোখের আলো নিভে গেলেও ‘মনের আলো’ জ্বালিয়ে চার দশক ধরে আইনপেশায় দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, দীর্ঘ সময় ধরে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে শিক্ষকতাও করছেন। প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছেন, গড়ে তুলেছেন সংগঠন।
মোশাররফ হোসেন মজুমদারের জন্ম ১৯৫৮ সালের ৬ জুন ফেনী জেলায়।
ইতিহাসের সাক্ষী মোশাররফ হোসেন মজুমদার মানুষের ভালবাসা যেমন পেয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে অবহেলার শিকারও হয়েছেন। দৃষ্টিহীন এ আইনজীবী জীবনের নানা স্মৃতি তুলে ধরেছেন ঢাকা পোস্ট-এর কাছে। জীবন, আলো, উত্থান এবং বাঁক পরিবর্তনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিমের সঙ্গে।
দৃষ্টি হারানোর সেই দুঃসহ স্মৃতি…
আমার বাবা প্রিন্টিং প্রেসের (মুদ্রণ) ব্যবসা করতেন। মা ছিলেন গৃহিণী। ভাইদের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। আমার বয়স যখন চার, তখন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারাই। ওই সময় এই রোগের চিকিৎসা খুব কম ছিল। আমার যখন দৃষ্টিশক্তি হারানোর পথে তখন ঢাকায় সবচেয়ে বড় চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি আহমেদের কাছে নেওয়া হয়। তিনি আমার চোখ পরীক্ষা করে বাবাকে বললেন, আমার দৃষ্টিশক্তি আর ফিরে আসবে না। চোখ টোটালি নষ্ট হয়ে গেছে। এটা শুনে আমার বাবা হতভম্ব হয়ে যান। ওনার চেহারা দেখে ডাক্তার বললেন, আপনি ভাবছেন কেন? আপনার ছেলে চোখ থাকলেও যেমন পারত, না থাকলেও সে সব ধরনের কাজ করতে পারবে। সে ব্যবস্থা আমার কাছে আছে। তার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে দেন। আমি সব ব্যবস্থা করব। আমার বাবা ডাক্তারের কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, এটা কীভাবে সম্ভব? সে তো দেখে না। ডাক্তার বললেন, যারা দেখে না তাদের জন্যও লেখাপড়ার ব্যবস্থা আছে। উনিই প্রথম এ ধরনের স্কুল চালু করেছিলেন। অন্ধদের জন্য গড়ে তোলা তার স্কুলের নাম ছিল- ইসলামিয়া ব্লাইন্ড (অন্ধ) স্কুল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে এর আগে কোনো অন্ধ ব্যক্তি অনার্স বা মাস্টার্সে ভর্তি হননি। আমি জানতাম, যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যা-ই তাহলে একটা বাধা আসবে। সবাই প্রশ্ন করবে সে কীভাবে পড়বে
আমার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি (চক্ষু চিকিৎসক) স্কুলটা ঘুরে দেখালেন। আমার বাবা ডাক্তারকে বললেন, আমি আপনার কথায় প্লিজড (খুশি)। আপনি আমার ছেলেকে পড়ান। আমি বাসা থেকে প্রস্তুত হয়ে এসে আমার ছেলেকে আপনার স্কুলে দিয়ে যাব। কিছুদিন পর বাবা স্কুলে ভর্তি করালেন। এভাবে আমার লেখাপড়া শুরু।
প্রথমে ইসলামিয়া ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি হই। অবশ্য আমি সেই স্কুলে বেশিদিন থাকিনি। তেজগাঁওয়ে আরেকটা স্কুল ছিল; সেখানে ভর্তি করানো হয়। ওইখানে লেখাপড়া চলাকালে সরকার স্কুলগুলোকে জাতীয়করণ করে। তখন সারাদেশে পাঁচটি সরকারি স্পেশাল স্কুল (বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্নদের পড়ানোর স্কুল) চলত। ব্রেইল পদ্ধতিতে হাত দিয়ে ধরে ধরে পড়ানো হতো। একপর্যায়ে ট্রান্সফার (স্থানান্তর) হয়ে বরিশালে চলে গেলাম। বরিশালের সাগরদীতে একটা স্কুল ছিল, সেখান থেকে মাধ্যমিক তথা এসএসসি পাস করি। এরপর বরিশাল বিএম কলেজে একাদশে ভর্তি হলাম। এইচএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস পেলাম। বরিশালে আমার যে কেন্দ্র ছিল ওই কেন্দ্রে আমি ছিলাম ফার্স্ট। তখন যশোর বোর্ডের আন্ডারে ছিল এটা। ১৯৭৭ সালে যশোর বোর্ডে মানবিক বিভাগে আমি ১৯তম স্ট্যান্ড করলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো…
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে এর আগে কোনো অন্ধ ব্যক্তি অনার্স বা মাস্টার্সে ভর্তি হননি। আমি জানতাম, যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যা-ই তাহলে একটা বাধা আসবে। সবাই প্রশ্ন করবে সে কীভাবে পড়বে? তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমেই আমি ল’ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করব। তখন ল’ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর হামিদুল হক খান। ওনার বাসায় গেলাম। সাক্ষাৎ করে বললাম, স্যার আমার এই যোগ্যতা। আমি এসএসসি, এইচএসসি পাস করেছি। ব্রেইল পদ্ধতি তাকে দেখালাম। এভাবে লিখে আর পড়ে আমি পাস করেছি, এখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার ডিপার্টমেন্টে পড়তে চাই। যথানিয়মে ভর্তি পরীক্ষাও দেব। আমি ভর্তি পরীক্ষায় যদি পাস করি, তাহলে এই দৃষ্টিহীনতার কারণে যেন বঞ্চিত না হই। আমি আপনার কাছে এই সহযোগিতা চাচ্ছি। আমি পরীক্ষা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেব। স্যার আপনার সহযোগিতা চাচ্ছি। উনি বললেন, কোনো অসুবিধা নেই। পরীক্ষা দাও। ভর্তি হও যতটুকু সাহায্য-সহযোগিতা দরকার তা আমরা করব।
অনার্স ফাস্ট ইয়ার (প্রথম বর্ষ) পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষায় দেখা গেল, আমরা পাঁচ জন ফার্স্ট ক্লাস (প্রথম শ্রেণির) নম্বর পেয়েছি। আমার বন্ধুরা এসে বলল, বন্ধু তুমি ফাস্ট ক্লাস পাইছ। কিন্তু পরে ওই নম্বর ধরে রাখতে পারিনি
আশ্বাস পাওয়ার পর শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে পরীক্ষা দিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’ এবং ফেলোশিপে চান্স (সুযোগ) পেলাম। ভর্তি হলাম ল’ ডিপার্টমেন্টে। শুরু হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা। অনার্স ফাস্ট ইয়ার (প্রথম বর্ষ) পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষায় দেখা গেল, আমরা পাঁচ জন ফার্স্ট ক্লাস (প্রথম শ্রেণির) নম্বর পেয়েছি। আমার বন্ধুরা এসে বলল, বন্ধু তুমি ফাস্ট ক্লাস পাইছ। কিন্তু পরে ওই নম্বর ধরে রাখতে পারিনি। অনার্সে শেষপর্যন্ত সেকেন্ড ক্লাস সিক্সথ (দ্বিতীয় শ্রেণি, ষষ্ঠ) হয়েছিলাম। তারপর মাস্টার্স পরীক্ষা দিলাম। সেখানেও আমি সেকেন্ড ক্লাস ফোর্থ (চতুর্থ) হয়েছিলাম।
কেন আইনপেশায়…
আসলে আইনপেশাটা আমার কাছে ছোটবেলা থেকেই স্বাধীনপেশা বলে মনে হয়েছে। প্রথমে আমার ইংরেজি সাহিত্য পড়ার ইচ্ছা ছিল। ইচ্ছাটা অনেকদিনই ছিল। হঠাৎ এসএসসি পড়ার সময় কোনো আইনজীবীর কৃতিত্বপূর্ণ কাজ দেখে আইন পড়তে আগ্রহী হই। আইন পড়ে দুদিকেই যাওয়া যায়। যেমন- চাকরি করতে কোনো বাধা নেই। আবার প্র্যাকটিস (চর্চা) তো করাই যায়। পথটা ওপেন (খোলা) থাকে। এজন্য আমি ল’ পড়লাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা…
ইসলামী ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) শামীম মোহাম্মদ আফজাল, বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লা, বিচারপতি ফাতেমা নজীব— এরা আমার সহপাঠী ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের মধ্যে দীল মোহাম্মদ রানা, এস এম শাহজাহান ছিলেন। অন্যদের আপনি হয় তো চিনবেন না।
আছে জজ না হতে পারার আক্ষেপ…
১৯৮২ সালে এরশাদ (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) ক্ষমতায় এসে ৪৫০ জন জজ নিয়োগ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিল, আমাদের ব্যাচের। আমিও ইন্টারভিউ (সাক্ষাৎকার) দিয়েছিলাম। আমি যখন ইন্টারভিউ বোর্ডে গেলাম আমাকে প্রশ্ন করা হলো- আপনি কি মাস্টার্স বা অনার্স ল’তে পাস করেছেন? এটাই ছিল তাদের প্রথম প্রশ্ন! এরপর ওনারা যতগুলো প্রশ্ন করেছিলেন, সবগুলোর উত্তর ইংলিশে দিয়েছি। দেখলাম, ওনাদের বোঝার দরকার আছে, আমি পারব কি-না? প্রশ্ন শেষে ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন বললেন ‘উই আর স্যাটিসফাইড’ (আমরা সন্তুষ্ট)। কিন্তু চাকরিবিধিতে বাধা থাকার কারণে আমরা আপনাকে নিতে পারছি না। আপনাকে রিক্রুট (নিয়োগ) করলে আমাদের চাকরি থাকবে না। যা হোক আপনার পরীক্ষায় আমরা সন্তুষ্ট। এটুকু আমরা এনশিওর (নিশ্চিত) করছি, ভবিষ্যতে অন্য কোনো পজিশনে যদি নিয়োগের সুযোগ থাকে আপনি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আমরা চেষ্টা করব।
ইন্টারভিউ বোর্ডে আমাকে প্রশ্ন করা হলো- আপনি কি মাস্টার্স বা অনার্স ল’তে পাস করেছেন? এটাই ছিল তাদের প্রথম প্রশ্ন! এরপর ওনারা যতগুলো প্রশ্ন করেছিলেন, সবগুলোর উত্তর ইংলিশে দিয়েছি। দেখলাম, ওনাদের বোঝার দরকার আছে, আমি পারব কি না? প্রশ্ন শেষে ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন বললেন ‘উই আর স্যাটিসফাইড’ (আমরা সন্তুষ্ট)। কিন্তু চাকরিবিধিতে বাধা থাকার কারণে আমরা আপনাকে নিতে পারছি না
এর মধ্যে ১৯৮৩ সালে জজ কোর্টে আইনপেশা শুরু করি। সেই ভাইভা বোর্ডের যিনি চেয়ারম্যান ছিলেন, ১৯৮৫ সালে তিনি আমাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সুবিধা হলো- গভর্নমেন্ট ফাইলগুলো আমার কাছে আসত। যে কেসগুলো আমাকে অ্যালোটমেন্ট (বরাদ্দ) দিত, সে ফাইলগুলো আমি পেতাম। ১৯৮৯ সালে আমি হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করার পারমিশন (অনুমতি) পাই। এরপরে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করা শুরু করলাম। ২০০২ সালে এসে আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট (আইনজীবী) হলাম। এখনও আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে আছি। আমার সহযোগিতার জন্য আপাতত সেলিম রেজা নামে একজন আছেন। সেলিম রেজা আমার সঙ্গে কাজ করেন। জজ কোর্টে আছেন কয়েকজন। জজ কোর্টের ওই চেম্বারটা আমার ১৯৯৫ থেকে। ২০১৮ সালে সিনিয়র আইনজীবী হওয়ার জন্য আবেদন করে রেখেছি।
আমার সম্পর্কে মানুষের আন্ডারস্ট্যান্ডিং (বোঝাপড়া) ক্লিয়ার (পরিষ্কার) ছিল না। আমাদের আইনজীবীদের মধ্যেও অনেকে মনে করতেন, আমার পক্ষে আইনপেশা সম্ভব না। অনেকে বলতেন, এত কঠিন প্রফেশন (পেশা) আপনি কেন বেছে নিলেন? এটা তো চ্যালেঞ্জিং! এখানে আপনি সাকসেসফুল (সফল) হতে পারবেন না। কারণ আপনাকে দেখে কোনো ক্লায়েন্ট (মক্কেল) আসবে না ইত্যাদি। ঢাকা বার সমিতিতে কোনো ক্লায়েন্ট যখন আমার কাছে আসতেন তখন কেউ কেউ (আইনজীবীরা) আমার সম্পর্কে নেগেটিভ কথা বলতেন। বলতেন, সে তো অন্ধ! তাকে কেন মামলা দেবেন? এভাবে অনেক ক্লায়েন্ট ভাগায়ে নিতেন। পরে তাদের কাছে আমি এসব শুনতাম।
ভালো ক্লায়েন্ট প্রথম প্রথম পেতাম না। ফি ছাড়া কেস লড়ে আমাকে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়েছে। ক্লায়েন্টকে সন্তুষ্ট করতে হয়েছে। এরপর কেস পেয়েছি। আরেকটি কথা, কোনো সিনিয়র আমাকে সরাসরি জুনিয়র হিসেবে রাখেননি। কারণ জুনিয়রদের যে ফাংশন এটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি দু-একজনকে বলেছিলাম, আমাকে সঙ্গে একটু রাখা যায় কি-না, তারা ওইরকম আগ্রহ ব্যক্ত না করে বলেছিলেন, আপনি মাঝে মাঝে আসবেন, কোনো সমস্যা হলে দেখাবেন।
আইনজীবীদের অনেকে মনে করতেন, আমার পক্ষে আইনপেশা সম্ভব না। এখানে আপনি সাকসেসফুল (সফল) হতে পারবেন না। কারণ আপনাকে দেখে কোনো ক্লায়েন্ট (মক্কেল) আসবে না ইত্যাদি। ঢাকা বার সমিতিতে কোনো ক্লায়েন্ট যখন আমার কাছে আসতেন তখন কেউ কেউ (আইনজীবীরা) আমার সম্পর্কে নেগেটিভ কথা বলতেন
প্রথমদিকে আমার কাছে যারা আসতেন খুব গরিব এবং এরা টাকা-পয়সা দিতেন না। আমি বলতাম, ঠিক আছে কোনো সমস্যা নেই। আপনি শুধু কোর্টের খরচটা ম্যানেজ করবেন। এভাবে আমি ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত কেস চালিয়েছি। এভাবে সাহায্য করেছি আমি। সেগুলোতে ম্যাক্সিমামই সাকসেসফুল (বেশিরভাগই সফল)। এ কারণে ওই ক্লায়েন্টগুলো নিজেরা টাকা না দিলেও তারা কিন্তু অনেক ক্লায়েন্ট আমার কাছে পাঠিয়েছেন। তখন পর্যন্ত আমার একজন শুধু ক্লার্ক ছিল।
বিচারকদের কাছ থেকে মিলেছে সহযোগিতা…
সবাই আমাকে কো-অপারেট করেন। আমাকে উৎসাহ দেন। অনেক সময় আইনজীবীদের রিডিং পড়তে হয়। কিন্তু আমাকে বিচারকরা রিডিং পড়তে না করেন। তারা বলেন, শুধু পেজ নম্বর বললেই আমরা পড়তে পারব। অথবা যদি অ্যাসিস্ট্যান্ট (সহকারী) থাকে সে পড়লেই হবে। আমি আগে থেকেই যেকোনো কেসের প্রিপারেশন (প্রস্তুতি) নিয়ে যাই। টু দ্য পয়েন্ট জাজ সাহেবের সামনে বলে দেই। যে কারণে অল্পতেই আমার কাজ হয়। রুল হয়ে যায়। শুনানির ক্ষেত্রেও দেখেছি, আমার সমস্যা হয় না। জজ সাহেবরা সহযোগিতা করে থাকেন।
কখন দুঃখ লাগে…
শিক্ষিত মানুষরা যখন প্রতিবন্ধীদের অবমূল্যায়ন করে তখন খুব দুঃখ লাগে। কারণ সাধারণ মানুষ তো অবমূল্যায়ন করতেই পারে। কিন্তু যারা লেখাপড়া করেছে তাদের তো অন্তত বোঝার চেষ্টা করা উচিত।
যে কষ্ট এখনও নাড়া দেয়…
প্রথমদিকের একটা কষ্টের স্মৃতি আছে। একজন জাস্টিস (বিচারপতি) ছিলেন, তার কোর্টে আমি একটা ক্রিমিনাল আপিল (অপরাধ আবেদন) নিয়ে গিয়েছিলাম। এটা ডিলে (দেরি) ছিল। আমি ল’টা নিয়ে গিয়েছিলাম যেন ডিলে হলেও ডিলে কনডন (মাফ) করা যায়। কিন্তু জজ সাহেব ডিলেটা দেখে আমার ফাইলটা ফেলে দিলেন। দেখতেই রাজি না। ‘নো, নো এটা হবে না’। আমি যত ল’-এর কথা বলি, উনি আর শোনেননি। সে সময় দুজন অ্যাডভোকেটের কথা মনে আছে। যাদের কথা স্মরণ না করলে হয় না। একজন ছিলেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক, অন্যজন ছিলেন ব্যারিস্টার শওকাত আলী খান। দুজনই খুব নামকরা আইনজীবী। দুজন এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। তারা বললেন, উনি আমাদের জুনিয়র ফ্রেন্ড, ব্লাইন্ড। ওনার কেসটা একটু শোনা দরকার। বলার পরে, উনি শুনলেন। ওইদিনটার কথা মনে পড়ে।
একটা মামলার শুনানির স্মৃতি মনে হলে, এখনও হাসি পায়। বদরুল ইসলাম চৌধুরী নামে এক ডিস্ট্রিক্ট জজ (জেলা জজ), পরে হাইকোর্টে এসেছিলেন। একটা ক্রিমিনাল মামলা নিয়ে গিয়েছিলাম। শাস্তি ছিল- মাত্র ছয় মাস। সে (আসামি) আমার কাছে এসেছে। আমি কেস নিয়ে আপিল করতে গেলাম। জজ সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কোন ধারার মামলা’। বললাম, ৩৭৬ ধারার মামলা। বললেন, ‘এটার পানিশমেন্ট (শাস্তি) কত বছর’। বললাম মিনিমাম (সর্বনিম্ন) ১০ বছর। জজ সাহেব বললেন, ‘কিন্তু তাকে ছয় মাস পরে ছেড়ে দিল কেন?’ আমি বললাম, এটা তো নিচের কোর্ট দিয়েছেন। উনি সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম নিচের কোর্টকে শোকজ করলেন কম সাজা দেওয়ার জন্য। আমার ক্লায়েন্ট খুব ভয় পেয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালালেন। সেই স্মৃতি মনে পড়লে এখনও হাসি পায়।
যাদের স্মৃতি ভুলতে পারেন না…
আমার এক বন্ধু ছিল জজ; শামীম আফজাল। ১৯৮৮ সালে ঢাকায় আসে সে। তখন সে অনেকগুলো কেস পাঠাল আমার কাছে। সে ছিল হাউজিং সেটেলমেন্ট (আবাসন নিষ্পত্তি) অফিসে। পরবর্তীতে আমার সেই বন্ধু ইসলামী ফাউন্ডেশনের ডিজিও ছিলেন। মারা গেছেন সম্প্রতি।
প্রথমদিকে আমার কাছে যারা আসতেন খুব গরিব এবং এরা টাকা পয়সা দিতেন না। আমি বলতাম, ঠিক আছে কোনো সমস্যা নেই। আপনি শুধু কোর্টের খরচটা ম্যানেজ করবেন। এভাবে আমি ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত কেস করেছি। এভাবে সাহায্য করেছি আমি
আরেকজনের স্মৃতি ভুলতে পারি না। তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের শ্বশুর। এ বি এম খায়রুল হক স্যার ওনার শ্বশুরের কাছে আমাকে হ্যান্ডওভার করেছিলেন। বললেন, আমার কাছে প্লেস খালি নেই। চারজনের বেশি নিতে পারছি না। তুমি আমার শ্বশুরের কাছে যাও। তার শ্বশুর খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে বলতেন, তুমি প্রতিদিন আমার চেম্বার অ্যাটেন্ড করবে। ইন্টিমেশনের ছয় মাস আমার মনে হয়, কোনো দিন চেম্বারে যাওয়া আমি মিস করিনি।
আছে সামাজিক দায়বদ্ধতাও…
১৯৮৫ সাল থেকে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে পড়াই। এখানে প্রতিবছর আমার প্রায় ২০০/৩০০ ছাত্র বের হয়। ৮৫ থেকে যদি ধরেন আজ পর্যন্ত এভারেজে (গড়ে) ২০০ করে ধরলেও কিন্তু অনেক ছাত্র বের হয়েছে। এটাকে আমি সোশ্যাল ওয়ার্ক (সামাজিক কাজ) হিসেবে মনে করি। কোর্ট শেষে আমি সার্ভিসটা (সেবা) দেই। এখন হয় তো আমার মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। তারপরও আমি মনে করি, এটা চালিয়ে যাওয়া আমার জন্য ভালো। পাশাপাশি আমি কিন্তু সামাজিক কাজও করি। বাংলাদেশ ডিজেল ইমপিয়ার পিপলস সোসাইটি নামে একটি সংগঠন ২০০৫ সালে তৈরি করেছি। এটাতে আমি দীর্ঘদিন সেক্রেটারি (সম্পাদক) ছিলাম, পরে প্রেসিডেন্ট (সভাপতি) হয়েছি। এখন অ্যাডভাইজার (উপদেষ্টা) হিসেবে কাজ করি। এছাড়া মিরপুরে বিএনএসবি নামে ব্লাইন্ডদের আরেকটি সংগঠন আছে, মিরপুরে চক্ষু হাসপাতাল এই সংগঠন থেকে চালানো হয়। সেটাতেও আমি যুক্ত আছি। আমি প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান নিয়ে কথা বলি। প্রতিবন্ধীদের জন্য ২০১৩ সালে একটা আইন হয়েছে, সেটাতে আমি যুক্ত আছি। আইনটা করার সময় আমি ড্রাফটিং কমিটিতে ছিলাম। সেটা হলো- প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার আইন। এরপর রুল হয়েছে ২০১৫ সালে। সেটার সঙ্গেও আমি যুক্ত ছিলাম।
সফলতার জন্য যেসব গুণ থাকা প্রয়োজন…
আমি মনে করি, সবসময় অধ্যবসায়টা থাকতে হবে। হার্ড ওয়ার্কিংয়ের (কঠোর পরিশ্রম) মানসিকতা এবং সিনসিয়ারিটি (আন্তরিকতা) থাকতে হবে। এরপর একটা লক্ষ্য থাকতে হবে। এই চারটা জিনিস না থাকলে কিন্তু হবে না। আমার টার্গেট (লক্ষ্য) যদি মিস করি, টার্গেটটা যদি এলোমেলো হয় তাহলে কিন্তু হবে না।
পরিবার…
আমার ছেলে একটা, মেয়ে দুটা। মেয়ে দুজনই কলেজের শিক্ষক। ছেলেটা আর্কিটেক্ট (স্থপতি)। তারা সবাই মাস্টার্স করেছে। ছেলেটা আর্কিটেকচারের ওপরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি-এমএসসি কমপ্লিট (সম্পন্ন) করেছে।