মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
সমগ্র বিশ্বের মানুষ এখন প্রার্থনায় রত।সারাক্ষণ বলছে ও ভাবছে কবে মানুষ স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করবে। পৃথিবী আবার কবে প্রাণ ফিরে পাবে। কেননা বিশ্ব পরিস্থিতি করোনা সংকটে ক্রমেই বিপর্যস্ত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে হাহাকার দেখা যাচ্ছে আগামীকাল কি খাবে, কি পরবে, কোথায় চিকিৎসা করাবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ইত্যাদি। এ চিন্তা শুধু যে গরীব মানুষের তা কিন্তু নয়। করোনা ভাইরাস ধনী-গরিব, সাদা-কালো, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। অনেক উন্নত দেশ করোনা সংকটে ও মহামারিতে দিশেহারা। ওষুধ, ভালো হাসপাতাল, নিরাপত্তা সবই তাদের আছে কিন্তু মৃত্যুভয় ও আতঙ্ক চিৎিসকদের চিকিৎসা দিতে অনেককে বাঁধাগ্রস্থ করছে ।তাহলে কোথায় যাবে বিশ্ববাসী সেটিই এখন ঘুরেফিরে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ২৪,৮১,৫৪৮ জন আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ১,৭০,৪৭১ জন এবং সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৬,৪৮,৩৪৫ জন। বাকীরা এখনও অসুস্থ অবস্থায় পড়ে আছে। ডাক্তারগণ চিকিৎসা করতে অনীহা করছে।সারা বিশ্বের মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে চিকিৎসার অধিকার একটা অন্যতম। বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা মানুষ পাচ্ছে না তা বলা যায়।মানব বিধ্বংসী করোনা ভাইরাস মানুষে মানুষে বিভেদ করেছে তা এখন সুস্পস্ট। বিশ্বগ্রাম (Global Village) কনসেপ্টটি করোনা ভাইরাস দ্বারা একাকার। সেখানে বিশ্ব ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়তে বসেছে। জাতিসংঘ বলেছে, মানবজাতির জন্য বড় বিপদ ও হুমকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, মহামারি ও গভীর সংকট । অপরদিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে করোনার জীবানু ছড়ানো নিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও চলছে। সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। কিন্তু এ পর্যন্ত করোনায় সবচেয়ে বেশি ও মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যুক্তরাস্ট্র। যুক্তরাস্ট্রকে ধৈর্য্য ধরতে হবে আরো বেশি। সঠিক কি, কোনটি তা বুঝে সামনে অগ্রসর হতে হবে।হঠকারিতা ছেড়ে মানবকল্যাণে কাজ করতে হবে।বিধাতা যাতে সন্তুষ্ট হয় তাই করতে হবে আর সৃস্টিকে ভালবাসতে হবে।
বাংলাদেশেও দিনের পর দিন করোনা আক্রান্তেন সংখ্যা বাড়ছে । সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যূর সংখ্যাও। জানিনা কোথায় গিয়ে ঠেকে এই মৃত্যুর মিছিল। কেউ জানেনা। করোনায় পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক বন্ধন সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কেউ মরে গেলে কবর দেয়ার মতো স্বজন খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কারোনা ভাইরাস ও এর তীব্রতা উপেক্ষা করে লক্ষ্ লক্ষ মানুষ জানাজা পড়ছে। বড়ই বিচিত্র এই সমাজ ও সময়। সকলেই বলছে করোনা এসেছে কিন্তু চলে যায় না কেন? আমার ও আপনার এ প্রশ্ন সকলের। কেননা ইতোমধ্যে মানুষ হাজার শিক্ষা পেয়ে গেছে। পারিবারিক, ব্যাক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যসহ নানারকম কঠিন বাস্তবতা ও শিক্ষা দিতেই কম করছে না এই ভয়াল করোনা ভাইরাস। মানুষ মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস পরা শিখেছে, হাঁচি, কাশি দেয়ার ভদ্রতা জেনেছে, সাবান দিয়ে ঘনঘন হাত ধোয়া শিখেছে। এ প্রজন্মের শিশু ও কিশোর যদি বেঁচে থাকে থাকে তাহলে করোনা পরিবর্তিত বিশ্বে আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার নিয়ে বড় হবে। যে শিক্ষা কেউ শিখেনি বা সারা বিশ্বের শিখাতে পারেনি করোনা এই ০৬ মাসে তার বেশি শিখিয়েছে।মানুষ মাস্ক পরা শিখেছে সেটি ইতিবাচক, তবে চালচুরি বন্ধ করা এখনও শিখেনি। করোনা পরিবর্তিত এই চাল চোরেরা যদি বেঁচে থাকে তবে আগামীতে তারা যে আরও বেপরোয়া হবে তা নিঃসন্দেহে অনুমেয়। শুধু চালচুরি করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না গরিবের ত্রাণ আত্নসাৎও গুদামজাত চলছে হরদম।
মানুষ একটা বন্দিদশা পার করছে। নতুন শব্দ শিখেছে এখনকার প্রজন্ম ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ বা গৃহবন্দি। মহামারিতে এই লকডাউন ও গৃহবন্দি থাকতে হবে তা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শিখিয়েছেন অনেক আগেই । কিন্তু আমরা তা মানতাম না তাই জানার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি নাই। গরিব, অসহায় ও শ্রমিক শ্রেণী এককথায় যারা মজলুম তারা ভুগতেছে এই বন্দিদশায়। একশ্রেণীর লোক এই হোম কোয়ারেন্টাইন উদযাপনে ব্যস্ত। ইশ্বর তাদের বোধদয় করো।তবে গৃহবন্দি দশা পারিবারিক বন্ধন অটুট করছে। চাকুরিজীবী পিতা-মাতাকে তাদের সন্তান কাছে পাচ্ছে। সারা দুনিয়ার লোক অসহায় যারা নিজেদের পরাশক্তি ভাবে তাদের অহংকার ও শক্তির অবদমন দেখছি। পারমানবিক বোমা কাজে লাগছে না। শ্রেষ্ঠ সৈন্য, নৌ, বিমান সেনা সব বাহিনীই কুপোকাত। অসহায় আত্নসমর্পণ।কর্মজীবী লোকজন আজ বেকার। স্বামী-স্ত্রী ঘরে থাকার ফলে এই করোনা ভাইরাস অনেক সুখের সংসারে ভাঙ্গন ধরিয়েছে। আবার অনেকের মধ্যে অতি গভীর ও নির্ভার সম্পর্ক করে দিয়েছে বা দিচ্ছে।
দুঃসময়ে আপনজন চেনা যায়। মনীষীরা বলেন আপনার জুলুমের সময় যে নিরপেক্ষ থাকে সে আপনার বন্ধু হতে পারে না। কথা সত্য। বিপদে পড়লে বন্ধু চেনা যায়। আবার বন্ধু চিনতে হলে কিছু টাকা ধার দেওয়ার গুরুবাক্য আমরা শুনেছি। করোনা কালে কিছু মানুষ বাড়িতে ভুরিভোজে ব্যস্ত আবার কিছু লোক দু’বেলা অন্ন জোটাতে হিমশিম খাচ্ছে। সত্যিই নিয়তির কঠিন খেলা। এগুলো মেনে নিয়েই জীবন পার করতে হবে। গরিব মানুষের খাবার সংকট প্রকট হতে শুরু করেছে । না জানি সামনে কি ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। খাবারের জন্য মানুষে মানুষে হাহাকার লেগে যেতে পারে। কিন্তু কিছু লোক এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকবে তবুও দানের হাত প্রসারিত করবে না। নিজেদের সুখী রাখতে ব্যস্ত। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব বেশি ভালো তা কিন্তু নয়। আমদানি নির্ভর অর্থনীতি লকডাউন বেশি দিন থাকলে উৎপাদন মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। জিনিষপত্রের দাম বেড়ে যাবে। ক্রয় ক্ষমতা থাকবে না। মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিবে। নানা সমস্যা হবে। সরকার একপর্যায়ে ধার দেনা করবে এবং ধীরে ধীরে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। তখনও সমাজে একশ্রেনীর লোক গরিব ও এতিমের মালামাল লুট ও আত্নসাতে ব্যস্ত থাকবে। করোনা কালে লোভ সংবরণ করতে শিখতে হবে।
সমাজে লকডাউন দীর্ঘদিন চললে কিছু ধমার্ন্ধ লোক ধর্মকে ব্যবহার করে আয় রোজগার করবে। টুপি পরা লোকের করোনা ধরবে না বা মুসলিমদের করোনা ধরবে ইত্যাদি বলবে। কিন্তু এসব ধর্মান্ধ লোকজন কিছুদিন সুবিধা করলেও তাদের ব্যবসা মানুষ একসময় বুঝতে পারবে। এবং মানুষেরা আস্তে আস্তে ওই ধর্মান্ধদের ঘৃনা করবে। ধর্মের বিধিবিধান বুঝে ও পড়ে সঠিকভাবে পালন করতে হবে। বিশ্বে মুসলিমদের মহানবীকে এখন হাইলাইটস করছে অন্যান্য ধর্মের লোক তা ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি। মানুষ একসময় কোনটা সঠিক তা বুঝবে। মক্কা মদীনায় যেখানে ইবাদত সীমিত করা হয়েছে। সেখানে হুজুরদের জানাজা ভেবে অধিক সংখ্যক লোকের সমাগম হয় তা বোধগম্য নয়। হোম কোয়ারেন্টাইন বা লকডাউন না মেনে চললে তা করোনা ভাইরাসকে আহবান করা ও রাসুলের হাদীস না মানার সামিল হয়।
পুলিশ, ডাক্তার, নার্স এরা সমাজের ও রাস্ট্রের শ্রেস্ঠ সন্তান ইত্যাদি শুনছি এখন। পুলিশ টাকা ছাড়া কাজ করে না, ডাক্তারের ফি বেশি, চেম্বারে নিয়ে যায় রোগী এবং ওষুধ কোম্পানি থেকে ও টেস্ট করিয়ে কমিশন খায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে করোনা দুর্দিনে একথা অনস্বীকার্য যে পুলিশ, ডাক্তাররা হলো জাতির সূর্য সন্তান, তাদেরকে যাবতীয় উপকরণ ও সম্মান দিয়ে করোনা সংকট মোকাবেলার কাজে নিয়োজিত রাখতে হবে। তা নাহলে করোনা ভয়াবহতা যদি জ্যামিতিক হারে বেড়ে যায় তখন কি হবে। আমাদের হাসপাতাল, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী সবই অপ্রতুল এবং যা আছে তা ঠিকঠাক করে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী সকলেই ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারে। ব্যবস্থার উপরে দোষ চাপিয়ে যেন কেটে না পড়ে তা দেখতে হবে। চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে অনেক ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তপক্ষ এবং তাদের বিরুদ্ধে সরকার ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটিও সঠিক হয়নি। খেলার উপকরন না দিয়ে মাঠে নামালে যা হওয়ার তাতো হবেই। সকলকে ধৈর্য্য ধরার তৌফিক মহান প্রভু দান করুক।
ত্রাণ নিয়ে ও দিয়ে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দেওয়া হচ্ছে অহরহ। সবই লোক দেখানো। এই লোক দেখানো কাজ বন্ধ করতে হবে। ছবি উঠিয়ে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখে এটাকে পুঁজি করছে অনেকেই। ব্যবসা করছে ত্রান কেন্দ্রিক্। সত্যিই বিচিত্র মানুষ। একজন গরিব মানুষকে ১০ জনে মিলে ত্রাণ দেওয়ার ছবি সত্যিই দৃস্টি কটু। আবার অনেকে নিরবে দান সদকা করে যাচ্ছে। মানবকল্যাণে নিজের জীবন দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রচারবিমুখ। এরাই বীর। তাদেরকে স্যালুট। মানব কল্যাণে নিজেকে যার যার অবস্থান থেকে বিলিয়ে দিতে হবে। কামিনী রায় যথার্থই লিখেছেন, “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
পরিশেষে বলতে চাই আমাদের এখন অসীম ধৈর্য্য ধরতে হবে। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, তিনি ধৈর্য্যশীলদের পছন্দ করেন। বিপদে ধৈর্য্য ধরতে হয়। বিচলিত হলে চলবে না। করোনা ভাইরাস আমাদেরকে কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছে নানাভাবে। অর্থনৈতিক ভাবে সামনে আরো কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। যারা সামর্থ্যবান আছি তাদের উচিত হবে এসময় অসহায় গরিবদের মাঝে খাবার ভাগাভাগি করা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত মজুদ না করি। রোগবালা মুসিবত ও করোনা হতে বাঁচতে বেশি বেশি দান সদকার হাত প্রসারিত করি। সরকারকে সহযোগিতা করে দেশকে বাঁচাতে হবে এবং নিজে বাঁচতে হবে। মনে রাখতে হবে করোনায় আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে এই ধন-সম্পদ, ক্ষমতা কোন কিছুই কাজে আসবে না। সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে……….থাকবে শুধু আপনার আমার কীর্তি। তাই কিছু ভালো কাজ করে যেতে হবে। আর সেই সময় এই করোনা দুঃসময়।
লেখকঃ কলামিস্ট, গবেষক ও আইন বিশ্লেষক। ইমেইলঃ bdjdj1984du@gmail.com.