২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশের বাজারে প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলোর এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১০৫ টাকা। গত পাঁচ মাসে লিটারপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম এখন দাঁড়িয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। এটি দেশের বাজারে তেলের সর্বোচ্চ দাম বলে জানা গেছে। খোলা তেলের দামও লিটারপ্রতি পৌঁছেছে ১২৫ টাকায়। অবশ্য সরকারের বিপণন প্রতিষ্ঠান টিসিবি কার্যক্রমে প্রতি লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার কারণে দেশের ভোজ্য তেল বাজারের এমন টালমাটাল অবস্থা বলে জানিয়েছে দেশের তেল বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো। এ দাম আরও বাড়তে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা।
করোনাভাইরাস সংকটকালে গত বছরের মে মাসে মেঘনা ও সিটি গ্রুপ তাদের সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা করে কমিয়েছিল। সে সময় এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম নেমে আসে ১০৫ টাকায়, যা গত আগস্ট পর্যন্ত বজায় ছিল। এরপর থেকে মাসে মাসে বাড়তে থাকে তেলের দাম।
ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতি সপ্তাহেই মেঘনা, সিটি গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডসহ সব সয়াবিন তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের তেলের দাম বাড়ছে। গতকাল ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি লিটার ১৪০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, বোতলজাত সয়াবিন তেলের মধ্যে রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের তেল সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এক লিটার তেলের খুচরা দর ১৪০ টাকা। পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। দুই লিটার তেলের দাম ২৭৫ টাকা। পাইকারি কিনতে গুনতে হচ্ছে ২৫৫ টাকা। আর পাঁচলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল রূপচাঁদা খুচরা বিক্রি করছে ৬৮৫ টাকা দরে। আর পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে ৬৩০ টাকায়।
রূপচাঁদার চাইতে কিছুটা কমে বিক্রি হচ্ছে তীর ও এসিআই ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল। তীর ব্র্যান্ডের এক লিটার সয়াবিন তেল খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়। পাইকারি দর ১২৮ টাকা। একই দামে বিক্রি হচ্ছে এসিআই ব্রান্ডের এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল। দুই লিটার তীর সয়াবিন তেলের খুচরা বিক্রি হচ্ছে ২৬৮ টাকায়। পাইকারি দর ২৫২ টাকা। খুচরা বাজারে এসিআই একই দামে দুই লিটার বোতলজাত তেল বিক্রি করলেও পাইকারি বাজারে চার টাকা বেশি নিচ্ছে এসিআই। আর তীরের পাঁচ লিটার তেলের খুচরা দর ৬৫৫ টাকা। পাইকারি বাজারে সে দর ৬২৫ টাকা। এসিআই পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তীরের চাইতে পাঁচ টাকা কমে ৬৫০ টাকায় বিক্রি করছে। তবে পাইকারি বাজারে তীরের চাইলে পাঁচ টাকা বেশি এসিআই কোম্পানির তেলের দাম। বিক্রি হচ্ছে ৬৩০ টাকা দরে।
ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিদের মতে, প্রতি সপ্তাহে তেলের দাম বেড়ে চলেছে। আরও কত বাড়বে সে বিষয়ে তাদের ধারণা নেই। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এসিআই ব্র্যান্ডের একজন বিক্রয় প্রতিনিধি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গত ছয় মাস ধরে তেলের দাম প্রতি সপ্তাহেই বাড়তে দেখছি। আমাদের যে রেট দেয়া হয়, আমরা সে রেটেই ওর্ডার নেই। মাঝে তেলের কিছুটা সংকটও ছিল।’
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ার কারণে দেশের বাজারে দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন দেশের প্রথম সারির ভোজ্য তেল বিপণনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম প্রচণ্ড রকম বাড়ছে। সেহেতু আমাদের দামটা এডজাস্ট করতে হচ্ছে। সব কোম্পানি আগে-পরে একই গতিতে দাম বাড়িয়েছে। এটা পুরোটাই আমদানির বিষয়। কাঁচামালের দাম যত বাড়বে, আমাদের দামও তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও কমে যাবে।’
তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ক্রেতাদের নেতিবাচক বক্তব্যের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান তো লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে পারবে না।’ আন্তর্জাতিক বাজারের এ দাম হঠাৎ করে কমবে না, দাম কমতে সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০১২ সালে ভোজ্য তেলের বাজার বেশ চড়া হয়েছিল। সে সময় এক লিটার সয়াবিন তেল কিনতে গুনতে হয়েছে সর্বোচ্চ ১৩৫ টাকা। ওই বছর আন্তর্জান্তিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি মেট্রিক টন এক হাজার ৪০০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। সে সময় দেশের বাজারে তেল আমদানিও কমে গিয়েছিল। ফলে তেলের ঘাটতির পাশাপাশি বেড়েছিল দাম।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশের মানুষের আয়ের ওপর প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থায় কোনো পণ্যের বাজার দর বেড়ে গেলে তা সাধারণ ক্রেতাদের জন্য শুভকর নয় বলে মন্তব্য করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এর সভাপতি গোলাম রহমান।
গোলাম রহমান বলেন, ‘সোয়াবিন দেশে রিফাইন হয়। কিন্তু কাঁচামাল দেশের বাইরে থেকে আসে। পণ্যটি আমদানিনির্ভর। আমদানিনির্ভর পণ্য যে দেশ থেকে আমদানি হয়, যদি সে দেশে দাম বেড়ে যায়, তাহলে তার প্রভাব আমাদের বাজারে পড়বে।‘
কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়া মাত্রই দেশের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছে। যদিও সে সময় দেশে আগে আমদানি করা তেল ছিল। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা কম দামে আমদানি করা তেল চড়া দামে বিক্রি করেছে অভিযোগ করে গোলাম রহমান বলেন, ‘হয়তো আজ, দশ দিন আগে বা এক মাসে আগে যে তেলটা বিক্রি হচ্ছে, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দামটা কম ছিল। কিন্তু বাজারে দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের বিক্রেতা যারা আছে, তারা দামটা বৃদ্ধি করে দিয়েছে।‘
এ অবস্থায় ভোজ্য তেলের আমদানি শুল্ক কমিয়ে বা শুল্ক মওকুফ করে দাম নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন গোলাম রহমান। পাশাপাশি টিসিবির মাধ্যমে তেল আমদানি ও ভর্তুকি দিয়ে তেল বিক্রি করে সরকার জনগণকে বাড়তি দামের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সয়াবিনের ওপর তিন পর্যায়ের ভ্যাট আছে। সরকার দুভাবে মূল্যটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একটা হলো শুল্ক হার কমিয়ে বা শুল্ক তুলে দিয়ে। অথবা টিসিবি বা রাষ্ট্রীয় সংস্থার মাধ্যমে আমদানি করে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি বিক্রি করতে পারে।‘
এদিকে বাজার মূল্যের চাইতে লিটার ৬০ টাকা কমে সয়াবিন তেল বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। টিসিবির মুখপাত্র ও উপ-ঊর্ধ্ব কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির আমাদের যে কার্যক্রম তা চলমান রয়েছে। আমরা ৮০ টাকা লিটারে তেল বিক্রি করছি। প্রতি ক্রেতা দুই থেকে পাঁচ লিটার করে তেল কিনতে পারছেন।‘
তাদের তেলের দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা ৮০ টাকা লিটার বিক্রি করছি। এখনো পর্যন্ত দাম বৃদ্ধির কোনো নির্দেশনা নেই। তথ্যসূত্রঃ ঢাকাটাইমস২৪.কম