মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
করোনা ভাইরাস এর সাথে আরেকটি সাম্প্রতিক আলোচিত ইস্যু হচ্ছে ত্রাণের চাল চুরি ও আত্মসাৎ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৩১ দফা নির্দেশনাসহ যাবতীয় আদেশ করোনা মোকাবেলায় অত্যন্ত ফলপ্রসু বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। কিন্তু সমস্যা হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উক্ত গৃহীত পদক্ষেপ ও নির্দেশনা বাস্তবায়নের সাথে জড়িত ও স্টেকহোল্ডারদের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা সোস্যাল মিডিয়াসহ মেইনস্ট্রিম পত্রিকার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জানছি যে ত্রাণ হিসেবে বা ১০ টাকা কেজি দরের চাল স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের হাতে সঠিকভাবে পৌঁছানো যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না তা আমরা সকলেই জানি। সুষ্ঠু আইন প্রয়োগের অভাব করোনা ভাইরাস ছড়ানো প্রতিরোধে কি কি আইন বাংলাদেশে আছে তা সকলেই ইতোমধ্যে জেনেছি। এখন জানবো যারা করোনা সংকটে পড়ে দিশেহারা তাদের সরকার প্রদেয় নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য চাল, ডাল, তেল ও শুকনা খাবার যারা আত্নসাৎ করছে এবং নিজেরা চুরি করছে (চালচোর)তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে কি প্রতিকার আছে।
আমরা পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি চালআত্নসাৎ ও চুরি ঠেকাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে সজাগ আছেন।মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের দেয়া ত্রাণ কেউ চুরি করলে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাৎক্ষনিক বিচার করা হবে বলে চোরদের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার (১২ মার্চ) গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলার সময় তিনি এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেছেন, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমার কাছে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কয়েকটি খবর এসেছে। আমরা সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। সেই সহায়তায় যারা অনিয়ম দুর্নীতি করার চেষ্টা করবে তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাদের বিচার করা হবে। উনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেহেতু মূল আদালত এখন বন্ধ বা অল্প পরিসরে কার্যক্রম চলছে সে হিসেবে মনে হয় উনি মোবাইল কোর্টোর কথা বলছেন। কিন্তু এটাও দেখতে হবে যে মোবাইল কোর্টের কতটুকু শাস্তি দেয়া বা বিচার করার এখতিয়ার আছে। যারা ত্রাণের চাল চুরি করছে তারা যদি জানে যে মোবাইল কোর্ট শুধু টাকা জরিমানা করে এবং ১৫ দিন বা একমাসের সাজা প্রদান করেন তাহলে এই চুরি বা আত্নসাৎ কোনভাবেই ঠেকানো যাবে না। এমনকি দুই বছরের সাজা ও যদি হয় তাহলে কিছুদিন পর আপিলে জামিন বা খালাস পেয়ে যাবে।
মোবাইল কোর্ট আইনের বিধিবিধান মেনে ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সাজা প্রদান করছে না বিধায় উচ্চ আদালতেও আইন প্রয়োগে ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে আসামীরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। মিজানুর রহমান খান ০৪ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় “মোবাইল কোর্ট চলুক হাইকোর্টের অধীনে” একটি কলামে লিখেছিলেন ভয় দেখিয়ে ন্যায়বিচার হবে না। ন্যায়বিচার ছাড়া সমাজে শান্তি আসবে না। মোবাইল কোর্টের তাৎক্ষণিক বিচারের দর্শন আসলে ভীতি ছড়ানোর দর্শন। ভয় দেখানোর যন্ত্রগুলো জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা আত্মঘাতী। বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান নারী নির্যাতন, ধর্ষণের রাশ টানেনি। তিনি আরো লিখেছিলেন,“কিন্তু এখন যেভাবে মোবাইল কোর্ট চলছে, তাতে আমজনতার পক্ষেও সহজে বোঝা সম্ভব যে, মোবাইল কোর্ট ন্যায়বিচার দিচ্ছেন না। তাঁরা আইনের শর্ত মানছেন না। আইন বলেছে, কোনো অপরাধ ‘তাহার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের) সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হইয়া থাকিলে তিনি উক্ত অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, দোষী সাব্যস্ত করিয়া, এই আইনের নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করিতে পারিবেন।’ কিন্তু আমরা দেখছি, এর অহরহ লঙ্ঘন ঘটছে। আইনজীবী রাখার নিয়ম রাখা হয়নি, কারণ ধরে নেওয়া হয়েছে যাঁরা দোষ অস্বীকার করবেন, তাঁদের অপরাধের বিচার তাঁরা নিয়মিত আদালতে পাঠাবেন।” যে সকল ব্যক্তি আজীবন বেঁচে থাকবেন বলে ত্রাণের খাবার ও চাল চুরি করছে বা করেছে সুনির্দিস্টভাবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্ত, বা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে লঘু বা গুরু দন্ডের মত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও ফৌজদারী মামলার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কি । আমার জানা মতে এখনও হয়নি। তবে আশা রাখি হবে।
অত্যন্ত সঠিক কথা বলেছিলেন তিনি তাঁর কলামে। মোবাইল কোর্ট সাজা প্রদানের দন্ডবিধির ৫৩-৭৫ বিধান যথাযথ প্রতিপালন হচ্ছে না। শিশুদের সাজা প্রদান করে মোবাইল কোর্ট ইতোমধ্যে সমালোচিত ও অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।(Ref: Kamruzzaman Khan –Vs.- Ministry of Law (Spl. Original), 9 ALR (HCD) 309-339) মাদক দ্রব্যের রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া সাজা প্রদান, কান ধরিয়ে উঠবস সহ নানা কারণে মোবাইল কোর্ট এর বিচার সমালোচিত হচ্ছে বা হয়েছে। আবার কিছু বিষয়ে গ্রহনযোগ্যতা যে পায়নি তা নয়্। মোবাইল কোর্ট আইনে যারা ম্যাজিষ্ট্রসি পরিচালনা করছেন বা নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটগন যারা মোবাইল কোর্ট আইনের ক্ষমতা প্রাপ্ত তাদেরকে উক্ত আ্ইনের প্রায়োগিক বিষয়ে আরও প্রশিক্ষণ দরকার আছে কিনা তা কর্তা ব্যক্তিরা ভেবে দেখতে পারেন।
মোবাইল কোর্ট আইন মেনে ম্যাজিস্ট্রেট এর ক্ষমতা প্রয়োগ হোক সকলই তা প্রত্যাশা করি। তবে চাল চোরদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিচার এর ব্যবস্থা করলে তা “Justice Hurried, Justice Burried” হয়ে যাবে। চাল চোরেরা যুগে যুগে অধরা থেকে যাবে। চালচোর বা ত্রাণ আত্নসাৎ বন্ধে দুদককে শক্তিমালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
তাছাড়া মোবাইল কোর্ট আইনের বিচার প্রক্রিয়া যথাযথ আইনী মাধ্যমে সঠিক ও যোগ্য আইন জানা ও পড়া জনবল দিয়ে পরিচালনা করলে মোবাইল কোর্ট আইন আলোর মুখ দেখবে। নাহলে যারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছেন তাদেরকে সঠিকভাবে আইনী জ্ঞান লাভের সুযোগ ও প্রায়োগিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
দুদক আইনের শিডেউলে এই ধরনের অপরাধ ঠেকাতে যথেষ্ঠ এখতিয়ার প্রদান করেছে। দন্ডবিধির ৪০৯ ধারায় ভলা হয়েছে, “সরকারী কর্মচারী বা ব্যাংকার বণিক বা প্রতিভূ কতৃক অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গকরণ: যে ব্যক্তি তাহার সরকারি কর্মচারীজনিত ক্ষমতার বা একজন ব্যাংকার, বণিক, আড়তদার, দালাল, এটর্নি বা প্রতিভূ হিসাবে তাহার ব্যবসায় ব্যাপদেশে যে কোন প্রকারে কোন সম্পত্তি বা কোন সম্পত্তির উপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হইয়া সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করেন, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোন বর্ণনার কারাদন্ডে দন্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবে।” এছাড়া যারা চাল চুরি করে মজুদ করছে তাদের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে নিয়মিত মামলা দায়ের করা যেতে পারে।
স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্টের ২৫ ধারায় বলা আছে মজুদদারী বা কালোবাজারীর দন্ডের বিষয়ে উল্লেখ আছে, ২৫. ১ (১) যে কেউ কালোবাজারে মজুদ করা বা লেনদেনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে তাকে মৃত্যুদণ্ড, বা ২ [যাবজ্জীবন কারাদণ্ড], বা চৌদ্দ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হতে হবে বছর, এবং জরিমানার জন্যও দায়বদ্ধ হবে, তবে শর্ত থাকে যে, যদি হোর্ডিংয়ের অপরাধের ক্ষেত্রে, এই জাতীয় অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিটি প্রমাণ করে যে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন লাভ ব্যতীত অন্য কোনও উদ্দেশ্যে, আর্থিক হোক বা অন্যথায়, তাকে তিন মাসের মেয়াদে কারাদন্ডে দণ্ডনীয় হতে হবে এবং জরিমানার জন্যও দায়ী হতে হবে।(২) কালোবাজারে জমা রাখা বা লেনদেনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া কোন আদালত এই অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে সরকারকে যে কোনও কিছু বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেবে।
আবার সরকারি ত্রাণের মালামাল আত্মসাতের ও কারচুপির ঘটনায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন-২০০৯ এর ৩৪ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্তরা বরখাস্ত হতে পারেন। দণ্ড বিধি (পেনাল কোড) ১৮৬০ ধারা ৩৭৯ অনুযায়ী চুরির অপরাধে তাকে অনূর্ধ্ব তিন বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া যায়। এছাড়া দন্ড বিধির ৪০৬ ধারার বিধান মতে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের (ক্রিমিনাল ব্রিচ অব ট্রাস্ট) দায়ে অনূর্ধ্ব ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডিত হতে পারে। তাছাড়া দুদক আইনের সিডিউলে থাকা পেনাল কোডের ৪০৯ ধারা মতে একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
করোনা সংকটে যেহেতু পুলিশ, প্রশাসন সবাই আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৩১ দফা বাস্তবায়নে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি তাই বলবো পুলিশ চালচোর বা আত্নসাৎকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় দুদক আইনে ও অবৈধ মজুদদার ও কালোবাজারীদের রুখতে স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্টের অধীনে নিয়মিত মামলা রুজু করতে পারে। যারা চাল চুরি করছেন তাদের দল-মত না দেখে অপরাধী ও চোর হিসেবে সাব্যস্থ করে বেঁচে থাকলে নিয়মিত আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে ছোটখাট ছিচকে চোর-বাটপাড়দের বিচার মোবাইল কোর্টে হতে পারে। বড়বড় চোরাকারবারী, মজুদদারী ও চাল আত্মসাকারীদের শুধু মোবাইল কোর্ট আইনে বিচারের ব্যবস্থা করলে চালচুরি, ত্রাণ আত্নসাৎ, মজুদদারী, কালোবাজারী কোনদিনই বন্ধ হবে না। সেজন্য আইন প্রয়োগে কঠোর হওয়া এখনই জরুরী।
লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম। কলামিস্ট, আইন বিশ্লেষক ও গবেষক। ইমেইলঃ bdjdb1984du@gmail.com