শয়তান মানবজাতির শত্রু। মানবতার শত্রু। মানব সৃষ্টির পর থেকেই সে মানুষের অনিষ্ট করে আসছে। সে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত আদমসন্তানকে পথভ্রষ্ট করার। পবিত্র কোরআনে তার সেই বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সে বলল, আপনার ক্ষমতা-সম্মানের শপথ! অবশ্যই আমি তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করব।’ (সুরা : সোয়াদ, আয়াত : ৮২)
শয়তান মানুষকে ধোঁকা দেয় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে। তার সূক্ষ্ম প্রতারণার জালে মানুষ বরাবরই ফেঁসে যায়। মানুষের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। নিচে শয়তানের কিছু সূক্ষ্ম প্রতারণার ইতিহাস তুলে ধরা হলো—
বাবা আদম ও মা হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে প্রতারণা : মানুষ একসময় জান্নাতেই ছিল। নির্ঝঞ্ঝাট ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছিল তারা। কিন্তু এটা শয়তানের সহ্য হয়নি। তাই সে কৌশলে মানুষকে নিষিদ্ধ গাছের উপকারাদি বর্ণনা করে সে গাছের ফল খাইয়ে তাঁদের জান্নাত থেকে দুনিয়ায় অবতরণ করতে বাধ্য করে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এই ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘অনন্তর শয়তান তাদের উভয়কে ওখান থেকে পদস্খলিত করেছিল। পরে তারা যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল, তা থেকে তাদের বের করে দিল এবং আমি বললাম, তোমরা নেমে যাও, তোমরা পরস্পর একে অপরের শত্রু হবে এবং তোমাদের সেখানে কিছুকাল অবস্থান করতে হবে ও লাভ সংগ্রহ করতে হবে। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৩৬)
নুহ (আ.)-এর জাতিকে ধোঁকা : মানুষ এক আল্লাহর উপাসনা করে জান্নাতে ফিরে যাক—এটা শয়তান চায় না। তাই সে সূক্ষ্মভাবে নুহ (আ.)-এর জাতিকে দিয়ে তাদের আগের কিছু নেক বান্দার মূর্তি বানিয়ে একসময় তাদের শিরকে লিপ্ত করে দেয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং বলেছে, তোমরা কখনো পরিত্যাগ কোরো না তোমাদের উপাস্যদের; পরিত্যাগ কোরো না ওয়াদ, সুওয়াআ, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসরকে।’ (সুরা : নুহ, আয়াত : ২৩)
আয়াতে উল্লিখিত শব্দগুলো পাঁচটি মূর্তির নাম। হাদিসে এসেছে, এই পাঁচজন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলার নেক ও সৎকর্মপরায়ণ বান্দা ছিলেন। তাঁদের সময়কালে ছিল আদম ও নুহ (আ.)-এর আমলের মাঝামাঝি। তাঁদের নেক ভক্ত ও অনুসারী ছিল। তাঁদের মৃত্যুর পর ভক্তরা সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও বিধি-বিধানের প্রতি আনুগত্য অব্যাহত রাখে। কিছুদিন পর শয়তান তাদের এই বলে প্ররোচিত করল, তোমরা যেসব মহাপুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উপাসনা করো যদি তাদের মূর্তি তৈরি করে সামনে রেখে দাও তবে তোমাদের উপাসনা পূর্ণতা লাভ করবে এবং বিনয় ও একাগ্রতা অর্জিত হবে। তারা শয়তানের ধোঁকা বুঝতে না পেরে মহাপুরুষের প্রতিকৃতি তৈরি করে উপাসনালয়ে স্থাপন করল এবং সম্পূর্ণ নতুন এক বংশধর তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো। এবার শয়তান এসে তাদের বোঝাল, তোমাদের পূর্বপুরুষের ইলাহ ও উপাস্য মূর্তিই ছিল। তারা এই মূর্তিগুলোই উপাসনা করত। এখান থেকে প্রতিমা-পূজার সূচনা হয়ে গেল। (বুখারি, হাদিস : ৪৯২০)
আদ জাতিকে ধোঁকা : মহান আল্লাহ আদ জাতির জন্য দুনিয়ার যাবতীয় ইবাদতের দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। তারা ছিল অনেক বিত্তশালী ও সুঠাম দেহের অধিকারী। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় তারা প্রচণ্ড অহংকারী ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে তারা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে শুরু করে, আল্লাহর নিয়ামতের অবমূল্যায়ন শুরু করে, আল্লাহপ্রদত্ত নিয়ামতগুলোকে তাদের জন্য স্থায়ী মনে করে। আল্লাহর গজব থেকে বাঁচতে বিভিন্ন কল্পিত উপাস্যের অসিলা দিয়ে পূজা শুরু করে। পবিত্র কোরআনে তাদের ধ্বংসের প্রধান কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে। ১. তারা অযথা উঁচু জায়গাগুলোতে সুুউচ্চ টাওয়ার ও নিদর্শন নির্মাণ করত, যা স্রেফ অপচয় ছাড়া কিছু ছিল না। (সুরা : শুআরা, আয়াত : ১২৮ অবলম্বনে)
২. তারা অহেতুক মজবুত প্রাসাদ তৈরি করত এবং ভাবত যেন তারা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে। (সুরা : শুআরা, আয়াত : ১২৯ অবলম্বনে)
তারা দুর্বলদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানত এবং মানুষের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাত। (সুরা : শুআরা, আয়াত : ১৩০ অবলম্বনে)
মুসা (আ.)-এর জাতিকে ধোঁকা : শয়তান তার সূক্ষ্ম প্রতারণার জালে মুসা (আ.)-এর জাতির কিছু মানুষকেও ফেলেছিল। মুসা (আ.)-এর অনুপস্থিতির সুযোগে সে তাদের গো-বৎস পূজায় লিপ্ত করেছিল। যে ঘটনাটি সুরা বাকারার ৫৪ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
এভাবেই শয়তান যুগ যুগ ধরে পৃথিবীব্যাপী তার প্রতারণার জাল বিছিয়ে আসছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসছে। মুমিনের দায়িত্ব শয়তানের প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে সর্বদা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোরআন-হাদিস মোতাবেক আমল করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে অভিশপ্ত শয়তানের প্রতারণা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা