সব
facebook apsnews24.com
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বনাম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিতর্কঃ বাস্তবতার নিরিখে উত্তর - APSNews24.Com

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বনাম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিতর্কঃ বাস্তবতার নিরিখে উত্তর

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বনাম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিতর্কঃ বাস্তবতার নিরিখে উত্তর

বেল্লাল হোসাইন

১”নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আইন কম পড়েছে, তাই তাঁরা বিচার করতে পারবে না। ” এমন প্রচারণা হালে পানি পাবেনা এবং যৌক্তিকও না। আবার সব ধরনের বিচারিক ক্ষমতা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে ন্যস্ত করতে হবে কেবল এই জন্য না, যেহেতু তাঁরা প্রচুর আইন জানে! এখানে আইনের জ্ঞানের চেয়েও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। আসলে আমাদের মূল জায়গায় দৃষ্টিপাত করতে হবে। বিসিএস বা বিজেএস ক্যাডার সার্ভিসের অফিসারদের জ্ঞানগত সমস্যা কম। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন অত্যন্ত দক্ষতা ও দৃঢ়তার সাথে যুগোপযোগী সিলেবাসের আলোকে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতামূলক বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই খাতগুলোতে নিয়োগ দিচ্ছে।তাঁরা সমকালীন সময়ের সেরা পড়ুয়া এবং বেশি জানা শিক্ষার্থী এটা অনেকেই নির্বিবাদে মানে।

২. বিচারিক ক্ষমতা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের দিতে হবে বিচার বিভাগের বাস্তবসম্মত এবং বিশ্বাসযোগ্য স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যে। এখানে জ্ঞানের ঘাটতির আলোচনা করে মিমাংসা হবেনা। বরং আন্তঃক্যাডার কোন্দল বাড়বে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ যে মোবাইল কোর্টের মামলা পরিচালনা করেন, সেখানে দুই বছরের বেশি সাজা দেয়া যায়না। কিন্তু ২০০৭ এর আগে, তাঁরা আরো বেশি সাজা দেয়ার বিচারও করেছেন। রাতারাতি তাদের দক্ষতা হ্রাস পায়নি।

এখানে আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে হবে পৃথক ও স্বাধীন বিচার বিভাগের দাবী। আজ নয় কাল, দশ বছর কিংবা একশো বছর পর হলেও নির্বাহীদের কাছ থেকে এই ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নেয়া হবেই। শাসন শেষ হয়ে দেশ যখন সুশাসনের দিকে যাবে, তখনই এই দাবী বাস্তবায়ন হবে। আইনের এই মারাত্মক ব্যত্যয় যে, কর্তাব্যক্তিরা জানে না, এমন নয়। এটা বর্তমানে একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল বলে বিবেচিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেই রায় আবার স্থগিত করাও হয়েছে। ইতিহাস বলে, দুদিন আগে বা পরে, এই ইঁদুর বিড়াল খেলায় জুডিসিয়ারি জিতে যাবে। রাষ্ট্র তার সুবিধাজনক সময়ে বনের পাখিকে বনে ও শিশুকে মাতৃক্রোড়ে রেখে আসবে বলে মনে করি।

৩. রাষ্ট্রের প্রধান তিন অংগ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এর মধ্যে আইনবিভাগ অর্থাৎ সংসদের নির্বাচিত একাংশ সরকার পরিচালনায় প্রত্যক্ষ অংশ নেয়। মানে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে। এদেশে এখনো রাজনৈতিক দল ও সরকারকে আলাদা করে দেখা হয়না রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে। অথচ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তাই আইনবিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সাথে দারুণ সখ্যতা থাকলেও, কথায় কথায় এদের দোষ ধরার কারণে উক্ত দুইপক্ষই বিচারবিভাগের উপর বেজার থাকে। তবে এতে জনগণ সুবিধা পায়। এখন পর্যন্ত আদালতই জনগণের সর্বশেষ প্রতিকার পাওয়ার বিশ্বস্ত স্থান বলে বিবেচিত। তাই যেকোনো সরকারের আমলেই বিচারবিভাগকে জনগণের প্রত্যাশার চাপ নেয়া ও সরকারের সাথে তর্ক সাপেক্ষে বনিবনা করে, এক রকম সংগ্রাম করেই চলতে হয়। জুডিসিয়াল অফিসাররা, যারা এটা মন থেকে মানতে চায় না, তারা মনঃকষ্টে ভোগে। কিন্তু ফল হয়না!

৪. জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরাও কিন্তু সামারি ট্রায়ালের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। নিরাপদ খাদ্য আদালত, পরিবেশ আদালত তাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। তবে মোবাইল কোর্টের সম্পূর্ণ কার্যক্রম এখনই জুডিসিয়ারিকে না বর্তানোর ব্যাপারে প্রশাসনের আমলারা কিছু যুক্তি দেন, যা একেবারে অযৌক্তিক নয়! বাস্তব উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করি, মোবাইল কোর্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিচালিত হয় ফিটনেসবিহীন গাড়ি, খাদ্যে ভেজাল, বেশি দামে পণ্য বিক্রেতা, মজুদকারীসহ প্রচলিত নানা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এই লোকগুলো ঐক্যবন্ধ ও প্রভাবশালী ও বেশিরভাগ সময় সরকার সমর্থিত হয়। আপনি কি মনে করেন, হরতাল শুধু বিরোধী দলেরাই ডাকে? না।

মাঝে মাঝে সরকার তাদের ব্যবহার করে বিরোধীদের আন্দোলন নিস্তেজ করে। তাহলে আজ যারা ব্যবহৃত হলো, কাল তারাই তাদের হিস্যা বুঝে নিতে চাইবে। চক্ষুলজ্জা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার ভয়ে বাহাদুর তাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাপোর্টও দিবে। কিন্তু এই সিন্ডিকেট শ্রেণিটা এতো বেশি স্বার্থপর যে, নাগালের বাইরে যেতে দিলেই ভোল পাল্টে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাবে। একটি গাড়ির নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ, ড্রাইভারের লাইসেন্স দেয় ডিসি অফিস, ব্যবসা বাণিজ্যের লাইসেন্স, ট্যাক্স টোকেনও সেই প্রশাসনের লোকের কাছে। যারা ইস্যু করে, তাঁরা বাতিলও করতে পারে।

এক্ষেত্রে, নির্বাহীদের সাথে এইসব ধুরন্ধর লোকেরা মোটামুটি সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলতে চায়। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি ঠিকাদারি ইত্যাদি করতে গেলে ডিসি সাহেবের আনুকূল্য লাগে! তাই তাদের উপর একটা মানসিক চাপ থাকে। কিন্তু অন্যদিকে, বিচার বিভাগের কর্তকর্তারা বিশ্বাস করে যে তাঁরা স্বাধীন। যেখানে সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদ তাদের সেই আত্মবিশ্বাস জোগায়। তাদের অনড় থাকার একটা মনোবৃত্তি থাকে। এতে ন্যায় বিচার হবে বটে। কিন্তু জনভোগান্তি বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। দুইজন ড্রাইভারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে দেশজুড়ে ধর্মঘট, আমদানি রপ্তানি বন্ধ ইত্যাদি কৃত্রিম জটিলতা তৈরি হবে। এক্ষেত্রে, জুডিসিয়াল অফিসার কিন্তু নেগোশিয়েট করতে আসবে না।

এখানে ঝামেলা মেটাতে মিটিং কল করবে কিন্তু ডিসি সাহেব! যে দেশে পুলিশের পিটানোকে লোকে টসে জিতে আগে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত মনে করে, সে মানুষদের আইনভিত্তিক বিচারের জ্ঞানে ও আগ্রহে যে ঘাটতি আছে তা সহজেই অনুমেয়। যার হাতে লাঠি নাই, তার কোন ক্ষমতা নাই! এই যুক্তিতে যে দেশের লোকেরা চলে, সেখানে ডিসি সাহেবেরা অনর্থক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ হারাবেন। তাই তাঁরা দৈনন্দিন কাজের সুবিধার্তে কিছু ক্ষমতা নিজেরা চেয়ে নেন। তবে কথা চাউর আছে যে, প্রশাসন ক্যাডাররা চেয়ে চাপ নেন। মানে তাদের যত দায়িত্বই দেয়া হোক তাঁরা না বলেন না। এটাকে অনেকে তাদের অতিরিক্ত কর্তৃত্ববাদী মনোভাব বলে মনে করেন। এছাড়া, ডিসি সাহেব হলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের মাঠ পর্যায়ের প্রধান প্রতিনিধি। জেলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি একজন লোককে ফোন করেন, তিনি ডিসি মহোদয়।

কাজেই সে তার কাজের স্বার্থে বা ব্যক্তিগত ইমেজের স্বার্থে কিছু ক্ষমতা আকড়ে ধরতে চায়। তবে, এসব অদালিলিক যুক্তির যেমন আইনি ভিত্তি নেই, তেমনি সুরক্ষাও নেই। যেকোনো সময় তাই পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। তবে জুডিসিয়াল অফিসারদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে, মাঠ প্রশাসনে কাজ করা। মাঠ একটি চরম উত্তপ্ত জায়গা। পর্যাপ্ত এংগার ম্যানেজমেন্ট কোর্স, জনপ্রশাসন বিষয়ক প্রশিক্ষণ না পেলে তারা মাঠের বিচারে সুনাম অর্জন করতে পারবে না। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বর্তমান বিতর্কের জের টানতে হতে পারে। লালসালুর আসন ছেড়ে গোডাউনে বসে বিচার করার মধ্যে যে বিরাট ফারাক আছে, তা শুধু জ্ঞানের জোরে জয় করা যাবেনা, মারাত্মক উপস্থিত বুদ্ধিও লাগবে। সাথে লোকজনকে চিনতে হবে। এখানেই প্যারাডক্সের শুরু। বিচারপ্রার্থীকে চিনে ফেললেই, বিচারের সারা!

তবুও আইনের শাসন, ক্ষমতা ভারসাম্য এবং রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অংগের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক ঠিকঠাক রাখতে বিচারের ভার বিচারকদেরই দিতে হবে। এক্ষেত্রে, জুডিসিয়াল অফিসারদের হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে যে, সততা ছাড়া দক্ষতা মূল্যহীন। দক্ষতা ছাড়া সততা স্থবির।

দক্ষতা, সততা এবং সদিচ্ছার মাধ্যমে একটি কার্যকরী জনবান্ধব সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। মানুষের মন ও মনন অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর যাপিত জীবন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই বলা হয়, আইনের ছাত্রদের মধ্যে সহজাতভাবে জুডিসিয়াল মাইন্ড বিদ্যমান থাকে তাদের শিক্ষা ও চর্চার কারণে। এটা আসলে বিরাট দক্ষতা নয় বরং স্বভাবের প্রকৃতি। যারা সচেতনভাবে এই বোধ লালন করে, তারা ধীরে ধীরে দক্ষতার শিখড়ে ওঠে। আর যারা অনুভব করে না, তাদের জানা না জানার কোন ফারাক থাকে না।

অন্যকে কম জানা লোক ভেবে, নিজের জ্ঞানের বড়াই করলে জ্ঞান বাড়ে না বরং আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক কমে। তবে বিচারকেরা বিচার করবে এই প্রচারণাটাই তো জনমনে স্বস্তি, আস্থা ও আত্মবিশ্বাস জোগায়! হীন ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বিতর্ক করলে ফলাফল শূন্য। এক্ষেত্রে, যুক্তি ও জনআকংখার প্রতিফলন দেখে আলোচনা এগোলে সহজ সমাধান হবে। রাষ্ট্রের কাজে সবাই ভূমিকা রাখছেন, এখানে কারো ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব নেই বলেই সাধারণ লোকে বিশ্বাস করে।

প্রায় সকল সার্ভিসে কিছু আত্মঅহংকারী, দাম্ভিক মানুষের বিচরণ থাকে। তারা তাদের বর্তমান চাকরিতে না যেয়ে অন্য কিছু করলেও একই আচরণ করতো। তাই সুনির্দিষ্ট কোনো সার্ভিসকে কলুষিত করবেন না। ব্যক্তির অন্যায়ের জন্য ব্যক্তিকে দায়ী করুন। পুরো সার্ভিসের উপর দোষ চাপালে তাদের মনোবলে আঘাত লাগে। এই আঘাত প্রতিঘাত হয়ে নিজেদের দিকে ফিরে আসবে। সাম্প্রতিক প্রতিটি বিতর্কিত ইস্যুতে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এটা নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট বার্তা। অন্তত একে সাধুবাদ জানানো উচিৎ।

লেখকঃ আইন কর্মকর্তা, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, প্রতিষ্ঠাতা সংগঠকঃ ” আমাদের স্বপ্ন “, সামাজিক সংগঠন। bellal.sincere@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :

“পাওয়ার কামস উইথ রেসপন্সিবিলিটি”-প্রসঙ্গ ভ্রাম্যমান আদালত

“পাওয়ার কামস উইথ রেসপন্সিবিলিটি”-প্রসঙ্গ ভ্রাম্যমান আদালত

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বনাম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিতর্কঃ বাস্তবতার নিরিখে উত্তর

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বনাম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিতর্কঃ বাস্তবতার নিরিখে উত্তর

A witness can never be the Judge of any case: Mobile Court Fact

A witness can never be the Judge of any case: Mobile Court Fact

বাল্যবিবাহ রোধ করতে মনিটরিং আরো বাড়ানো দরকার

বাল্যবিবাহ রোধ করতে মনিটরিং আরো বাড়ানো দরকার

গ্রামবাসীর সাহায্যে পড়াশোনা করা   ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম এখন বেপরোয়া

গ্রামবাসীর সাহায্যে পড়াশোনা করা ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম এখন বেপরোয়া

‘কালেমা পড়ে নে, তোকে এনকাউন্টার দেয়া হবে’ কুড়িগ্রামে মোবাইল কোর্ট….

‘কালেমা পড়ে নে, তোকে এনকাউন্টার দেয়া হবে’ কুড়িগ্রামে মোবাইল কোর্ট….

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj