সব
facebook apsnews24.com
ত্রাণ বাণিজ্য, ব্যক্তিবাদ ও করোনা আবেগ - APSNews24.Com

ত্রাণ বাণিজ্য, ব্যক্তিবাদ ও করোনা আবেগ

ত্রাণ বাণিজ্য, ব্যক্তিবাদ ও করোনা আবেগ

করোনা সংকটে বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও করুন অবস্থা বিরাজ করছে। নচিকেতা তার গানে বলেছিলেন ‘‘কসাই আর ডাক্তার একই তো নয় কিন্তু দুটোই আজ প্রফেশন। কসাই জবাই করে প্রকাশ্য দিবালোকে তোমার আছে ক্লিনিক আর চেম্বার ।” করোনা সংকটে আজ সেটি আরো একবার নির্মম সত্য আকারে প্রকাশ পেল । একটি সেবা খাত কিভাবে ব্যবসা হয়ে যায় এবং সেখানে সরকারের অনেক কিছু করার থাকলেও কিছু করা হয় না তার বড় প্রমাণ আমরা । সরকারী হাসপাতালে রোগী না দেখে সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারগণ ৩০০-১০০০ টাকায় শুধুমাত্র পরামর্শ ফি নিত। তখন তারা রোগীকে সুচিকিৎসা দেক বা না দেক রোগী হাসপাতালে , ক্লিনিকে বা চেম্বারে আসলো খুব খুশি হতো। রোগ ও রোগী তাদের কাছে পূজনীয় ছিলো। তাদের প্রত্যাহিক আয় কল্পনাতীত তা বুঝাই যাচ্ছে।

আরো মজার বিষয় হলো ওষুধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারের প্রত্যাহিক জীবনের প্রায় সকল দ্রব্যাদি সরবরাহ করে থাকে। এই অবস্থায় তাদের জীবনের আয় বেশী খরচ কম । এমন অবস্থায় তাদের অগাধ টাকার মালিক হওয়া স্বাভাবিক। এই টাকাই হয়ত তাদের মানসিকতা আর বিবেককে পশুর পর্যায়ে নিয়ে গেছে তা না হলে তারা এই করুন অবস্থায় হাত গুটিয়ে বসে থাকতো না । তারা চাইলেই যেমন নিজ অর্থায়নে অনেক কিছু করতে পারে । নিজ দ্বায়িত্বে কাজ করা শুধু মাত্র তাদের নৈতিকতা আর স্বদিচ্চার উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন গণচাদা তোলার মাধ্যমে নিজের তৈরী হ্যান্ড স্যনিটাইজার বিতরণ করে বেশ সাড়া ফেলে দেয় ।একাত্তর টিভি সহ আরো কয়েকটি চ্যানেল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমনিতেই বাম সংগঠন বলে ছাত্র ইউনিয়নের মিডিয়া কভারেজ কম তবুও কয়েকটি টিভি চ্যানেল তাদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করলে সারা দেশে তাদের কাজের জন্য আরো সাহায্য আসতে শুরু করে।

 গণচাদার টাকায় ছাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক জেলায় কাজ চালানোর চেষ্টা করছে। একটি সংকটময় মুহূর্তে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সবার আগে জরুরী । বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়ন দলবাজী , দালালবাজী বা চাদাবাজির সংগঠন নয় বলে তারা গণচাদায় তাদের সকল কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। ১৯৫২ সাল থেকে সকল সংকটময় মুহূর্তে তারা ছিলো এবং বর্তমানের করোনা পরিস্তিতিতেও তারা জনগণের সাহায্য নিয়ে জনগণকে সাহায্য করে চলছে এবং করবে। অনেক সংগঠন ও তাদের নেতাগণ নিজের টাকায় লোকজনকে সাহায্য করছেন বলে নানা গণ মাধ্যমে আসছে । একজন ছাত্র সংগঠনের নেতা বা কর্মী যার নিজের আয়ের কোন বৈধ কোন পথ নাই সে কিভাবে এতো টাকা দিয়ে নিজ অর্থায়নে সাহায্য সহযোগীতা করে বা করতে পারে । এরপরেও কথা থাকে এরা শুধু মাত্র ব্যক্তি প্রচারের জন্য নির্ধারিত ব্যাক্তি ও স্থানে সীমিত পরিসরে কাজটি করে তাদের নাম প্রচার করতে চায় ।হয়ত ১ ঘন্টা একটা ত্রাণ বা সাহায্য বা অন্য কোন কাজ করার জন্য তারা মাঠে নামে আর তাই মিডিয়া চলে যাবার পরে তাদের আর কোন কাজ করতে দেখা যায় না। এই কাজটি আরো ভয়ংকর ।

রাষ্ট্র ও সরকার তার কাজ করার জন্যই পদে বসে আছে । তারা এই কাজগুলো করবেই । এর জন্য তাদের আলাদা করে তো প্রচার প্রচরণার দরকার নাই । এটা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে । বিশেষ করে যখন একজন নাগরিক কে সাহায্য করে তার সেলফি তুলে মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যমে দেয়া হয় তা যেমন সে ব্যক্তির মানহানী করে তেমনি তা প্রকাশ করে ব্যক্তির সো অফ। এই কাজের জন্যই তারা মাসে মাসে বেতন পাচ্ছে ও এতো অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা আছে। এর জন্য আলাদা প্রচারণার প্রয়োজনীয়তা নেই। ব্যাক্তির সো অফ করা কাজ আরো বেশী ক্ষতিকর কাজ। আগে নিজের আয়ের বৈধ পথ সবার সামনে তুলে ধরুন তারপর সমাজ সেবক হোন। গরু মেরে জুতা দান করবেন। সেটা সমীচীন হতে পারে না। নিজের জন্য কাজ না করে দেশের জন্য কাজ করুন আর দেশের জন্য কাজ করতে না পারলে অনন্ত নিজের সংগঠনের সামর্থ্য অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করুন নিজেকে সো অফ করার জন্য লোক দেখানো কাজ করবেন না।আর সংগঠনের কাজকে সরকারের কাজের সাথে মিলাবেন না।

জনগণ রাষ্ট্রের মালিক আর এই মালিকের সেবক হয়ে সরকার কাজ করবে করতে বাধ্য ( সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৭ )। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে প্রতিবাদ না করে উপায় থাকে না। দেশী বিদেশী নানা এনজিও জনগণকে শিশুকে স্বান্তনা দিয়ে বুঝানোর মত তাদের সমস্যার সময় সমস্যার স্থায়ী সমাধান না করে বরং সমস্যাকে স্থায়ী করার জন্য যে ব্যাবস্থা গ্রহণ করা দরকার তা করতো। কিন্তু আজ এই এনজিও গুলোও কাজ করতে পারছে না। করোনা তো মালিক বা শ্রমিক দেখে ধরবে না তাই তারাও তাদের কাজ একরকম বন্ধ করে দিছে। এদিকে জনগণও কাজে বের হতে পারছে না।

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত দ্রব্যাদির মূল্য কমে যাচ্ছে কিন্তু উচ্চমূল্যে আবার বাজার থেকে অন্যান্য দ্রব্যাদি কিনতে হচ্ছে যাতে করে জনমনে আবার বিদ্রোহ দানা বাধতে শুরু করছে। জনগণকে যে মুলা ঝুলিয়ে এতোদিন দেীড়ানী দেয়া হয়েছে তা আজ করোনা সংকটে সংকটে পড়ে গেছে। জনগণ আজ দুর্নীতি, বা লুটপাট বুঝুক বা না বুঝুক দেশের উন্নয়ন স্বীকার করুক বা না করুক তাদের বসে থাকা চলবে না এটি বুঝতে শুরু করেছে। এতো কিছুর মাঝে শুধু নিজের প্রচারের জন্য কিছু সাহায্য এবং যতটুকু না সাহায্য করা হয়েছে তার চেয়ে বেশী প্রচার করা অনেকের কাছেই এখন দুংখ, ক্ষোভ আর রাগের কারন হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় সরকারকে জনগণের সেবক হিসেবে তার সেবা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের জনগণের প্রতি কাজগুলো সংগঠনের কাজ নয় ।এটা তার অবশ্যই করণীয় কাজ। তার সাংগঠনিক কাজগুলো সে অন্যভাবে করবে । সরকার হিসেবে কাজগুলো যেন সংগঠনের কাজ থেকে আলাদা করা যায়।

সংবিধানের ১১ নং ধারায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে আলোচানা করা হয়েছে। প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা এখানে বলা হয়েছে। যার মানে নির্বাচিত প্রতিনিধি বা সংসদ সদস্যগণ প্রশাসনের সকল কাজকে সম্বনয় করে কাজ করবেন। আর সেই কাজ অবশ্যই হবে জনগণের স্বার্থে আর তা যদি না হয় তাহলে তার সাংবিধানিক কোন ভিত্তি নাই । আর যার সাংবিধানিক ভিত্তি নাই তা আর কোন আইন দ্বারা বৈধ করা যায় না। সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের ২য় অংশে বলা হয়েছে ‘‘ জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’’ এটি হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্যতম মেীলিক দ্বায়িত্ব। অর্থ্যাৎ পরোক্ষভাবে জনগণকে শোষণের বিষয়টিও সংবিধানে স্বিকার করে নেয়া হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিককে বিশেষ ভাবে বুঝানো হয়েছে। সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের মেীলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে যে কথাগুলো বলা হয়েছে।উৎপদানশক্তির উন্নতি করা ।

আর এর জন্য একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা থাকবে। উৎপাদনশক্তির উন্নতি জীবনযাত্রার মানে বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত পরিবর্তন আনবে।এর থেকে যে বিষয়গুলো অর্জন করা যাবে ১. অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় , শিক্ষা ও চিকিৎসা ২. যুক্তিসংগত মজুরীর বিনিময়ে কর্ম ৩. যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশ ৪. সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার যেমন বেকারত্ব, ব্যাধি , এতিম, পঙ্গুত্ব, বৈধব্য ইত্যাদি। সংবিধানের ১১, ১৪ এবং ১৫ নং ধারায় সরকারের বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র লকডাউন করা নয় বরং আরো কিছু কাজের নির্দেশ করে । জনকল্যান মূলক রাষ্ট্র ও তার নির্বাচিত সরকার একটি বৃহৎ ধারনা। লকডাউনের মাধ্যমে জনগণের চলাচল সীমিত করা যাবে কিন্তু তাদের জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজনীয় তা তো নিশ্চিত করা যাবে না।

 করোনার হাত থেকে মানুষকে বাচাতে গিয়ে যদি খাদ্যের অভাবে মানুষ মারা যায় তা রাষ্ট্রের চরম ব্যার্থতা একটি রাষ্ট্রে এমনটি হতে পারে না বা হতে দেয়া যায় না। বাংলাদেশে যারা সরকারী কর্মচারীরা কাজ হোক বা না হোক বেতন পাবে । দেশের এই সংকটময় অবস্থায় যারা শ্রমজীবী মানুষ তারা বাইরে বের হতে না পারলে আয় করতে পারবে না আর আয় না করতে পারলে খাবে কি? তারা সব দিক থেকে সংকটে আছে এমন অবস্থায় জনগণের জন্য কিছু জনবান্ধব সেবা অবশ্যই নিতে হবে। এটি সরকারের সাংবিধানিক কাজের মধ্যে পড়ে যা সে বা দেশের জনগণ অস্বিকার করতে পারে। এই কাজকে সহজ করার জন্য ও অর্থায়নের জন্য কিছু কাজ করা যায় ।

যে উদ্যোগগুলো নেয়া এখন জরুরীঃ

১. তহবিল গঠন করতে হবে এবং তার তদারকির জন্য সৎ, সাহসী স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করতে হবে।নিজস্ব সংগঠন দিয়ে করানো যাবে না।

 ২. সব সরকারী চাকুরীজীবীর প্রতিমাসের অর্ধেক বেতন সংকট তহবিলে যাবে।

 ৩. বিদেশে পাচাকৃত টাকা যতটা সম্ভব পারা যায় দেশে আনতে হবে। এই টাকা সংকট তহবিলে যোগ হবে। যে সব কালো টাকা আছে সেগুলো জব্দ করে দেশের কাজে লাগানোর এটি উপযুক্ত সময়।

৪. স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত দ্রব্যগুলো প্রত্যেক জেলায় ছড়িয়ে দিতে হবে। কোন জেলায় কোন পণ্য আছে আর কোন পণ্য দরকার তার তালিকা করে এই কাজ করতে হবে।

৫. চিকিৎসকদের বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হবে এবং না দিলে তাদের বরখাস্তের বিধান করতে হবে। তারা অবৈধভাবে যে সম্পদ অর্জন করেছে তার বাজেয়াপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

৬. নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির নির্বাচিত হবার আগে ও পরের সম্পদ মিলিয়ে নিয়ে অবৈধ সম্পদ তহবিলে জমা করাতে হবে। লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি করেও যারা অবৈধ টাকা অর্জন করেছে তাদের ক্ষেত্রেও একই বিধান।

৭. যারা ভাড়া বাসায় থাকে বা নিজ বাসায় থাকে তাদের বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল সহ যেগুলো সরকারী খরচ তার সম্পূর্ণ মওকুফ করতে হবে। অন্যান্য খরচগুলো সর্বনিম্ন অর্ধেক বা ভুর্তুকি দিয়ে পুরোটা মওকুফের ব্যবস্থা করতে হবে।

৮. শিক্ষার্থীদের সিলেবাস বা প্রয়োজনীয় বই পিডিএফ করে সরবরাহ করা যেতে পারে। এই অবস্থার পর যেন সহজেই সকল কাজ ঠিকভাবে করা যায় তার প্রস্তুতিও রাখতে হবে। এই কাজগুলো মাধ্যমে আমরা আমাদের করোনা সংকটকে আরো শক্ত হস্তে মোকাবেলা করতে পারবো।

করোনা প্রতিরোধের জন্য আমরা যে ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করেছি শুধু তার মাঝে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশ জাতির জন্য খুব আন্তরিক ভাবেই উপরের কাজগুলো করতে হবে। এতে করে সরকার দেশ ও জাতির প্রতি তার সাংবিধানিক দায়-দায়িত্ব প্রকাশ করতে পারবে ।

লেখকঃ নূরুন্নবী সবুজ, আইন বিশ্লেষক ও কলামিষ্ট । সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, ইবি, কুষ্টিয়া

আপনার মতামত লিখুন :

শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তা বিধানে আইন ও বাস্তবতা

শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তা বিধানে আইন ও বাস্তবতা

আইন ও প্রচারণা স্বত্তেও কেন সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমছে না?

আইন ও প্রচারণা স্বত্তেও কেন সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমছে না?

মরু অঞ্চলে বৃষ্টি ও বন্যা, প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

মরু অঞ্চলে বৃষ্টি ও বন্যা, প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

স্বাধীনতা দিবসের ভাবনাগুলো

স্বাধীনতা দিবসের ভাবনাগুলো

১৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটা স্মরণীয় দিন

১৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটা স্মরণীয় দিন

সর্বনাশা পরকীয়া, কারণ ও প্রতিকার

সর্বনাশা পরকীয়া, কারণ ও প্রতিকার

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj