সব
facebook apsnews24.com
বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা আইনঃ সমস্যা ও প্রতিকার (পর্ব-১) - APSNews24.Com

বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা আইনঃ সমস্যা ও প্রতিকার (পর্ব-১)

বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা আইনঃ সমস্যা ও প্রতিকার (পর্ব-১)

মোঃ মাহবুবুর রহমান

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তনের পরেই ভূমি ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন নিয়ম-নীতি মোটামুটি প্রাতিষ্টানিক রূপ নিয়েছিল।যদিও তার পূর্বেও হিন্দু যুগে বিশেষত কৌটিল্য এবং মনু নির্ধারিত ভূমি ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন ছিল। তবে মুসলিম শাসন শুরুর পরপরই তা একটি মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে । বিশেষত মুঘল শাসক  শের শাহের আমলে (১৫৪০-৪৫) ভূমি ব্যবস্থাপনায় ব্যপক পরিবর্তন হয়।এর পরবর্তীতে সম্রাট আকবরের আমলে তার অর্থমন্ত্রী টোডার মাল ভূমি ব্যবস্থাপনায় ব্যপক পরিবর্তন আনেন । বিশেষত সার্ভে করার মাধ্যমে ভূমির প্রকৃতির উপর নির্ভর করে খাজনা নির্ধারণ তার একটি বড় পরিবর্তন ছিল। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে ভূমি ব্যবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে, এখনো হচ্ছে । তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে ভূমি ব্যবস্থাপনার মূলে ছিল খাজনা আদায় এবং সরকার বা শাসকের শাসনকার্যের ব্যয় নির্বাহ করা।  

ভূমি আইনের ইতিহাস ঘাটলে বুঝাই যায় সরকারের ব্যয় নির্বাহের উপায় হিসেবে খাজনা আদায়ের পরিমান বর্ধিত করতেই বিভিন্ন সময়ে ভূমি প্রশাসন-ব্যবস্থাপনায় সংস্কার করা হয়েছে। উল্লেখ্য , আমাদের এ অঞ্চল তথা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাতে  ১৭৬৫ সালের পূর্বে খাজনা বা ভূমি রাজস্ব আদায়ের পরিমান ছিল ৩১২ লক্ষ রুপি বা তার বেশি। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য অস্তমিত হওয়ার  কিছু বছর পরেই ইংরেজ শাসকদের ক্রিড়ানক নবাব শাহ আলম(২) তার বিদেশি প্রভূদেরকে খুশি করার জন্য এ অঞ্চলের ভূমি রাজস্ব ৩১২ লক্ষ থেকে কমিয়ে মাত্র ২৬ লক্ষ রুপিতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে দেওয়ানী দিয়ে দেন।

অতঃপর শুরু হলো ইংরেজদের অধীনে ভূমি ব্যবস্থাপনা । তাদের প্রণিত পাঁচশালা – দশশালা বন্দোবস্ত, ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সবই ছিল ভূমি রাজস্ব আদায়কে বর্ধিত করণের উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে । ইংরেজদের প্রায় দুইশত বছরের শাসনামলে তারা ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য অনেক আইনও প্রণয়ন করেছিল। তাদের প্রণয়নকৃত আইন সমূহের মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রেগুলেশন,১৭৯৩ ও বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন,১৮৮৫ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

আমরা জানিই যে , চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে জমিদারদের ম্যাগনা কার্টা বলা হতো। নির্দিষ্ট হারে খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে ইংরেজ শাসকগণ সাধারণ চাষীদেরকে মধ্যস্বত্বভোগী জমিদারদের প্রজায় পরিনত করে দেন। অন্যদিকে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের( ১৮৮৫) বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই আইনের ১০০ নং ধারা অনুযায়ী ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে নামে সার্ভে পরিচালনা করার মাধ্যমে প্রথম জমির মালিকানা ও দখলের প্রমাণ সংশ্লিষ্ঠ সি, এস খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত  ব্যবস্থার নানাবিধ সমস্যা থাকার কারণে ১৯৩৮ সালে এ ব্যবস্থার উপর রিপোর্ট পেশের জন্য ফ্রান্সিস ফ্লাডকে প্রধান করে ফ্লাড কমিশন গঠন করা হয়।যে কমিশন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করে এবং সুপারিশের আলোকেই আইন প্রণয়নের জন্য বিল পাশ করা হয় এবং নিখিল ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন প্রণিত হয় যার ৩ নং ধারার মাধ্যমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তথা জমিদারী প্রথা রদ করা হয় ।

পাকিস্তান আমলে অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন,১৯৪৯ নামে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন হয়েছিল। এই দুই আইনের মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ব্যপক রদ বদল করা হয়। বিশেষত রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে এস,এ খতিয়ান বা পর্চা প্রস্তুত করা হয়। এর পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে শত্রু সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হয় যা বর্তমানে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভূমি সংক্রান্ত বেশ কিছু আইন করা হয়। তার মধ্যে বাংলাদেশ পরিত্যাক্ত সম্পত্তি ( নিয়ন্ত্রন, ব্যবস্থাপনা এবং নিস্পত্তি) আদেশ , ১৯৭২, ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এবং স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল অধ্যাদেশ,১৯৮২ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সকল  আইন বাস্তবায়ন এবং ভুমি সংক্রান্ত বিষয়াদী নিস্পত্তির জন্য ভূমি মন্ত্রনালয় থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে ভূমি অফিস রয়েছে। গঠন করা হয়েছে অনেকগুলো বোর্ড, অধিদপ্তর এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ইত্যাদি। তবুও আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনেক গলদ রয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের কাছে যুগের দাবী অনুযায়ী সেবা পৌছে দেওয়ার জন্য যে ধরণের ব্যবস্থা দরকার তার অনেকাংশেই ঘাটতি রয়ে গেছে। রয়েছে অনেক সমস্যা।

ক্ষেত্রমতে ভূমি ব্যবস্থাপনা দূর্ণীতি ,অদক্ষতা, আস্থার অভাব ও সহজাত কিছু পদ্ধতিগত সমস্যায় জর্জরিত।২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি জার্নালে লেখা হয়েছে যে বিশ্ব ব্যাংকের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ৩২ লক্ষের অধিক ভূমি সংক্রান্ত মামলা বাংলাদেশের বিচারিক আদালতসমূহে ঝুলে আছে।যদিও মামলার নিস্পত্তির হার বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের সাথে জড়িত একটি বৃহৎ গোষ্ঠীর আইন-আদালতের আশ্রয় লাভের  কোন আর্থিক-সামাজিক সক্ষমতা নেই। এবং এ ধরণের বিরোধ প্রায়ঃশই মারামারি- ফৌজদারী অপরাধের কারণ হিসেবে পরিনত হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে , ৮০%  ফৌজদারী অপরাধ সমূহ ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ থেকে শুরু হয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশের ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় সমস্যা সমূহ নির্ধারণ এবং তার প্রতিকার করা খুবই প্রয়োজন।আমি এই লেখাটিতে বাংলাদেশে ভুমি ব্যবস্থাপনার মৌলিক সমস্যাসমূহ উল্লেখের পাশাপাশি  এগুলোর প্রতিকারে কিছু সুপারিশ করতে চাই।

মৌলিক সমস্যাসমূহঃ

১। মান্ধাতার আমলের ভূমি ব্যবস্থাপনাঃ

বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার অধিকাংশ বিষয় ব্রিটিশ আমলে পাশকৃত রেগুলেশনের উপর টিকে আছে।ব্রিটিশদের করা আইনগুলো অধিকাংশ ভূমি অফিসার, রাজস্ব কর্মকর্তা এবং সার্ভেয়ারদেরকে ক্ষমতা অর্পন করেছে যা দূর্ণীতির পথ উন্মোচন করেছে।এর পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ঘটনা পাওয়া যায় যেখানে এ সকল কর্মকর্তারা অসহায় ও সাধারণ নাগরিকদের সম্পত্তি নিজের নামে হস্তগত করে নিয়েছে। আবার বর্তমান যুগে এসেও অফিস আদালতের কার্যবিধির দীর্ঘসূত্রীতার কারনে জমিজমা সংক্রান্ত কাগজ-পত্র সহজলভ্য নয়। যদিও কিছুদিন আগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভূমি অফিসে নামজারীর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। 

২।দুর্ণীতিঃ

বাংলাদেশের ভূমি প্রশাসন মাত্রাতিরিক্ত  দূর্ণীতিগ্রস্থ। ২০১২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি) কর্তৃক প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ৫৪.৮% পরিবার বিভিন্ন ভূমি প্রশাসন থেকে সেবা নিতে যেয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন। সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১১ সালের মে মাস থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এ সকল  পরিবার যে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন টাকার অংকে তার পরিমান ২২৬১.২ কোটি টাকা।দেশের ১৬.৬% পরিবার ভূমি সংক্রান্ত প্রশাসন থেকে সেবা নিয়েছেন যাদের ৫৯% ই দূর্ণীতি ও হয়রানির স্বীকার হয়েছেন। আরো ভয়ংকর বিষয় হলো উক্ত সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের  ভূমি প্রশাসন তখন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় দূর্ণীতির দিক থেকে দ্বিতীয় নাম্বারে অবস্থান করছিল।        

৩। ত্রুটিযুক্ত খাস জমি ব্যবস্থাপনা ও বিলিবন্টন পদ্ধতিঃ

বিদ্যমান আইনে বিভিন্ন কারনে যে সকল জমি সরকারের হস্তগত হয়ে খাস জমি হিসেবে অর্পিত হয় এ সকল যায়গা-জমি বিলি বন্টনের ক্ষেত্রে দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ সকল জমি-জায়গা দরিদ্র- ভূমিহীন কৃষক পাচ্ছেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের কোন সুযোগ নেই। কারণ রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর ৭৬(২) নং ধারা অনুযায়ী এ বিলি-বন্টনের বিষয়ে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপনের কোন এখতিয়ার কাওকে দেওয়া হয়নি। যদিও SMS Samity Vs Bangladesh 39 DLR (AD) 85  মামলায় বলা হয়েছে অর্পিত সরকারী খাস জমি বিলি বন্টনের ক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই কিছু মানদন্ড, গাইড-লাইন মেনে চলতে হবে এবং ইচ্ছামত যা-তা করলেই হবে না। আবার এ সকল খাস জমির বরাদ্দ দরিদ্র কৃষকদের দিলেও তা স্থানীয় ক্ষমতাশীল ব্যক্তি বা ভূমি দস্যুরা যবরদখল করে নেয়।

( চলবে………)

লেখকঃ প্রভাষক, আইন বিভাগ, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

আপনার মতামত লিখুন :

৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, পাশ করেছেন ১১ হাজার ৭৩২

৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, পাশ করেছেন ১১ হাজার ৭৩২

দু:খের ঘরের সুখপাখিও চলে গেল ওপারে

দু:খের ঘরের সুখপাখিও চলে গেল ওপারে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জিয়া রহমানের ইন্তেকাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জিয়া রহমানের ইন্তেকাল

অবন্তিকার মায়ের আহাজারি-মেয়ে আমার বিচারক হতে চেয়েছিল

অবন্তিকার মায়ের আহাজারি-মেয়ে আমার বিচারক হতে চেয়েছিল

জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা, রাতভর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ

জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা, রাতভর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ

ঢাকা কলেজ’৯০ এর কমিটি গঠন: সভাপতি সজীব, সাধারণ সম্পাদক রুপন।

ঢাকা কলেজ’৯০ এর কমিটি গঠন: সভাপতি সজীব, সাধারণ সম্পাদক রুপন।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj