শিং মাছ
সাঈদ আজাদ
আমিনা কাচা কাপড় হাতে পুকুর ঘাট থেকে ফিরে অবাক। খলিল উঠানে জলচৌকিতে বসা। হাতে আয়না ধরে জবজবে তেলমাখা চুল আচঁড়াচ্ছে। আর ফুর্তির গলায় গান গাইছে। খলিলের পরনে গোলাপি রঙের পাঞ্জাবি। নতুনই। কবে কিনল পাঞ্জাবি! পায়ের জুতা জোড়াও যেন নতুন লাগে।
রশিতে কাপড় ঝুলিয়ে আমিনা বলে, পাঞ্জাবি কিনলেন কবে? জোতাজোড়াও লাগে নতুনই। কিনছেন?
তর যেমন কথা! না কিনলে পামু কই!
পাঞ্জাবিতে নয়া জামাইয়ের মত লাগে আপনেরে। চুলেরও দেহি বাহার খুলছে আজ। তা জামাই সাইজ্জা যান কই?
মাইয়্যা দেখতে।
মাইয়্যা দেখতে! কন কী। বিয়া করবেননি আবার!
আরে আমার লাইগ্যা মাইয়্যা দেখতে যামু নাকি। কাশেম চাচার পোলা মতি মাইয়্যা দেখতে যাইব। আমারে সাথে যাইতে কইল।
ও! আমি ভাবলাম আপনে আবার বিয়া করতে যান নাকি! আমিনা দাঁতে আচঁল কামড়ে হাসে। পায়ের কাছে ভিজা শাড়ির পাড় থেকে পানি ঝরে টপটপ।...যে সাজা সাজছেন! চুলেও মনে অয় কলপ দিছেন! বেশি বেশি কালা লাগে। দেইখ্যেন আবার আপনেরে না মাইয়্যার বাপ পছন্দ কইরা ফালায়। ...তা খাইয়্যা যাইবেন না?
না। দোপরের আগেই পৌঁছমু হেই বাড়ি। খাওয়ায় আয়োজন আছে। যাই আমি।
খানিক আগে শেষ হয়েছে রাতের খাওয়া। এঁটো হাঁড়ি বাসন চৌকির নিচে গুছিয়ে রাখে আমিনা। একটু পানিও ঢালে হাঁড়ি বাসনে। না হলে খাবারের লোভে ইঁদুর তেলাপোকায় ঘাটবে। সব ধোবে সকালে। ছেলেটা সন্ধ্যাবেলাই খেয়ে এখন ঘুমাচ্ছে। শীত চলে গেলেও বাতাসে হিম ভাবটা আছেই। ছেলের গায়ে একটা পাতলা কাঁথা জড়িয়ে দরজা টেনে দিয়ে, পান মুখে বের হয় আমিনা।
গামছা গায়ে উঠানে বসে সিগারেট টানছে খলিল। উঠানের কোণে লম্বা নারিকেল গাছ। বাতাসে নারিকেল গাছের পাতায় সড়সড় শব্দ । কদবেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জোছনা এসে পড়েছে উঠানে, খলিলের গায়ে, মুখে। খলিলের পাশে এসে বসে আমিনা। কী জোছনা দেখছেন! কেমন জানি মন খারাপ মন খারাপ লাগে!
পাগলের মত কথা। চাঁদের আলো দেখ্লে কারো মন খারাপ হয় জীবনে শুনি নাই। একটা পাটি লইয়্যা আয় ঘরত্থে। উঠানে কিছুক্ষণ শুইয়া থাকি।
বাতাসাটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা! সিগারেট শেষ কইরা ঘরে গিয়া শোন না।
কিছু হইত না। পাটি নিয়া আয়।
পাটি আর বালিশ এনে আমিনা উঠানে বিছায়। খলিল পাটিতে কাত হয়ে বলে, মাইয়্যাটারে দুইদিন দেখি না। মনে হয় কতদিন হইয়্যা গেল। বাড়িটা কেমন খালি খালি লাগে। কাইলকা গরুর হাট থাইক্যা ফিরার পথে নিয়া আসমু।
হ, লইয়্যা আইয়্যেন। মাইয়্যা হইল আপনের চোউখ্যোর মণি। তারে ছাড়া যে দুইদিন আছিলেন, এই না বেশি।... তা গরুডার দাম কেমন পাইবেন বইল্যা মনে হয়?
হাটে না নিয়া আগে থাইক্যা কই কী কইরা।
কুরবানিতো আইয়্যাই গেল। দুই বছর ধইরা গরুডা পাললাম। হাজার তিরিশেক দাম কি হইব না?
অমনত হওয়ার কথা। তাও বাজারে না নিলে...
গরু বেইচ্যা আমারে এক জোড়া সোনার কানের দুল কিন্যা দিবেন। কত দিনের শখ! আমিনা হাসতে হাসতে বলে।
এই বুড়া বয়সে আর দুল দিয়া কী করবি। টাকাটা থাকলে সংসারের কত কাজে লাগবো।
আপনে বুঝি ভাবছেন আমি সত্য সত্য দুল চাইছি। আমিনা ফের হাসে। সত্যইতো, সারাজীবন কাটাইলাম দুল ছাড়া... এই বয়সে আর... মাইয়্যাতো দেখতে দেখতে বড় হইয়্যা যাইব। অর লাইগ্যা না হয় কিন্যা আইন্যেন এক জোড়া দুল। মাইয়্যাটা খালি কানে ঘুইরা বেড়ায়। কত শখ কইরা কান ফোঁড়াইছিল।
সে দেখা যাউক। আগে গরুতো বেচি।...সারাদিন তর অনেক খাটুনি যায় আমিনা, না? একলা মানুষ। সাহাইয্য করার তো কেউ নাই।
হঁ, খাটতে খাটতে শরীল কেমন শুকাইয়্যা গেল! কেমনধারা কথা যে কন ! নিজের সংসারের লাইগ্যা খাটমু না!
খলিল আমিনার দিকে তাকায়। গাল দু‘টা শুকনা। হনু ভেসে উঠেছে। শরীরও ভেঙ্গে গেছে আমিনার।
কী দেখেন?
আসলেই আমিনা, তর শরীল শুকাইয়্যা গেছে।
বয়স হইছে না!
একজন কেউ থাকলে কাজেকামে একটু সুসার হয়। ...মাইয়্যাওতো ছোট। রান্নাবাড়া বাড়ি ঘর সামলানো হাঁস মুরগি গরুর খাওন- কাজতো আর কম না।
সংসারটাতো আমারই নাকি? আমি কাজ না করলে করব কে! ঘরে চলেনত। রাত বাড়তাছে।
আমিনা রাতের আঁধার শেষ হওয়ার আগেই উঠে গোসল করিয়েছে ষাঁড়টাকে। ভালমত গা মুছেছে। শিং দু‘টায় তেল ঘষেছে। গরম ফ্যান মেশানো খইল ভুসি খেয়ে নিম গাছের সাথে বাঁধা ষাঁড়টা দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করছে।
রাতের রান্না করা কড়কড়া ভাত ঝাল ঝাল চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা দিয়ে খেয়ে উঠে মুখে শিস দেওয়ার শব্দ করে খলিল। ভর্তাটায় ঝালটা একটু বেশিই ছিল!
তা সকাল সকালই রওয়ানা হয় খলিল। দেরী হয়ে গেলে আবার গরু বাঁধার খুঁটিটা পছন্দসই জায়গায় পাওয়া যায় না। শেষে বাজারের পেছনদিকে নিয়ে গরু বাঁধতে হবে। পেছন দিকটায় সব খদ্দের যেতে চায় না। গরুর দামটাও ঠিক পাওয়া যায় না। হয়তো দেখা যাবে শেষে ব্যাপারীর কাছেই দিতে হবে গরু। তাতে না হোক পাঁচ সাত হাজার টাকা লোকসান।
সাদা ষাঁড়টার গলায় কালো দড়ি বাঁধা। দড়ি ধরে ষাঁড়টাকে টানতে টানতে বাড়ি থেকে বের হয় খলিল।
পুকুরটা তিন শরিকের। মাঝারি। দু‘দিন লেগেছে সব পানি সেঁচে বাইরে ফেলতে। পানি পুকুরের তলানিতে এসে ঠেকলে কচুরিপানা আর ডালপালা পাড়ে তোলা হয়েছে। পুকুরটাতে চাষ করা হয়নি মাছ। শীতের সময় পানি সরে গেলে হয়তো কিছু মাছ আটকে থাকে। পুকুরের তলদেশে কী ডালপালায় আর কচুড়িপানার শিকড়ে বাকড়ে কিছু মাছতো বাস করেই। পানি সেঁচে সেসব মাছই ধরা হয়।
তীরে কাক দাঁড়কাক কুকুর লোকজন দাঁড়িয়ে। দেখছে পুকুরের পানি সেঁচা। পানি এখনো পুরোপুরি সেঁচা হয়নি। মাঝে মাঝে দু‘একজন ডানপিটে ছেলে পায়ে পায়ে পুকুরে নামার উপক্রম করলে কাদা ছুঁড়ে মারা হচ্ছে তাদের গায়ে। চিল কয়েকটা চক্কর দিচ্ছে আকাশে। মাঝে মাঝে বাতাসে পাড়ের মাদার গাছের পাতা ঝরে পড়ছে পুকুরের কাদায়।
নেই নেই করেও কিছু মাছ পাওয়া যায়। তেমন বলার মত কিছু নয় অবশ্য। তিনটা বোয়ালের বাচ্চা, কয়েকটা মাঝারি শোল। কিছু ছোট সাইজের কই শিং রয়না ফলি। কয়েকটা পোনা। কিছু সরপুঁটি। টাকি পুঁটি খলসে বাইম চিংড়ি এসব মিলে প্রায় এক ডুলা। তা এসব ধরতে ধরতেই প্রায় দুপুর হয়ে যায়।
পুকুরের মালিকরা চলে গেলে পাড়ে অপেক্ষমাণ ছেলের দল পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ ধরতে। কাদায় ওদের এক একজন প্রায় ডুবে যায় যায়। মাছ আর কই! কাদাতে মাখামাখি করে ভ‚ত হয় এক একজন। তবে মাছ ছিল কিছু কাদার ভেতরে। তেমন কিছু না, গুঁড়োগাড়া। একটা বেলে বা চুনোপুঁটি বা ছোট টাকি বা খলশে মাছ কেউ ধরছে, তাই নিয়ে হইচই। চিৎকার। উল্লাস।
এই নুরু, তর পায়ের কাছে দেখ, কেমন লড়াচড়া করে। বড় মাছ হইব। পলোটা ঐখানে ফালা। পুকুরের আরেক মাথা থেকে চাচাত ভাই মনির চিৎকার করে।
নুরু পেছন ফিরে ঝপাৎ করে পলো ফেলে। চারদিকে কাদা ছিটকে পড়ে। চারপাশের সবাই ফিরে তাকায়। নুরু একহাতে পলো চেপে ধরে অন্যহাত পলোর ভেতরে ঢুকায়। মনির ততক্ষণে দৌড়ে কাছে চলে আসে।
নুরু হাতড়ে হাতড়ে হাতের মুঠোয় চেপে বের করে আনে মাছটাকে। বিঘত সাইজের একটা টাকি। লেজ নাড়ছে। টাকিটা দেখে ছেলেরা সব হই হই করে উঠে। নুরু মাছসহ হাতটা উঁচু করতেই টাকিটা মুঠো ফসকে ঝাঁপ দিয়ে কাদায় পড়ে। কালো টাকিটা কালো কাদাতে হারিয়ে যায়। পরক্ষণেই অবশ্য সাপের মত এঁকেবেঁকে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। অমনি সব ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাদার উপর।
এই আমার মাছ কেউ নিবি না। টাকিটা আমি আগে ধরছি ।
নুরুর চিৎকারে অবশ্য কেউ পাত্তা দেয় না। মনিরও সবার সাথে ঝাঁপ দিয়েছিল। ভাগ্য বলতে হয়, মনিরই মাছটাকে চেপে ধরে। এবার আর দেরি করে না মনির, ডুলাতে মাছটাকে ফেলে উপরে দড়ির বানানো ফাঁসটা ভালমত আটকে দেয়।
ওদিকে দু‘জন কী নিয়ে যেন লাগে। একজন আরেকজনকে কাদা ছুঁড়ে মারে। একটু পর দেখা যায় সব ছেলেরা কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। এর মাঝেই কেউ কেউ ছোট দু‘একটা মাছ পায়। বাইম মাছ কী বেলে মাছ। পুঁটি বা কই মাছ। বা কিছু চিংড়ি। হাতড়াতে হাতড়াড়ে পুকুরের কাদাতে ছেলেরা গড়াগড়ি খায়। আবার উঠে দাঁড়ায়। একজন একটা ঢোঁড়া সাপ ধরে। সাপটার লেজ ধরে বনবন করে মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে সেটাকে তীরের কাছে ছুঁড়ে ফেলে। কোত্থেকে দু‘টা দাঁড়কাক এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাপটাকে ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যায়। একটু দূরে গাব গাছের ডালে গিয়ে বসে পায়ে চেপে ধরে নিষ্টুর ঠোঁটে সাপটাকে ছিঁড়ে খেতে শুরু করে।
নুরুর পায়ে কীসে যেন কামড় দেয়। তীব্র ব্যথা। পলো ফেলে দৌড়ে পাড়ে গিয়ে বসে। ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেকে রক্ত ঝরছে। কালো কাদার মাঝে লাল রক্ত দেখে ভয় পেয়ে যায় নুরু। ও মনির, আমারে মনে হয় সাপে কামড় দিছে! পায়ে ব্যথা করতাছে খুব।
মনির ডুলা হাতে দৌড়ে আসে। দেখে বলে, বেকুব। সাপে কি কামড় দেয়! পায়ে শিং মাছ কাঁটা ফুটাইছে। কাঁন্দিস না। কতক্ষণ পর ব্যথা যাইবগা।...কাঁটা ফুটাইল কেমনে, বুঝলি না?
কেমনে বুঝমু। কাদার ভিতরে লুকাইয়্যা আছিল।
বাড়িত যাইগ্যা তুই। ডুলা লইয়্যা যাইস। মাছ আমারে দেওন লাগব না।
বসন্তের বাতাসে পাতা ঝরছিল উঠানে মেলে দেয়া মরিচের উপর। লাল লাল মরিচগুলো প্রায় শুকিয়ে এসেছে। তা হলেও আরও দু‘তিন দিন লাগবে ভালমত শুকাতে। মরিচগুলোর উপর ঘুরে ঘুরে হেঁটে হেঁটে দু‘পায়ে উলোটপালোট করে দেয় আমিনা। ...হাঁসগুলোর বোধহয় খিদে পেয়েছে। প্যাকপ্যাক করতে করতে উঠানে এসে ঢুকে। লম্বা চ্যাপটা ঠোঁটে মরিচগুলোকে একটু নেড়েচড়ে দেখে। বুঝে যায় খাদ্য না। দৌড়ে গিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে। মালসায় পানিতে ভিজিয়ে রাখা চিটা ধান চড়চড় শব্দে খেতে থাকে।
আমিনা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকে। নুরুর বাপ যে কোন সময় গরুর হাট থেকে ফিরবে। এমনিতে ঠান্ডা ধাতের মানুষ। তবে ক্ষুধাটা সহ্য করতে পারে না। খাওয়ার দেরী হলে বাড়ি মাথায় তুলে।
নাড়ার আগুনে সহজেই আগুন জ্বলে। দু‘মুখো চুলার একপাশে ভাত আরেক পাশে ডিম সিদ্ধ বসায় আমিনা।
ও নুরুর মা, তোমার আজ রান্না কী? বলতে বলতে আম্বিয়া রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। আম্বিয়া নুরুর বাপের চাচী। ছেলে মেয়ে নেই। নুরুর চাচা বেঁচে থাকতে ভিটার একপাশে কবে একটা দোচালা তুলেছিল, এখন সেটা জীর্ণ হয়ে পড়ো পড়ো। তাতেই রাত কাটায় আম্বিয়া। প্রায়ই আমিনার কাছে ভাত তরকারি চেয়ে নিয়ে খায়।
চাচী ডিম রানমু আইজ। নুরুটা ডিম বড় পছন্দ করে।...ছোট কয়টা টাকি আছে জিয়ানো। মাষকলাইয়ের ডাইল বসামু। বলতে বলতে আমিনা চালের হাঁড়ি থেকে একহাতা ফুটন্ত চাল-পানি নিয়ে চুলার পাশে রাখা মাটির ঘটিতে রাখে।...বেশ কয়েকদিনের আধসেদ্ধ চাল-পানি জমছে ঘটিটাতে। পুরোপুরি ভরে উঠলে জাউ রাঁধা হবে। ‘কাঞ্জির’ জাউ। শুকনো মরিচ রসুন তেতুল বাটা ভর্তা দিয়ে কাঞ্জির জাউ নুরুর বাপের পছন্দ বড় পছন্দ।...বসেন না চাচী। পিঁড়ি এগিয়ে দেয় আমিনা।
ডিমতো গইন্যা গইন্যাই রাঁনবা তাইলে। কয়টা চাইল ফুটাইছিলাম, কিন্তু খামু কী দিয়া। ভাবলাম তোমার কাছে একটু তরকারি চাইয়্যা নিয়া যাই।...যাই তাইলে। কয়টা আলু আছে, দেখি সিদ্ধ কইরা ...
চাচী আইছেন যখন বসেন। নিয়া যান একটা ডিম । হইয়্যা আইলে একটু ডাইলও নিয়েন ।
দিলেতো তোমার ভাগেরটাই দিবা। থাক। আলু ভর্তা খারাপ কিছু না।
ডিমতো আমার ঘরের হাঁসেরই চাচী। টাকা দিয়াতো আর কিনি নাই। ভাইব্যেন না, ঘরে ডিম আছে। একটা না হয় ভাজমু আমার খাওয়ার লাইগ্যা।
তুমি আছ বইল্যাই বাঁইচ্যা আছি গো মা। পরতেক দিনইতো এইডা না ঐডা দেও। আম্বিয়া বসে ।
চাচী পরতেক দিনইতো কন এইসব। হাসে আমিনা। আইজ আর না-ই কইলেন।
কইত খালি তোমারে। ভাব বুঝি, সবাইরে কইয়্যা বেড়াই!
তাতো জানিই চাচী। কইলাম কথার কথা। রাগ করলেন?
নাগো মা, তোমার উপর রাগ করি কেমনে! মনডা যে বড় ভালা তোমার।...তোমার ভিটায় আইলে আমার মনডা ভালা হইয়্যা যায়। কেমন ঝকঝক তকতক করে চাইরপাশ। তা করারই কথা। সারাদিনত আছই বাড়ি ঘর সংসার নিয়া।...এই উঠান ঝাঁট দিতাছ, এই গরু হাঁস মুরগিরে খাওন দিতাছ, এই ধান সিদ্ধ করতাছ...একটু পরেই আবার রান্না ঘরে। দেখিত সব।
সংসারের কাজ ছাড়া আর কী-ই বা পারি চাচী! আর সংসারটাতো নিজেরঐ, নাকি? খাটলে গায়ে লাগে না।
তা তোমার মাইয়্যা কাজল কই। তারে যে দেখি না।
দুইদিন আগে আমার বড় বইন আবিদা আইছিল। আবিদা আপারেত চিনেনই। বাজারের কাছে বাড়ি করছে। যাওয়ার সময় আপা কাজলরে লইয়্যা গেছে লগে।...তা নুরুর বাপতো কইছিল, হাট থাইক্যা ফিরার পথে মাইয়্যারে নিয়া আইবো।...ঐ বোধহয় নুরুর বাপ ফিরল। কার লগে জানি কথা কয়! ডিমের সালুন নামিয়ে আমিনা বাইরে এসে দাঁড়ায়।
মাঝ উঠানে দাঁড়িয়ে খলিল। পরনে গোলাপি পাঞ্জাবি, পায়ে নতুন জুতা, মাথায় লাল টুপি। সাথে লাল শাড়ি পরা লম্বা ঘোমটায় মুখ ঢেকে কে দাঁড়িয়ে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে বোঝা যায়, মেয়েটার বয়স অল্প।
খলিল আমিনাকে দেখে। কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমিনা। শুকনা গাল হনু উঁচু মুখে কালি, মাথার চুল যেন পাটের আঁশ।
আম্বিয়াও উঠানে এসে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা পলকেই বুঝে যায় আম্বিয়া। কী করলিরে রে খলিল! আর্ত চিৎকার বের হয়ে আসে তার মুখ থেকে।
পায়ে ভালই ব্যথা করছে। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে নুরু। কুকুরটা এতক্ষণ পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন মনিবের পিছে পিছে হাঁটা ধরে। পলোটা নুরুর কাঁধে। ডুলাটা বা হাতে। হাঁটতে হাঁটতে ব্যথাটা যেন ভুলে যায় ও। অল্প হলেও মাছ কিছু পাওয়া গেছে। মনির নেয়নি কিছু। বাড়ি গিয়ে মাকে বলবে মরিচ বাটা দিয়ে লাল লাল করে রেঁধে দেওয়ার জন্য। ক্ষুধা যা লেগেছে না, এক গামলা ভাতেও পেট ভরবে না!
সাবধানে ধান ক্ষেতের আল ধরে হাঁটে নুরু। আলে শুকনা কচুরিপানার মাঝে শামুক ভাঙ্গা। মরা কাঁকড়ার দাড়া। যেতে যেতে এক জায়গায় সাপের খোলসও দেখে নুরু, বাতাসে নড়ছে। ভয়ে ভয়ে পা ফেলে। মাথার উপর রোদ বড্ড কড়া। রোদ মাথায় নিয়েই ধান ক্ষেত নিড়াচ্ছে কামলরা। ধানের কাঁচা শিষ বাতাসে দুলছে।
মা। ওমা... মা। বাড়ি ঢুকেই চিৎকার করে নুরু। দেখ, কত মাছ ধইরা লইয়্যা আইছি।
আমিনা চুপচাপ বসে আছে মাটিতে। উঠানের এক কোণে নিমগাছটার তলে। নিশ্চল। এত যে ডাকল নুরু, ফিরে তাকাল না। যেন শুনতেই পায়নি। নুরু অবাক। কাছে গিয়ে ডাকলে চোখ তুলে তাকায় আমিনা। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে দূরের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে, আমি গেলেগা ছোট বইনটারে দেখিস।
তুমি কই যাইবা! ফিরবা কবে?
ফিরমু না! এই সংসারটা আর আমার নাই।
বলতে বলতে আমিনা উঠে দাঁড়ায়। নুরুর চোখের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির নামায় নেমে যায়। কুকুরটা আমিনার পিছে পিছে যায় একটু, আবার ফিরে আসে।
নুরু কী করবে বুঝতে পারে না। মায় কি বাবার লগে রাগ কইরা কোনখানে যাইতাছে? কই, আগেতো কখনো এমন করে নাই মায়। ঝগড়াতো হইছে কতই। বাবার লগে কতদিন রাগারাগি করেছে মায়। ভাত না খাইয়্যা থাকছে। শেষে বাবায় সাধাসাধি কইরা খাওয়াইছে ভাত। বাবায়ই বা কই!...পেছন ফিরে বাপকে ডাকতে গিয়ে নুরু দেখে, তার বাপ লাল শাড়ি পরা ঘোমটায় মুখ ঢাকা কাকে নিয়ে ঘরে ঢুকছে। বাপের পরনে নতুন পাঞ্জাবি, মাথায় লাল টুপি।... নুরুর বয়স বার হলেও কেন জানি নুরুর মনে হয়, মা আর ফিরবে না!
বাতাসে নিমগাছটার পাতা ঝরে পড়ে নুরুর মাথায়। গায়ে। মা-ই যেন আদর করে নুরুকে। আমিনা লাগিয়েছিল গাছটা।...পায়ে ব্যথাটা আবার জানান দিচ্ছে। নিচু হয়ে দেখে নুরু, রক্ত ঝরে ঝরে আঙ্গুলটা কেমন লাল হয়ে আছে। কালো কাদায় লাল রক্ত! শিং মাছটা ছিল কাদার ভেতরে লুকিয়ে। কীভাবে যে নুরুর পায়ের তলে পড়ল! ব্যথাটা যাচ্ছেই না।
লেখকঃ কথা সাহিত্যিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও ঔপনাসিক