রেস জুডিকাটা (The Doctrine of Res Judicata, দোবারাদোষ, পূর্বনির্ণীত):
দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮(১৯০৮ সালের ৫ নং আইন) এর ১১ধারায় Res judicata সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এটি ল্যাটিন পরিভাষা। Res Judicata শব্দটির Latin – ‘Matter judged’ or ‘Matter already decided’ অর্থাৎ, Decision has already been taken.
Res Judicata শব্দটির ‘Res’ অর্থ ‘বিষয়’, ‘Judicata ‘ অর্থ ‘ইতিমধ্যেই নিষ্পত্তি’ হয়েছে। সুতরাং, রেস জুডিকাটা অর্থ যে বিষয় ইতিমধ্যেই নিষ্পত্তি হয়েছে।
এর আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘the thing what has been judged” বা যে বিষয়টি মীমাংসিত। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতি যা সকল দেশের আইন ব্যবস্থায় স্বীকৃত। অর্থাৎ যে বিষয়ে পূর্বতন কোন সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে সেই বিষয়ে একই পক্ষদ্বয়ের মাঝে নতুন কোন দাবী নিয়ে একই অথবা ভিন্ন আদালতে মামলা করা যাবেনা। এই নীতি এক দিকে মামলার পক্ষগণ; বাদীপক্ষকে নতুন কোন দাবি দাখিল করতে বারিত করে এবং বিবাদীকে নতুন করে ডিফেন্স নেওয়ার সুযোগ থেকে বারিত করে, অন্যদিকে বিচারক কে এমন বিষয়ে মামলা গ্রহণে বারিত করে যে বিষয়ে অন্য কোন কোর্ট একই পক্ষগণ এর মাঝে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে।
একজন বিবাদী এটিকে ডিফেন্স হিসেবে নিতে পারেন। একজন বাদী যখন কোন বিবাদীর বিরুদ্ধে আদালতের মাধ্যমে কোন রায় পায়, সেক্ষেত্রে ওই বিবাদীর বিরুদ্ধে আর কোন অভিযোগ উত্থাপন করা যায়না নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলে:
(ক) দাবিটি যদি পূর্বের মামলার কজ অব একশনের সাথে সম্পর্কিত হয়
(খ) বাদী যদি পূর্বের রায়ের ভিন্ন কোন প্রতিকার চায় অথবা পুনরায় প্রতিকার চায়
(গ) দাবিটি যদি এমন হয় যে এটি পূর্বতন অভিযোগের সাথে যুক্ত করা যেত।
রোমান সূত্র :
Res Judicata মতবাদটি দুটি রোমান সূত্রের উপর নির্ভরশীল। যথা :
(১) একই মোকদ্দমায় কাউকে দুবার উত্যক্ত করা যাবে না এবং
(২) রাষ্ট্রের স্বার্থেই মোকদ্দমা সমাপ্ত হওয়া উচিত।
১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১১ ধারায় রেস জুডিকাটা এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। উক্ত ধারায় উল্লিখিত রয়েছে যে, কোন আদালত এমন কোন মামলা বা বিচার্য বিষয়ে বিচার করবেন না, যা সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে পূর্ববর্তী কোন মামলায় একই পক্ষগণ অথবা তাদের স্থলবর্তীদের মধ্যে বিচারের চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং পূর্বের মামলাটি এমন একটি আদালত কর্তৃক বিচারে নিষ্পত্তি হয়েছে যে, আদালত পরবর্তী মামলাটিও বিচার করতে এখতিয়ার সম্পন্ন।
রেস জুডিকাটার উপাদান ও(/বা) শর্তাবলী ( Elements and(/or) Conditions Constituting Res Judicata) :
দেওয়ানি কার্যবিধির ১১ ধারা বিশ্লেষণ করলে নিম্নরূপ উপাদান ও(/বা) শর্তাবলী পরিলক্ষিত হয়-
১. বিচার্য বিষয়ের অভিন্নতা ( Indemnity of matter in issue)
২. পক্ষসমূহের অভিন্নতা ( Indemnity of matter in parties)
৩. মামলা একই স্বত্বাধীন হবে ( Litigation under the same title)
৪. আদালতের বিচারকের যোগ্যতা ( Competence of the Court)
৫. চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ( Final Decision)
রেস জুডিকাটার উদ্দেশ্য (Objectives of Res Judicata) :
This doctrine is based on three maxims which are as follows-
১. Nemo debt bis vexari pro una et eadem causa which means no man should be vexed twice for the same cause ( একজন ব্যক্তিকে Same cause of action / same case এর জন্য দুইবার বিরক্ত করা যাবে না) ;
২. Interest reipublicae ut sit finis litium – which means it is in the interest of the State there should be an end to a litigation ( State এর স্বার্থে litigation must be end) ; and
৩. Res judicata pro veritate occipitur- which means judicial accepted as correct (Court এর রায় সঠিক মেনে নিতে হবে)
উদাহরণ :
জনৈক আমেনা ও রহিমের মধ্যে একখণ্ড জমির স্বত্ব নিয়ে মামলা চলছে। রহিমের বক্তব্য সে ঐ জমি তার পিতা করিমের নিকট হতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়ে তাতে দখলদার ছিল। অতঃপর আমেনা অন্যায় ও বে-আইনীভাবে তাকে ঐ জমি হতে বেদখল করেছে। কিন্তু আমেনার বক্তব্য সে ঐ জমি রহিমের পিতা করিমের নিকট হতে কবলা মূল্যে খরিদ করে দখল করেছে।
অবশেষে রহিম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করল। তার বক্তব্য তার পিতা আমেনার বরাবরে ঐ জমির বাবদ কোন কবলা সম্পাদন করে দেয় নাই। সুতরাং আমেনা ঐ জমি বিষয়ে কোন কবলা দাখিল করলে তা জাল দলিল বলে গণ্য হবে। কিন্তু বিচার্যকালে আমেনা আসল দলিল হারিয়ে গিয়েছে এই মর্মে এর জাবেদা নকল দাখিল করে মামলা চালিয়ে গেল। অতঃপর বিচারে আদালত আমেনার কবলা খরিদের সত্যতা বিষয়ে সন্দিহান হয়ে মামলা রহিমের পক্ষে ডিক্রী দিলেন। ডিক্রীর কিছুদিন পর আমেনা মারা গেল। অতঃপর আমেনার পুত্র জয় আসল কবলা দলিলটি খুঁজে পেল এবং আসল দলিলের বলে পুনরায় রহিমের বিরুদ্ধে পূর্বে হেরে যাওয়া মামলার জন্য স্বত্ব সাব্যস্তে খাস দখলের মামলা দায়ের করলো।
এই অবস্থায় জয়ের পূর্বের মামলাটি ‘Res Judicata’ দোষে অচল বলে গণ্য হবে। কারণ পূর্বের মামলায় কবলা দলিল মূলে দাবীর ভূমিতে আমেনার কোন স্বত্ব হয়েছিল কিনা এটিই মূলতঃ প্রত্যক্ষ ও সরাসরিভাবে বিচার্য বিষয় ছিল এবং বিচারে এই প্রশ্নটি আমেনার বিপক্ষে নিষ্পত্তি হয়েছিল। পরবর্তী মামলায় পুত্র জয়ের দাবীর সূত্র এবং পূর্ববর্তী মামলার আমেনার দাবীর সূত্র এক বিধায় পরের মামলাটি ‘Res Judicata’ দোষজনিত কারণে চলবে না।
রেস জুডিকাটা বা বিচারককৃত বিষয়ের মতবাদটি (নীতি) দেওয়ানি কার্যবিধির ১১ ধারার বিধান অনুসারে নিম্নোক্ত পাঁচটি বিশেষ শর্তের উপর নির্ভরশীল :
(ক) উভয় মামলার বিষয়বস্তু ও কজ অব একশন একই হতে হবে;
(খ) উভয় মামলার পক্ষগণ একই হতে হবে;
(গ) পূর্বতন মামলার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতে হবে;
(ঘ) মামলার পক্ষগণকে যথেষ্ট সময় ও শুনানির সুযোগ দিতে হবে;
(ঙ) উভয় মামলায় পক্ষগণ এর পদবী একই হতে হবে। অন্যথায় রেস জুডিকাটা এর সুবিধা গ্রহণ করা যাবেনা। পক্ষগণ এর পদবী বলতে পূর্বতন মামলায় যদি কোন ব্যক্তি মালিক হিসেবে মামলা করে কিন্তু পরবর্তী মামলায় মালিকের এজেন্ট হিসেবে মামলা করে তখন অপর পক্ষ রেস জুডিকাটা এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে মামলা করা যাবে।
Res Subjudice (The Doctrine of Res Subjudice, মামলা স্থগিতকরণ, বিচারাধীন, বিচারাপেক্ষ) :
দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮(১৯০৮ সালের ৫ নং আইন) এর ১১ধারায় Res Subjudice সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এটি ল্যাটিন পরিভাষা। Res Subjudice শব্দটির Latin – ‘Under Judgement’ অর্থাৎ, The case is already under process.
ল্যাটিন শব্দ ‘Res’ অর্থ ‘বিষয়’ আর ‘Subjudice’ অর্থ ‘বিবেচনাধীন’। সুতরাং রেস সাব-জুডিস অর্থ হলো আদালতে বিবেচনাধীন কোন বিষয়।
দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮ সালের ১০ধারায় রেস সাব-জুডিস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। উক্ত ধারার বিধান মতে রেস সাব-জুডিস হচ্ছে “কোন আদালত এমন কোন মোকদ্দমার বিচার চালানো যাবে না,যার বিচার্য বিষয়বস্তু প্রত্যক্ষ এবং মূলত পূর্বে দায়েরকৃত অপর একটি মোকদ্দমার বিচার্য বিষয়,তাহা একই পক্ষগণের মধ্যে অথবা এমন পক্ষগণের মধ্যে যাহাদের অধীনে তাহার বা তাহাদের মধ্যে কোন একজনের সূত্রে পরবর্তী মোকদ্দমার পক্ষগণ বা পক্ষগণের মধ্যে কোন একজন স্বত্ব দাবি করেন,যেখানে এরুপ মোকদ্দমা একই অথবা বাংলাদেশের অন্য কোন আদালতে বিচারাধীন আছে, যে আদালতের প্রার্থীত প্রতিকার মন্জুর করার এখতিয়ার আছে,অথবা বাংলদেশের বাহিরে সরকার কতৃক প্রতিষ্টিত বা চলিত কোন আদালত যাহার এরুপ এখতিয়ার আছে অথবা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন কোন মোকদ্দমা।
ব্যাখ্যা ঃকোন বিদেশি আদালতে দায়েরকৃত মোকদ্দমা যদি বাংলদেশের কোন আদালতে দায়েরকৃত মোকদ্দমার সহিত একই কারন যুক্ত হয় তবু ও বাংলদেশের আদালতে উক্ত মোকদ্দমার বিচারে বাধা হবে না।
এ ধারার মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে একই এখতিয়ার সম্পন্ন দুটি আদালতে একই বিষয় বস্তুর জন্যে উপস্হাপিত মোকদ্দমা দুটিকে সমান্তরাল ভাবে যুগপৎ বিচার করা হতে বিরত রাখা।
উল্লেখ্য যে দেওয়ানী কার্যবিধির ১০ধারা কোন মোকদ্দমা করতে নিষেধ করেনি বরং দাখিলকৃত মোকদ্দমার বিচার চালিয়ে যাবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
অতএব এক্ষেত্র আদালত দ্বিতীয় মোকদ্দমাটি স্হগিত রাখতে আইনত বাধ্য।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে উপসংহারে আমরা বলতে পারি যে, “কোন বিরোধের দুইবার বিচার হবে না” – এই চিরন্তর বিধিটি রেস জুডিকাটা মতবাদের মধ্য দিয়ে স্পষ্টরূপে মূর্তমান হয়ে উঠেছে।
যখন কোন মামলা কোন কোর্ট বিচারাধীন থাকে তখন সেই বিষয়ে অন্য কোন কোর্ট আর মামলা নেবে না। তবে এই নিয়মে পড়তে হলে নিচের বিষয়গুলি ঠিক রাখতে হবে :
(১) পূর্ববর্তী এবং নতুন মামলায় সকল পক্ষ একই হতে হবে।
(২) পূর্ববর্তী এবং নতুন মামলায় শিরোনাম/বিষয়বস্তু একই হতে হবে।
(৩) পূর্ববর্তী কোর্টকে যথাযোগ্য হতে হবে।
উদাহরণ :
রেস-সাবজুডিস এর উদাহরণ হচ্ছে খালেক এবং হায়দার দুই প্রতিবেশী। হায়দার তার মালিকানাধীন জমি দখলের অভিযোগে খালেককে অভিযুক্ত করে আদালতে আরজি দাখিলের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে। আদালত বিলম্ব করেছে এই মনোভাবে সে অপর আরেকটি আদালতে মামলা দায়ের করে। পরের মামলা এবং আগের দায়েরকৃত মামলার বিষয়বস্তু একই হওয়ার কারণে আদালত পরে দায়েরকৃত মামলা বিচারকার্য স্থগিত করবেন। কেননা উক্ত বিষয়ে অপর একটি আদালতে মামলা বিচারাধীন আছে।
রেস জুডিকাটা ও রেস সাব জুডিস এর মধ্যে পার্থক্য :
দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮ এর ১০ ধারায় রেস সাব জুডিস নীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অপরদিকে উক্ত আইনের ১১ ধারায় রেস জুডিকাটার কথা বলা হয়েছে।
রেস জুডিকাটা নীতি নিষ্পত্তিকৃত মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে, রেস সাব জুডিস নীতি চলমান মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
রেস জুডিকাটা নীতি অনুযায়ী পূর্বে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তিকৃত মামলার যে ইস্যু ছিল সেই একই ইস্যু নিয়ে পুনরায় একই পক্ষের মধ্যে আর কোন মামলা দায়ের করা যাবে না। অন্যদিকে রেস সাব জুডিস নীতি অনুযায়ী পূর্বে দায়েরকৃত মামলা চলমান থাকলে একই পক্ষ ও একই ইস্যু নিয়ে নতুন মামলা করা যাবে না।
রেস সাব জুডিস নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে এখতিয়ারভুক্ত দুইটি আদালতকে একই বিষয়বস্তুর জন্য উপস্থাপিত দুইটি সমান্তরাল মামলার যুগপৎ বিচার করা হইতে বিরত রাখা। রেস জুডিকাটা নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে মামলার চূড়ান্ত ফলাফলকে অক্ষুণ রাখা।
সাক্ষ্য আইনের স্টপেল বা প্রতিবন্ধকতা নীতি হইতে রেস জুডিকাটা নীতির উদ্ভব। অন্যদিকে, অযাচিত মামলার পুনরাবৃত্তি রোধ করে আদালতের সময় অপচয় রক্ষা করতেই মূলত এই নীতিটি গ্রহণ করা হয়েছে।
রেস জুডিকাটা নীতি অনুযায়ী পূর্বে দায়েরকৃত মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে। রেস সাব জুডিস নীতি অনুযায়ী চলমান মামলাটি বহাল থাকবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, রেস জুডিকাটা দ্বৈত বিচারে প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে । অপরদিকে, রেস সাব জুডিস মামলার দ্বৈততাকে প্রতিহত করে।
খন্দকার সুমাইয়া লামিসা হক স্রোতস্বিনী
সেশন : ২০১৭-১৮
বিভাগ : আইন ও ভূমি প্রশাসন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়