সময়ের পরিক্রময়া আমাদের মাঝে হিজরী নববর্ষ। আজ পহেলা মহররম-১৪৪২। হিজরী সনের প্রথম মাস মহররম আর ১লা মহররম হলো হিজরী সনের প্রথম দিন। হৃদয়ের সকল ভালোবাসা আর উষ্ণতা দিয়ে স্বাগত জানাবো হিজরী সনের নতুন বছরকে। হিজরী নববর্ষ মুসলিম জাতির এক অনন্যোজ্জ্বল গৌরবগাঁথা ও ইতিহাসের দিন। নিজেদের অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে নব চেতনায় উদ্দীপ্ত করতে হিজরী নববর্ষ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সকল আচার অনুষ্ঠান ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধান বা ইবাদত এই হিজরী তারিখের উপর নির্ভরশীল। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যেমন- রোজা ও হজ্ব পালন করতে হয় হিজরী তারিখ তথা চাঁদের হিসেবের উপর। তাছাড়াও দুই ঈদ, মিলাদুন্নবী (সাঃ) লাইলাতুল কদর, লাইলাতুল বরাত বা নিছফ মিনাশ শাবান, লাইলাতুল মিরাজ, আশুরা সহ ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরী সনের উপর নির্ভরশীল। তাই ইসলামে এ দিনটি সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য এক বিশেষ স্মারক।
চাঁদের হিসেবে সমস্ত ইবাদত বন্দেগীর প্রচলন হযরত আদম (আঃ) এর সময় থেকে প্রচলিত ছিল। কিন্তু হিজরী বর্ষ বা সন গণনার প্রবর্তন হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর খেলাফতের চতুর্থ বছর (৬৩৮ খিৃষ্টাব্দ) থেকে। তখন তিনি অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা ছিলেন। রাষ্ট্রীয় কাজে চিঠি-পত্র ও বিভিন্ন দলিলাদি আদান প্রদানে সনের উল্লেখ না থাকায় সমস্যা দেখা দিলে তৎকালীন ইরাক ও কুফার গভর্ণর হযরত আবু মুছা আশআরি (রাঃ) অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর খেদমতে বিষয়টি নিবেদন করেন। তিনি হযরত উসমান জিন্নুরাইন (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) সহ বিশিষ্ট সাহাবী বর্গদের নিয়ে পরামর্শ সাপেক্ষে হিজরী সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রিয় নবী (সাঃ) ও তাঁর প্রিয় সাহাবায়ে কেরামগণের হিজরতের মাস মহররমকে হিজরী সনের প্রথম মাস নির্ধারণ করে হিজরী সন গণনা শুরু করেন। এই মহররম একটি অতিব গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ মাস। এই মাসকে ’শাহরুল্লাহ’ বা আল্লাহর মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পবিত্র কোরানে যে চারটি বিশেষ মাসের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মহররম মাস। (সূরা তওবাহ-৩৬ নং আয়াত দ্রষ্টব্য)।
মুসলিম ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল মাস হলো এই মহররম মাস। অথচ মুসলিম জাতি আজ এই মাসের শিক্ষা থেকে অনেক দূরে। এমনকি হিজরী সনের কথা আমরা খেয়ালও রাখিনা বা রাখার প্রয়োজন অনুভব করিনা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিয়ে যদি বাংলাদেশের কথা বলি তাহলে দেখা যায় এই বিশেষ দিনটিকে ঘিরে দেশে তেমন কোন কর্মসূচী থাকেনা। দেশের দৈনিক পত্রিকা গুলো বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেনা। অনলাইন মিডিয়া কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতেও এ সংক্রান্ত কোন উদ্যোগ থাকেনা। অথচ এই বাংলাদেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ১২০৪ খিৃষ্টাব্দ থেকে সর্বক্ষেত্রে হিজরী সনের প্রচলণ শুরু হয় যা প্রায় ৫৫০ বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ছিল।
পরে ১৭৯০ সালে হতে এ উপমহাদেশে খৃষ্টীয় সালের প্রচলণ হয় যা আমরা এখনো অন্ধের মতো পালন করছি। আমরা আমাদের অতীত ঐতিহ্যের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ইসলামের সংস্কৃতি ও গৌরবগাঁথাকে দূরে ঠেলে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে লালন করছি যুগের পর যুগ। খিৃষ্টীয় সালকে নিজেদের সংস্কৃতির অনুসঙ্গ বানিয়ে থার্টি ফাস্ট নাইট নামক এক বেলাল্লাপনার আসর জমে যায় বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবী জুড়ে। অমুসলিম দেশগুলোতে তারা তাদের নিজস্ব ধাঁচে বা ঢংয়ে যে কোন উৎসব পালন করুক কিন্তু মুসলমান হয়ে কিভাবে আমরা তা অন্ধ অনুকরণ করে যুগ-যুগান্তর লালন করি!
একদিকে খিৃষ্টীয় নববর্ষ আবার অন্যদিকে বাংলা নববর্ষের নামেও আমাদের দেশে ১ বৈশাখে বিভিন্ন জীব জন্তুর মুখোশ পড়া সহ বিজাতীয় সংস্কৃতির এক মহড়া হয়ে যায় যা মোটেও মুসলিম সংস্কৃতি কিংবা বাঙ্গালী সংস্কৃতির অংশ নয়। বাংলাদেশে প্রচলিত তিনটি সনের মধ্যে হিজরী সনই হচ্ছে সর্ব প্রাচীন সন অথচ তা পালনে আমাদের কোন আয়োজন নেই। আমাদের চেতনায় হিজরী সনের গুরুত্বের লেশ মাত্র নেই, এটি বড় দুঃখজনক। বাংলা সনকে বাংলাদেশের মুসলমানরা বিজাতীয় সংস্কৃতির রূপে এবং ঢংয়ে পালন করেন কেননা আমরা অনেকেই জানিনা বাংলা সনের ইতিহাস। বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এটি উৎপত্তিগত দিক থেকে ইসলামের উত্তরাধিকার প্রাপ্ত। বাদশা আকবরের আমলে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতেহুল্লাহ সিরাজী হিজরী সনকে গবেষণা করে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সেদিক থেকে বিবেচনা করলেও বাংলা সন উদযাপনে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুকরণ করার কোন সুযোগ নেই। অথচ আমরা সকলে আমাদের দ্বীনি ও দেশীয় সংস্কৃতি ভুলে বিজাতীয় সংস্কৃতির উদ্দামতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। অপরদিকে যারা মুসলমানদের এই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন করে দেশে সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চালু করতঃ বিজাতীয় সংস্কৃতির নগ্ন থাবা থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা চালায় তাদের কথা আমাদের প্রিন্ট মিডিয়া বলেন আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলেন কেউ প্রচার করেননা অপরদিকে থার্টি ফাস্ট নাইট বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনে মিডিয়াগুলো থাকে ব্যতিব্যাস্ত।
আসুন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হিজরতের প্রেক্ষাপটকে স্মরনার্থে হিজরী নববর্ষ পালন করে আগামী প্রজন্মের কাছে ইসলামের ইতিহাস তথা সংস্কৃতিকে তুলে ধরি। মহান আল্লাহর দ্বীনের প্রচারে প্রিয় নবী (সাঃ) এবং তাঁর প্রিয় সহচরবৃন্দ কীভাবে মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে তৎকালীন ইয়াসরীবে (বর্তমান মদিনা শরীফ) হিজরত করেন তার মহান শিক্ষা ও তাৎপর্য নিহিত রয়েছে এই হিজরী নববর্ষ পালনের মধ্যে। হিজরী সন আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় প্রিয় নবী (সাঃ) সেই সাহাবী সুহায়ব (রাঃ) এর ত্যাগের কথা- যিনি কাফেরদের হাতে বন্দি হয়ে অনেক নির্যাতন সহ্য করার পর নিজের সর্বস্ব কাফেরদেরকে দিয়ে আপন মাতৃভূমির মায়াকে তুচ্ছ করে প্রিয়নবীর নির্দেশকে শিরোধার্য্য করে মদীনায় হিজরত করেন।
মনে করিয়ে দেয় উম্মে সালমা ও তাঁর স্বামীর কথা- যার সন্তান কাফিররা ছিনিয়ে নেয়ার পরও তাঁর স্বামী একাকী মদীনায় হিজরত করেন। ইসলামের তরে জাগতিক সকল মায়াকে তুচ্ছ করার এক প্রকষ্ট ও জ্বলন্ত উদাহরণ এই হিজরী নববর্ষ। তাই সময় এসেছে সম্মিলিত ভাবে হিজরী নববর্ষ পালন করে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা এবং ইসলামি সংস্কৃতির বলয়ে নিজেদেরকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। বিদায় হোক পুরাতন বছরের জীর্ণতা, অপূর্ণতা আর অসঙ্গতি। নতুন প্রত্যাশার ভেলায় চড়ে আসুক নতুন বছর, জেগে উঠুক সবাই নতুন উদ্দীপনায়। সত্য আর সুন্দরে ভাস্বর হয়ে উঠুক মানবতার ক্যানভাস। একজন বাঙ্গালী হিসেবে এই প্রত্যাশায় সকলের প্রতি হিজরী নববর্ষের অকৃত্রিম শুভেচ্ছা।
লেখক- কামিল (আল হাদিস) মাস্টার্স (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।