জাতীয় শোক দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
শোকাবহ আগস্ট মাস। ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত সেনা। প্রতি বছর বাঙালি জাতি দিনটি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকে। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সংবিধান ও মূল সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা- এই বিষয়গুলো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। তারই পথপরিক্রমায় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির পৃথকীকরণ (Separation of Judicial magistracy) করা হয়। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ১২ বছর বা ১ যুগ পার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট দিনটি বিচারক তথা বিচার বিভাগের জন্যও অতীব শোকের ও অত্যন্ত বেদনার। শোকের মাসে তথা জাতীয় শোক দিবসে বিচারক হিসেবে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অতীব জরুরি। একটি দেশ ও জাতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকারের তিনটি অঙ্গ- শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে দেশকে এগিয়ে নিতে হয়। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র তা-ই করে। যদিও অন্যান্য বিভাগের ওপর শাসন বিভাগের আধিপত্য ব্রিটিশ আমল থেকে সুস্পষ্ট এবং সর্বজনবিদিত, যেটি আইনের শাসন বৃহৎ অর্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কোনোদিনই কাম্য নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৫৪ বছর বয়সের জীবনে মোট ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন। এবং আজীবন রাজনীতি ও শোষিতের পক্ষে কথা বলায় বারবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে। হয়রানিমূলক মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়েছেন। ফলে তাঁকে আদালতে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে নিয়মিতভাবে। তিনি ব্রিটিশ আমলের বিচার ব্যবস্থা ও পাকিস্তান আমলের বিচার ব্যবস্থা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন। অন্যায়ভাবে মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। সে কারণে তিনি প্রতিটি পদক্ষেপে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়লে যে হয়রানি হয় তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সবসময় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। সেই সংবিধানেই বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুগান্তকারী চেতনা ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারি এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার প্রতিফলন, যা প্রত্যক্ষ করা যায় গণপরিষদে রাখা বক্তব্যে যেটি হুবহু তুলে ধরছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিনে গণপরিষদে দৃঢ়ভাবে বলেন, “আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে; আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।”
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে জাতির পিতা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা তাঁর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক মিটিং-সমাবেশের ভাষণে প্রত্যক্ষ করা যায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে ১৯৭২ সালের পর বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ হতে পৃথকীকরণের (Separation of Power) উদ্যোগ গ্রহণ করেন। হারুন-অর-রশিদ, মূলধারার রাজনীতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০১৬, পুনর্মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃষ্ঠা ৪৩। এই বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন এবং সেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাস্তবায়নের ফলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের স্থলে নতুন নাম পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়। শুধু তাই নয়, নতুন গঠনতন্ত্রে গৃহীত নীতি ও উদ্দেশ্য অংশে উল্লেখ করা হয়, ‘বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা এবং স্বল্প ব্যয়ে দ্রুত ন্যায়বিচার প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা।’ তাহলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করার বিষয়টি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল বলেই দলের গঠনতন্ত্রের নীতির অংশ হিসেবে স্থান পায়। তাছাড়া পাকিস্তান গণপরিষদ, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বক্তৃতায় দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেন যে, “Sir, while supporting the amendment that Judiciary be separated from the Executive, I submit that as you are already aware, people are not getting justice, because the Executive is controlling the Judiciary. We see that even in petty cases the Judiciary is sometimes influenced by the Executive to pass their verdict in their favour. I cannot understand why the Government side should refuse to accept the amendment of Mr. Abul Mansur Ahmad… Therefore, in order to do justice to the people, Judiciary must be separated from the Executive.”
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারির “দৈনিক বাংলা” পত্রিকার ০৬ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় তাঁর দেওয়া বক্তৃতার একাংশ, যেখানে তিনি ঘোষণা করেন “আমি হাইকোর্ট ও অধস্তন আদালতগুলো যাতে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমি এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত করতে চাই যে, দুর্নীতি ও কালক্ষেপণ উচ্ছেদ করার প্রেক্ষিতে বিচার ব্যবস্থার কতকগুলো মৌলিক ত্রুটি সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নীতি সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করা হবে।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণ (দ্বিতীয় খণ্ড), একাত্তর প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১১, পরিমার্জিত একাত্তর প্রথম প্রকাশ আগস্ট ২০১৮, পৃষ্ঠা ১৪৭ এবং পৃষ্ঠা ১৪৮ বইয়ে ড. এ এইচ খান (সম্পাদক) এ উল্লেখ করেন, ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ব্যাপারে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধন করতে যান এবং প্রধান অতিথির বক্তৃতায় পুনরায় ব্যক্ত করেন যে, “আপনারা যখন বলেন, আমরাও তখন বলেছি এবং আমরা এটা বিশ্বাস করি যে, জুডিসিয়ারি সেপারেট হবে এক্সিকিউটিভ থেকে।” জাতির পিতা আরও বলেন, “আপনাদের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। কেউ কোনোদিন হস্তক্ষেপ করবে না আপনাদের অধিকারের উপর। সে সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন এবং যতটা তাড়াতাড়ি হয় আমরা চেষ্টা করব যাতে জুডিসিয়ারি সেপারেটভাবে কাজ করতে পারে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বিচার বিভাগকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের বিধান সম্পর্কে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ২২-এ পরিষ্কার বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।”
অন্যদিকে আরেকটি বিষয় না বললে নয়, সংবিধানের ১১৬ নং অনুচ্ছেদে যেমন বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষ বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ও ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। অর্থাৎ সংবিধানের বিধান মতে বিচার বিভাগের কর্মকর্তাগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন।” ষষ্ঠ ভাগের ২য় পরিচ্ছেদে আরো সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অধস্তন আদালতের বিচারবিভাগীয় কর্মচারীগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন যা সংবিধানের ১১৬ক এই বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যদি কোনো রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তবে বিচারকার্যে নানা রকমের জটিলতার সৃষ্টি হয় ও ন্যায়বিচার প্রলম্বিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিয়ে দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সরকারের ঐকান্তিক আন্তরিকতা এবং বর্তমান সরকার ও তার আইনমন্ত্রী সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কনসেপ্টটিতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর।
যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন তার বাস্তবায়নের পথক্রম ততটা মসৃণ নয় যতটা হওয়ার কথা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতির জনকের সময়ে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের বাস্তব রূপদান করেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফেরানোর সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত নন পার্টি কেয়ারটেকার সরকার। মূলত সংবিধানের ২২ নং অনুচ্ছেদের মূল বক্তব্য ধরেই বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের যুগান্তকারী রায় হিসাবে মাসদার হোসেন কেসে বারবার আলোচনায় স্থান পায় এবং স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আপন গতিতে ফেরানোর পরিক্রমা তৎকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে প্রকৃতপক্ষে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ হতে পৃথক (Separation of Power) করা হয়। ঐ সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী, যা দেশের বিচারাঙ্গনসহ সকল স্তরের মানুষ সাধুবাদ জানায়।
বিচার বিভাগ স্বাধীনকরণের উদ্দেশ্যে ২০০৭-২০০৮ সালে বেশ কিছু আইন সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়ন করা হয় যেখানে ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লেখিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন। যেমন-বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা ২০০৭, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে স্কেল-২০১৬ ইত্যাদি। এছাড়া অধস্তন আদালতসমূহের শৃঙ্খলা বিধানসহ একটি আলাদা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। সবচেয়ে যুগান্তকারী সংশোধনী আনা হয় ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এ। এই আইনের ০৬ ধারায় দুই প্রকারের ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সৃষ্টি করা হয়। এক পক্ষে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যপক্ষে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭-১৪৮ ধারা, ১৭৬ ধারাসহ আরো কিছু ধারা যেমন: ২৯ (বি) ধারায় কার্যক্রম পরিচালনা ও দণ্ড প্রদানের ক্ষমতাসহ মোবাইল কোর্ট ২০০৯-এর অধীনে বাংলাদেশে প্রচলিত ১১৯ (২০১৯ পর্যন্ত) টি আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ১২ বছর পার হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের ইতিবাচক মনোভাব ও নিরলস চেষ্টায় জনগণ ইতোমধ্যে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুফল টের পাচ্ছে। যার ফলে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং হচ্ছে যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়, তবে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন শক্তিশালী ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সেদিক বিবেচনায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে আইনের ব্যাখ্যা দান ও বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচারকদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাকে বোঝায়। তবে এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলে রাখা দরকার, বিচারকদের এ ধরনের স্বাধীনতা অর্থ কোনোভাবে তাদের অবাধ কিংবা যা খুশি তাই করার ক্ষমতাকে বোঝায় না। বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পাশাপাশি আমাদের সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিচারকদের দায় বহুলাংশে বেড়ে গেছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের জন্যে বিচারকদের হতে হবে আপসহীন ও বিবেকবান।
বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা শুধু স্বাধীন বিচার বিভাগের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ (Separation of Power) হওয়ার কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী ধাপ অতিক্রম করেছে মাত্র। বিচার বিভাগের নিকট থেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়ে যে সকল উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে তার মধ্যে অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হলো বিচারকদের সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত মানসিকতা। বিচারকগণ যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংকল্পে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে তবে পরিবর্তন আসবে তাতে সন্দেহ নেই এবং সত্যিকার অর্থে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে বিচার বিভাগের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়ন হতে বাকি থাকবে না।
সর্বোপরি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সকল সরকার, রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদদের একই প্লাটফর্মে দাঁড়ানো উচিত, না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়বিচারের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন এভাবে- “যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।”
জনগণের আশা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সর্বদা আপসহীন থাকবেন এবং বিচার প্রশাসনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goal) অর্জনে কাজ করে যাবেন।
লেখক: কলামিস্ট ও লেখক এবং বিচারক, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস।