কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে গাজীপুরের বিশিয়া কুড়িবাড়ী বৃদ্ধাশ্রমের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে আসরের আযান দিয়ে দিয়েছে, সকালে বৃষ্টি হয়ে যাওয়াতে পথে কিছুটা পানি জমে গেছে সেখানে দল বেঁধে শালিক পাখিরা গোসল করছে,খুবই মনোরম দৃশ্য সাথে রাস্তার দুধারে বিরাট জায়গা জুড়ে সবুজ ঘন বন যা শুরুতেই যেকোন দর্শনার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করাতে বাধ্য করবে। আমি,আমার স্বামী আর একজন ওখানকার লোক(গাইড করার জন্য) হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর যেতেই সামনে পেলাম বৃদ্ধদের জন্য নির্মিত ৪ তলা চিকিৎসা কেন্দ্র।
এখানে প্রায় প্রতিদিন ই ২/৩ জন মারা যায়। হাসপাতালটির প্রতিটা তলায় অনেকজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা লাঠিভর দিয়ে বিষন্ন চেহারায় বসে আছেন। রাস্তার আরেকপাশে তিনজন বৃদ্ধ নিজেদের খাবার থেকে কিছু অংশ কুকুরকে ছিড়ে খাওয়াচ্ছেন তার থেকে একটু দূরে লাঠি ভর দিয়ে খুবই দুঃখী চেহারার একজন একনিষ্ঠ মনে মাটির দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছেন উনাদের কে সালাম দিয়ে সামনে এগোলাম। গাজীপুরের বিশাল এরিয়া জুড়ে এই আশ্রমটি গড়ে তোলা হয়েছে। মাদার তেরেসার পদধূলি পড়েছিলো এই আশ্রমটিতে,তাঁর ছবি দেখলাম ওখানকার ম্যানেজারের রুমে। বাইরে থেকে দেখলে জায়গাটিতে ঘন বন জঙ্গল ছাড়া কিছু থাকতে পারে বলে মনেই হবেনা।
আরেকটু গিয়ে দেখলাম আরো কয়েকজন বৃদ্ধ বিশ্রাম কেন্দ্রে বসে আছে চুপচাপ নিরিবিলি! হাঁটতে হাঁটতে দেখা হল একজন বৃদ্ধর সাথে তবে অন্যদের মত বিষন্ন চেহারা তাঁর নয়,খুব গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলে মনে হল কথা শুনে, আমাদের সাথে থাকা ছেলেটাকে বললো বাড়ি কোথায়? আরো কিছু বলে উনি একটা পুকুরের পাড় ধরে ফলবান সব পেঁপে গাছগুলো দেখতে দেখতে চোখের আড়াল হয়ে গেলেন এর মধ্যে ঐ ছেলেটার মাধ্যমে জানতে পারলাম উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক,এখন এখানে একটা স্কুল এ বাচ্চাদেরকে ইংরেজি পড়ান,আরেক জনকে দেখালো উনিও ঢাবির শিক্ষক ছিলেনএবার আমরা মহিলাদের আশ্রমে গেলাম সামনেই পড়লো অতিথিশালা এখানে নাকি কিছুদিন পরপর নির্মাতারা শুটিং করতে আসতেন, যাহোক এবার খুব ইচ্ছে ছিলো বৃদ্ধাদের কাছে যাব কিন্তু ও নিষেধ করলো তবে একটু দূর থেকে সালাম দিলাম,উনারা খুব আন্তরিকতার সাথে কথা বললেন,একজন তো কাছে টেনে নেয় নেয় ভাব, অনেক বয়স্ক তিনি।
অনেকে দেখি নামাজঘর থেকে আসরের নামাজ পড়ে বের হচ্ছেন,অনেকে একসাথে বসে গল্প করছেন, কেউ আবার ট্যাব থেকে বোতলে করে পানি নিচ্ছেন। আমাদের গাইডদেয়া ছেলেটি বললো, এখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের মাও আছেন! তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো,আরেকটু সামনে গিয়ে দেখলাম কাফন আর খাঁটিয়া পড়ে আছে আজও হয়ত কেউ মারা গেছেন! দূরথেকে কবরস্থানগুলো দেখলাম। বিভিন্ন ধর্মের মানুষেদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্থান করা হয়েছে । স্বজনদের ছাড়াই সবার শেষ যাত্রা সম্পন্ন হচ্ছে! কি নির্মম ! যাদের জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করলো বেলাশেষে তারাই অনুপস্থিত!
বৃদ্ধাশ্রমের ভিতরের চারদিকে মাল্টা,আঙ্গুর,পেয়ারা,মরিচ,পেঁপে সহ বিভিন্নরকম গাছ ফলে পরিপূর্ণ, ফলগুলো পেঁকে পেঁকে পড়ছে,আমাদেরকে তাঁদের খাবার পাউরুটি উপহার হিসেবে দেয়া হল অফিস থেকে, সাথে পেয়ারাও খেয়েছি। এখানে যাতায়াতের রাস্তাগুলো স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছে এর কারণ হিসেবে মনে হলো বৃদ্ধরা খুব বেশি হাঁটাচলা করতে পারেননা তাছাড়া অনেকদিন করোনার কারনে তেমন দর্শনার্থী ও যায়না মনে হয়। আমি এখানে একটা বিষয় খেয়াল করলাম প্রায় ২০০/৩০০ জন বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে দেখেছি দুএকজন ব্যতিত সকলের চেহারায়-ই ভীষণ একাকীত্বতা, বিষন্নতায় ছেয়ে আছে ! এখানে তাদের দেখাশোনার জন্য হয়ত অনেক মানুষজন আছে কিন্তু সেই প্রিয় আপনজনেরাই নাই,নাই কোন আনন্দের বাহক নাতিপুতি, এখানে আছে শুধু একরাশ যন্ত্রণা, শেষযাত্রার জন্য অপেক্ষা মাত্র !
Morzina Khatun