আত্মহত্যাকে সামাজিক ব্যাধি না বললেও মানসিক ব্যাধি বলা যায়। অনেকেই তাৎক্ষাণিক উত্তেজনায় ভুল সিদ্দান্ত নেয় আবার অনেকে পরিকল্পনা করেও আত্মহত্যা করে।আমাদের গল্পটি নিছক আত্মহত্যার উপর নয় এর সাথে জড়িয়ে আছে সমাজ সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
দু‘জন যুবক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক: সাহস করে গ্রামে আসে কিন্তু তাদের সে ফিরে আসা তাদের জীবনে কি দেয়। তারা তাদের শিক্ষা কি তাদের সাফল্যের পথে আনতে পারবে। নাকি আত্মহত্যা করে আত্মত্যাগী হবে।
আবার গ্রামে একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ছেলে বুড়ো, মেয়ে বৃদ্ধা, সাদা কালো সবাই আত্মহত্যার মত ঘৃণিত পথকে পরম আদরে আপন করছে কিন্তু কেন? ধর্ষণ, প্রেম, হতাশা, অর্থ নাকি এগুলো কোন গুপ্ত ঘাতক ঘটনাটি ঘটাচ্ছে সেটিই গল্পের বিষয়।
এটি নিছক কোন গল্প নয় এর সাথে বাস্তবতা আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে আছে। কিস্তি আদায় করতে করতে গোয়েন্দা হওয়াকে আপনাকেও বিমোহিত করবে।
১ম পর্ব।
মাঠে কাজ করতে যাচ্ছে এক দল যুবক। তাদের ঘাড়ে গামছা। হাটতে হাটতে তারা একটি জমির আইলের উপর এসে দাড়ালো ও একজন একটি বিড়ি লাগিয়ে অন্যদের দিলো। একজন বিড়ি টানতে টানতে তার কাধের গামছা কোমড়ে বাধছে । এর মাঝে মিলন বললো
বানেচ মিয়ার সুন্দরী মেয়েটা রাতে ফাস নিলো। এই নিয়ে কারো দুংখ নাই, মানুষ মৃত্যুর শোক করতেও ভুলে যাচ্ছে।
রহমান তখন তার না চেয়েই জমিতে নামতে নামেতে বললো,
আশেপাশে প্রতি মাসে যদি এমন দু একজন করে লোক আত্মহত্যা করে তাহলে মানুষের শোক করার আবেগও নষ্ট হয়। জীবনের কষ্টের কাছে মৃত্যুর শোক স্বাভাবিক হয়।
মিলন ততখনে তার হাতে ধরা বিড়ি শেষ করেছে তবুও শেষ টান দিয়ে বিড়িটা মাটিতে ফেলে দেয় ও কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে।
মানুষ নিজেকে বাচাতে বাচাতে সত্য লুকাতে গিয়ে একদিন নিজেই মারা পড়ে।
২য় পর্ব।
লাশ বহন করছে চার জন। সাধারণত লাশের সাথে সাথে অনেক লোক যায় কিন্তু এখানে মৃতের আত্মীয় স্বজন ছাড়া কেউ নেই। হয়ত সবাই বিষয়টাকে মেীলক বা অন্য কিছু ধরে নিয়েছে। তবুও কথার পিটে কথা আসার মত বা ঘটনা দেখে কথা আসে মানুষের, অবচেতন ভাবে গবেষণা মত আলোচনা আসে নানা জনের।
রাস্তার ধারে দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো মিলন আর রহমান। তাদের পাশে আরো একজন লোক বসে ছিলো।
ঘটনা দেখে মিলন বলে উঠলো, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুই আমি একসাথে স্বাতক করার পর, একসাথে মাঠে কাজ করছি। বিশ্বাস ছিলো কৃষিতে যুক্ত হওয়া জীবনে ভুল সিদ্ধান্ত হবে না।
হ্যা তোর কথায় আমিও ভরসা করে গ্রামের ছেলে নাড়ীর টানে গ্রামে আসলাম কিন্তু এখন তো নিজের অবস্থান এতোই খারাপ যে পড়াশুনা করেছি বলতেই লজ্জা লাগে।
তাদের থেকে সামান্য দূরেই বসে ছিলো একজন যুবক। তাকে ইদানিং নানা জায়গায় দেখা যাচ্ছে। গ্রামের দোকান বাজার সহ নানা জায়গায় সে যায়। গ্রামের লোকজনের নজরে বিষয়টি এখনো আসেনি। আর যারা মৃত্যুতে শোকাহত হয় না তাদের অন্যকিছুতে আহত করা বেশ মুসকিল। তাই তার বিষয়টি কেউ গুরুত্ব দেয়নি।
মিলন আর রহমানের কথা চলতেই থাকে আর অচেনা লোকটি তার পকেট থেকে সিগারেট বের করে লাগিয়ে টানেতে থাকে ও তাদের কথা শুনতে থাকে। দোকনদার তাকেও এককাপ চা দেয়। চায়ে চুমুক দেবার পাশাপাশি সে সিগারেট টানতে থাকে।
৩য় পর্ব
গ্রামে রাস্তা ধরে সাইকেল চালিয় যাচ্ছে একজন। একটি বড় দালানকোটার সামনে আসেতই শুনতে পায় কান্নার আওয়াজ। কান্নার আওয়াজ শুনে সে বুঝতে পারে আবার কেউ মারা গেছে। লোকটি কিস্তি আদায় করতে যাচ্ছিলো। তার হাফ-হাতা শার্ট আর ঢিলেঢালা প্যান্টটির সাইকেলের সাথে মানিয়েছে বেশ। এই লোকটিই দোকনের সে লোক নাম বাহার। সাইকেল থামিয়ে ঘটনাটি একটু বোঝার চেষ্টা করে একটু পরেই সে আবার সাইকেল চালিয় গেল। সাইকেল চালিয়ে সে তার গন্তব্যে পেীছানোর পর সেখানে সাইকেল রেখে টাকা আদায় করতে শুর করলো।
টাকা আদায় করতে গিয়ে সে দেখলো নুরুন নাহার নামে একজন নাই। অন্যদের জিঞ্জেস করতে উত্তর এলো সে আত্মহত্যা করেছে। আর যে বড় ভবনের ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছিলো সেটি নুরুন্নাহরের বলে জানতে পারে।
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সে ফিরতে থাকে। প্রতিষ্ঠানের চাপ আছে কেউ টাকা না দিলে তার বাসায় যেতে হবে। অগ্যতা তাকে সে মৃত পরিবারের বাড়িতে যেতে হবে এখন, একটি শোকহত পরিবারে গিয়ে সে কি বলবে বুঝে পায় না। তবুও নিয়ম রক্ষার করার জন্য হলেও সে মানবিকতার দোহাই বাদ দিয়ে সে বাড়িতে যাবে কিনা ভাবছে।
৪র্থ পর্ব
রাস্তার পাশের সে বড় বাড়িতে সাইকেল চালিয়ে বাহার এসে থামলো। সে বেল বাজালো ভেতর থেকে একজনের গলা ভেসে আসলো‘
কে ভিতরে আসেন’।
বাহার তখন ভেতরে গেল।বাড়ির বাইরে তেমন কেউ ছিলো না। সে ঘরের ভেতর টিভির শব্দ শুনতে পেল। কোন নাটক চলছে হয়ত। সে অবাক হয়ে গেল যেখানে সদ্য একজন আত্মহত্যা করেছে সেখানে কেমন করে কেউ নাটক দেখছে। বাইরে যে লোকটি বসে ছিলো সে ছিলো আত্মহত্যকারীর বাবা। সে লোকটিকে বললো,
আপনাকে তো চিনলাম না। আপনি কে?
আমি বাহার। কিস্তি আদায় করতে এসেছি।
আপনার কিস্তি কত আর কত টাকা বাকী আছে ?
বাহার তখনতার খাতা পত্র বের করে টাকা পয়সার হিসেব দিলো। তাকে টাকা পয়সা সব কিছু বুঝিয়ে দিলো তার বাবা। তারপর তার সাথে তার কিছুক্ষণ কথা বার্তা চলতে থাকে। কখনো হেসে কখনো কাদো কাদো অবস্থায় কথাগুলো বলতে থাকে তার বাবা। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে সে।
৫ম পর্ব
রাতে বাহারের ঘুম হয় না তেমন । তার কানে শুধু কান্নার শব্দ ভাসতে থাকে। সে সারারাত ছটপট করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে যায়। তারপর আবার সকাল হয় আবার রাত আসে এভাবে তার চিন্তাও কাজ বাড়তে থাকে। সে এখন আর তার কিস্তি আদায়ের ঘরে কিস্তি আদায় করে না বরং সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে তার কিস্তি আদায় করে । সে সবাইকে বলে দিয়েছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিস্তি আদায় করবে।
তার চেতন ও অবচেতন মনে কেন আত্মহত্যাগুলো হচ্ছে তার রহস্য বের করার প্রতি এক বিশেষ আগ্রহ তৈরী হয়েছে। সে তাই টাকা তোলার কাজে গিয়ে সবার সাথে আলাপ জমায় ও তার কাজ করতে থাকে। পাশাপাশি তার সময়ে অসময়ে তথ্য সংগ্রহ করাও চলতে থাকে। কাজ ও বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার আসার ফলে তার একটি মেয়ের সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠে। তারপর একসময় কথায় কথায় টান বেড়ে প্রেমে পরিণত হয় তা।
নিয়মিত মোবাইলে কথাও হয় তাদের।
বাহার তার মোবাইলে কথা বলছে।
তোমার কি কখন আত্মহত্যা করতে মন চায়।?
মোবাইলের ওপাশ থেকে উত্তর আসছে,
আত্মহত্যা করতে চাওয়া প্রত্যেক মানুষের অন্যান্য স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মত একটি প্রবৃত্তি। মরতে কে না চায় তবে খেয়াল রাখতে হবে তাকে বাচিয়ে রাখার মত কিছু বিদ্যমান কিছু আছে কিনা?
বাহার পাল্টা প্রশ্ন করে তোমাদের এলাকায় এতো আত্মহত্যার ঘটনার কারন কি?
মহিলা কন্ঠে উত্তর ভেসে আসে,
আমার এক বান্ধবির আত্মহত্যার ইতিহাস শুনলে তোমার বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে।
তাদের কথা এগুতে থাকে। হয়ত একথা কিছু সময় পর শেষ হবে কিন্তু আত্মহত্যা নিয়ে যে জট তার কি মুক্তি হবে, বাহার কি পারবে তার সমাধান করতে।
বাহার মেয়েটির কাছ থেকে চাচ্ছে তথ্য আর মেয়েটি তার কাছ থেকে প্রেম, টাকা না অন্য কিছু চাচ্ছে তা এখনো আমাদের কাছে পরিস্বকার না। তবে যাই হোক আত্মহত্যার প্ররোচনা অপরাধ হলে আত্মহত্যার প্ররোচানাকারীর বিরুদ্ধে কত জনেই মামলা করে। মানুষ একি সংগে মরতে চায় আবার বাচতে চায় কোন চাওয়া কখন পুরণ হবে তাও বলা মুসকিল।
৬ষ্ঠ পর্ব
বাহার রাতে বের হয় তার তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। তার হাতে একটি লাঠি। সে নিজের নিরাপত্তার জন্য চাকু বা তরবারীও মাঝে মাঝে রাখে। সত্যি বলতে সে সাহসী হলেও ভিতু। বাড়ির পিছন দিয়ে হাটতে হাটতে সে একটি বাড়িতে কিছু কথা শুনতে পায়। কান পেতে শুনার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে তাই কথা বুঝতে পারা মুসকিল হয়ে যাচ্ছে। তবুও সে গভীর মনযোগের সাথে কথা শুনার চেষ্টা করে। অনেক কষ্ট করে সে একটি শব্দ শুনতে পারে,
যদি জানাজানি হয়ে যায় বেচে থাকার আর উপায় থাকবে না।
দরজা খোলার শব্দ হলে বাহার সেখান থেকে বের হয়ে আসে। তার উদ্দেশ্য আরো কিছু তথ্য নেয়া। সে আরো কিছু সময় ঘুরতে থাকবে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত সে ফিরবে না।
সে নিয়মিত রাতের আধারে জীবনের আধার করে রাখা তথ্য গুলো আবিস্কার করার জন্য বাড়ি বাড়ি ঘোরে। তার কিস্তি আদায়ের কাজ এখন থেমে নেই কিন্তু গুরুত্ব হারিয়েছে, গুরুত্ব হারিয়েছে রহস্য উন্মোচনের গুরুত্বের কাছে।। তার এর থেকে মুক্তি কি সহসা হবে।
৭ম পর্ব
বাহারের সাথে এক লোকের কথা কাটাকাটি হচ্ছে। মিলন নিকটেই কাজ করছিলো। মিলন আর বাহারের মাঝে তেমন সখ্যতা না থাকলেও মিলন কথাকাটি দেখে সেখানে যায়। হলুদ পঞ্জাবী আর মাথায় একটা টুপি পড়ে আছে সে। তার পায়ে জিন্স প্যান্ট ও সু। পাঞ্জাবী পড়া লোকটা বলছে,
আপনি এলাকায় কাজ করতে এসেছেন কোন গোয়েন্দা গিরি নয়। নিজের কাজটা ঠিক ভাবে করেন নইলে আমি আমার কাজ করবো।
মিলন পাঞ্জাবী পড়া লোকটার কথা শুনে অবাক হয় আবার মনে মনে খুশিও হয়। সে তৎক্ষাণাৎ বলে ভাই ওনার ভুল হয়েছে ওনাকে মাফ করে দেন। আমি ওনাকে বুঝিয়ে বলছি।
এই বলে বাহার মিলনের হাত ধরে তাকে নিয়ে গেল সামনের চায়ের দোকানে। সেখানে চায়ের অর্ডার দিলো মিলন আর বাহার তার সাথে থাকা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে তাকে দিলো মিলনকে।
বাহার ও দুজনেই সিগারেট টানছে।
সিগারেট টানতে টানতে বাহার বলছে, আপনার কারনে বড় ধরনের ঝামেলা থেকে বেচে গেলাম।
হ্যা, ভাই বড় ঝামেলা হলেও হতে পারতো। সাবধানে চলবেন আর আপনার বৃত্তান্ত কি বলেন তো শুনি।
ততখনে চা চলে এসেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে বাহার তার কথা বলতে শুরু করলো। মিলন ভুলে গেছে তার মাঠের কাজ আর বাহার ভুলে গেছে তার কিস্তি আদায়ের কাজ।
৮ম পর্ব
অন্যান্য দিনের মত বাহার হাতে লঠি নিয়ে বের হয়েছে। এতোদিনের চেষ্টায় যতটুকু না জানতে পেরেছে তার চেয়ে তার বেশী তৈরী হয়েছে জানার আগ্রহ। মনে তৈরী হয়েছে নানা প্রশ্ন। সে বিভিন্ন ঘরে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। এররকম করে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে । তার আজ ক্লান্ত লাগছিলো তাই সে দ্রুত আসে।
এসে সে তার ঘরের তালা খুলে বাতি দিলো। আর ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। তার মাথার উপর ঝুলছে একটি লাশ।
সে তাড়াহুড়া করে বিছানা থেকে নামলো। ঘরের জগে পানি খুজলো নাই। তাই সে ধপ করে মেঝেতেই বসে পড়লো।
লাশটি কিভাবে তার ঘরে এলো, তার ঘরে তো তালা লাগানো ছিলো, ইত্যাদি প্রশ্ন তার মনের ভিতর।
বাহার বুঝতে পারেনা লাশটি সে অন্য কোথাও লুকাবে নাকি লোক ডাকবে নাকি সে পালিয়ে বাচবে। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে নাকি অন্য কিছু।
আত্মহত্যার রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে সে নিজেই বুঝি হত্যার মামলায় ফেসে যায়। এমন অবস্থায় বাহার কি করবে, তার কি করা উচিত সে ভাবতে থাকে। তবে আপাতত লাশটির বিষয়ে তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আত্মহত্যা, হত্যা ও ঘটনার ভেতরের সত্য জানতে দর্শকদের আগামী পর্ব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাহার নিজেকে বাচিয়ে কিভাবে রহস্য উন্মোচন করে সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা। ততখন আমরা অপেক্ষায় থাকি।
নূরুন্নবী সবুজ।
MDNURUNNOBIISLAM379@GMAIL.COM