আলহাজ্ব আব্দুম মুনিব :
হজ্ব একটি আনুষ্ঠানিক ইবাদত। হজের আনুষ্ঠানিকতা গুলো মানুষের শারীরিক শক্তির সাথে সম্পৃক্ত। সাফা থেকে মারওয়া আবার মারওয়া থেকে সাফা পাহাড়ে হাটা এবং দৌড়ানো। পবিত্র কাবাঘর সাতবার প্রদক্ষিণ করা। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করার জন্য ৩দিন জামরাতে যেয়ে প্রথমদিন সাতটি এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয়দিন একুশটি করে পাথর নিক্ষেপ করা। মিনা মুজদালিফা হয়ে আরাফাতের মাঠে হেঁটে যাওয়া, আবার আসা। হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর চুম্বন করা। ওজু-গোসলসহ নিজের কাজ নিজে করা। এছাড়া নফল ইবাদতের মধ্যে ওমরা হজ, বেশি বেশি তাওয়াফ করাসহ অনান্য ইবাদত তো আছেই। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার কখনো কখনো প্রচন্ড রোদ উপেক্ষা করে এসব কাজ সম্পাদন করা খুবই কষ্টসাধ্য এবং শ্রমসাধ্য ব্যাপার। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে লক্ষ কোটি শুকরিয়া মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি আমাকে তার পবিত্র ঘরখানি (কাবাঘর) দু-চোখ মেলে দেখার, হাত দিয়ে ছোয়ার এবং আরাফা, মিনা, মুজদালিফায় অবস্থান সর্বপরি ইসলামের মুল ৫টি স্থম্ভের অন্যতম ইবাদত পবিত্র হজ্ব করার তৌফিক দান করেছেন। তৌফিক দান করেছেন সর্ব যুগের শ্রেষ্ঠ মানব মোহাম্মাদ (সাঃ) রওজাতে সালাম পৌছানো, মসজিদে নববীতে নামাজ আদায়সহ মক্কা মদিনা ও জেদ্দার ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলির কাছে যাওয়ার।
এবার আসি মুল কথায়, হজ্ব শব্দটি আরবি, আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা। তবে ইসলামি বিধানে হজ্ব বলতে বোঝায়, মুসলিম উম্মাহ নির্ধারিত সময়ে এবং নির্ধারিত নিয়মে পবিত্র নগরী মক্কায় অবস্থিত বায়তুল্লাহ তাওয়াফ এবং মক্কার নিকটবর্তী মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা প্রভৃতি স্থানে গমন, অবস্থান এবং সেখানে নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন করা। অন্যদিকে মুসলমানের ওপর হজ্ব ফরজ হওয়ার ব্যাপারে আর্থিক যোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান, মানসিকভাবে সুস্থ এমন প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর অন্তত জীবনে একবার হজ করা ফরজ। শারীরিক যোগ্যতাকেও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কোনো মুসলমান আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও যদি সে শারীরিকভাবে অক্ষম বা দুর্বল হয় তবে তার ওপরও হজের হুকুম শিথিলযোগ্য। আবার মানসিক ভার্সাম্যহীন ব্যক্তির ওপরও হজ ফরজ হওয়ার বিষয়ে ছাড় রয়েছে। কাজেই হজ ফরজ হওয়ার শর্তগুলোকে অতি যতেœর সাথে মূল্যায়ন করে তা বিবেচনায় নিয়ে আসা জরুরি। কেননা হজের এমন কিছু আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে, যা আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক বা কায়িক শক্তির সাথে সম্পৃক্ত।
হজ ফরজ করার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যারা এই ঘরে (কাবাঘর) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তারা যেন হজ্ব সম্পন্ন করে, তাদের ওপর এটি আল্লাহর হক। আর যে ব্যক্তি এ নির্দেশ মেনে চলতে অস্বীকার করবে তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি মুখাপেক্ষী নন। (সূরা আলে ইমরান: ৯৭)।
২০১৫ সালে হজের সফরে আমি দেখেছি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুসলিমদের তুলনায় বাংলাদেশের মুসলিমগণ অপেক্ষাকৃত বৃদ্ধ বয়সে হজ সম্পাদন করে থাকেন। সব ধরনের যোগ্যতা অনেক আগেই অর্জন করার পরও যখন দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে, পিঠ কুঁজো হয়ে শরীর নুয়ে পড়ে, হাঁটুতে যখন পর্যাপ্ত বল থাকে না তখন অনেকটা দায়মুক্তির হজ্ব করার জন্য এ দেশের বেশির ভাগ মুসলিম মনস্থির করেন। এ ক্ষেত্রে রাসূল সাঃ এর বানী- যৌবন বয়সের ইবাদত আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়।
বাংলাদেশের মুসলিম তরুণেরা আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হলেই কেউ কেউ স্ত্রী সন্তান নিয়ে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ঘুরতে যান। অনেক যুবক আছেন বিয়ের পর বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে এসব জায়গায় হানিমুনে বের হন আর বৃদ্ধ বয়সে হজ্ব করে পাপমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। অথচ তারা তরুণ বয়সে হজ করে নিজের জীবনটাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারেন অতি সহজেই। মক্কা ও মদিনায় ইন্দোনেশীয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান কিংবা আফ্রীকার এমন কিছু দেশের হাজী সাহেবদের সাথে কথা হয়েছে যারা যারা যুবক বয়সে হজে এসেছেন। তারা জানালেন, তাদের দেশের মুসলিমরা নর-নারী যুবক বয়সেয় হজ করার চেষ্টা করেন। আবার সদ্য বিবাহিত হাজী যুগলের সাথেও আমার সাক্ষাত হয়েছে। আমাদের দেশে হানিমুল বলতে আমরা যা বুঝি তা হল বিয়ের পর দুরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া। ঠিক তেমনই সেই হাজী যুগল করেছেন কিন্তু সেই সঙ্গে করেছেন একটি ফরজ ইবাদত। সর্বপরি তরুণ বয়সেই হজ করা উত্তম। আর নিয়ত ঠিক থাকলে আল্লাহ সব ব্যাবস্থা করে দেন। আমি নিজে সেই সৌভাগ্যের অধিকারী।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তৌফিক দান করুন যাতে লাখ লাখ হাজির কণ্ঠে ধ্বনির সাথে আমিও বলতে পারি ‘লাব্বাইক, আল্লা-হুম্মা লাব্বাইক; লাব্বাইক লা- শারিকা লাকা লাব্বাইক; ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক; লা-শারিকা লাক; অর্থাৎ ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির; আপনার কোনো অংশীদার নেই; নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্যও আপনার; আপনার কোনো অংশীদার নেই।’ লেখক-কামিল (আল হাদিস) মাস্টার্স (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।-সঁহরনশংঃ@মসধরষ.পড়স